নিবন্ধের শিরোনাম দেখে আঁতকে উঠবেন না প্রিয়পাঠক। পুরোটা পড়ে আপনারা যে মূল্যবান মতামত দেবেন তা এই অভাজন মাথা পেতে নেবে একথা জোর দিয়েই বলছি। কারণ আপনারাই আসলে সেরা বিচারক। পাঠকদের ওপর এই ভরসা এবং বিশ্বাস আছে ষোলআনা। যোগ্যদের প্রাপ্য শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েই বলতে হচ্ছে, কমিটি নিযুক্ত কতিপয় বিচারক কখনও কোনও লেখার প্রকৃত মান নির্ণায়ক হতে পারেন না। কেন পারেন না-তা নিয়ে হয়তো তর্ক-বিতর্ক হতে পারে কিন্তু মীমাংসায় আসা যায় না।
সৃষ্টির একেবারে প্রথম পর্যায় থেকে এ পর্যন্ত গভীর ও দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনেরা মানুষকেই এই গ্রহের শ্রেষ্ঠজীব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কেন এই স্বীকৃতি দিয়েছেন তা কমবেশি আমাদের সবারই জানা। সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং উন্নতির পিছনে মানুষের ভূমিকাই একমাত্র স্বীকৃত সত্য বলে পরিগণিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন অবদানের পিছনেও মানুষের ভূমিকার কথা আমরা জানি। মানুষের মেধা ও মনন, বোধ ও বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর শ্রম ও অধ্যবসায়।
এই সবকিছুর সুষম সমন্বয় ঘটিয়েই গোটা বিশ্বে মানুষ তাঁর শ্রেষ্ঠতার প্রমাণ রেখেছে। এবং এযাবৎ এই অকাঠ্য প্রমাণকে কেউ নস্যাৎ করতে পারেনি একথা বলাইবাহুল্য। আদিম সভ্যতার সঙ্গে আজকের সভ্যতার তুলনা টেনে একথা প্রমাণ করতে কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। এজন্য কোনও বিশেষজ্ঞ হতে হয় না কিংবা গবেষণারও প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণ মানুষও একথার স্বপক্ষে রায় দেবেন নিশ্চিত। এজন্য উচ্চশিক্ষা তো নয়ই, প্রথাগত শিক্ষারও কোনও প্রয়োজন নেই। এটা এমনই এক সর্বজন স্বীকৃত বিষয়।
উল্লেখ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সিংহভাগ সুফলই সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ভোগ করে থাকেন। সমাজের ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে। এমন কি, জাত-পাত-সম্প্রদায়-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধে অবশ্য সমাজের ওপরের তলার মানুষই ভোগ করে থাকেন। সেজন্য যে প্রভূত অর্থ ব্যয় করতে হয় তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব নয়। যেমন দ্রুত ও আরামদায়ক যাতায়াতের জন্য বিমান, গ্রীষ্মের খরতাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এসি মেশিন।
সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য লিফট-এর ব্যবহার, উন্নত শিক্ষা ও আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবার জন্য নামিদামি শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সুবিধে গ্রহণ, ট্রেন-বাসের ভিড় এড়াতে রাত-বিরতে বাড়ি ফেরার জন্য যখন-তখন ট্যাকসি কিংবা ওলা-উবের-এর সাহায্য নেওয়া ইত্যাদি আরও অনেক বিষয় আছে যা সুযোগ থাকা সত্বেও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ গ্রহণ করতে নিতান্তই অপারগ। যেকোনও দেশের যেকোনও সমাজের বিত্তবান শ্রেণির মানুষেরা এইসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকেন।
মানুষই তার প্রয়োজনে সভ্যতার উন্নতি ঘটিয়ে নিজেদের জীবনযাত্রা সহজ, সুন্দর ও আরামদায়ক করে তুলতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথে হেঁটেছেন। এখনও নতুন নতুন সব আবিষ্কারের পিছনে মানুষ ছুটছেন। এবং বলা বাহুল্য, এর পিছনে আছে আরও সুখ, আরও আরাম, আরও বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি। টিভির চ্যানেল পাল্টাতে এখন আর আপনাকে উঠে গিয়ে টিভির নব ঘুরোতে হয় না। সোফায় কিংবা বিছানায় বসেই অটো সিস্টিম-এ পারছেন ওই কাজটি সম্পন্ন করতে। কিংবা ফ্যান-এর সুইচ-এর ক্ষেত্রেও একই কথা।
এছাড়া অন-লাইন পেমেন্ট-ব্যবস্থা আপনাকে ক্যাশ হ্যান্ডেল-এর ঝুঁকি ও হ্যাপা থেকেই শুধু রেহাই দেয়নি, ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়ানোর সময় ও কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে। প্রয়োজনে রাত-বিরতেও আপনি অনায়াসেই যাকে-তাকে পেমেন্ট করতে পারছেন। আপনার ক্যাশ-লেস পার্শ বা পকেট থাকলেও অসুবিধে নেই। অসুবিধে হয়েছে বেচারা পকেটমারদের। লোকাল বাসে কিংবা লোকাল ট্রেনে পাঁচ-দশ টাকার ছোলা-বাদাম-ঝালমুড়ি কিনলেও আপনি গুগল বা পেটিএম-এ পেমেন্ট করতে পারছেন। এরচেয়ে সুবিধে আর কী হতে পারে!
ঘরে বসেই দূরপাল্লার বাস-ট্রেন-প্লেনের টিকিট কাটতে পারছেন। হাতের স্মার্টফোনের সাহায্যে প্রয়োজনে জরুরি সরকারি প্রমাণপত্র আপডেট করতে পারছেন। আইটি রিটার্ন ফর্ম জমা দিতে পারছেন। ঘরে বসেই পাশপোর্ট ফর্ম পূরণ করে আবেদন করতে পারছেন। ট্যাক্স-খাজনা জমা দিতে পারছেন। ইচ্ছে হলেই যখন-তখন অন-লাইনে খাবার সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে পারছেন। কলা থেকে ডাব-কী পাবেন না বলুন তো? কেউ কেউ তো ২৪ ঘন্টাই পরিষেবা দিতেও পিছপা নন। গ্রাহক পরিষেবাই এদের একমাত্র লক্ষ্য।
খাবার পৌঁছতে দেরি হলে সরবরাহকারীকে বকাঝকাও করতে পারেন। সরবরাহকারী সংস্থায় অভিযোগ জানালে তাদের কাছ থেকে জরিমানাও কেটে নেওয়ার সুযোগ আছে। অবশ্য গচ্ছা গুনতে হবে সরবরাহকারী সংস্থাকে নয়, ‘আজকের রানার’ ওই সরবরাহকারীকে। যে সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তারা একাজে বহাল আছেন। তার রোজগার থেকেই কাটা যাবে জরিমানা (ফাইন ফর ডিলেয়েড ডেলিভারি)। রাস্তায় ট্র্যাফিক-বিভ্রাটের মাশুল গুনতে হবে বেচারা ডেলিভারি বয়কে। এটাই এখনকার নিয়ম ! একবার ভাবুন তো, কতো সুখি আপনি! পকেটে টাকা থাকলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে অর্জিত সুবিধের সবটুকুই আপনি নিংড়ে নিতে পারছেন। পণ্যবাদি দুনিয়ার যাবতীয় ভোগ-বিলাসিতা আপনার মুঠোর মধ্যে। আপনার প্রতিবেশি কিংবা সমাজের অন্যের কথা আপনাকে না ভাবলেও চলে। অন্যের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়াই আপনি মুকুটহীন সম্রাট! আপনি বলতেই পারেন, এযুগ মহাসুখের যুগ। এযুগ মহাবিলাসিতার যুগ। এযুগ মহাবিচ্ছিন্নতার যুগ। এযুগ মহা স্বার্থপরতার যুগ। এযুগ নিজেকে নিয়ে ডুবে থাকার যুগ।
এবার ফিরে আসা যাক নিবন্ধের শিরোনামের বিষয়ে। যেখানে এই গ্রহের জীবকুলের মধ্যে মানুষকেই সবচেয়ে বেশি উন্নত এবং সবচেয়ে ক্ষতিকারক জীব বলা হয়েছে। ভাবছেন, সে আবার কী কথা! পাঠকের সুবিধার্থে কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক যা তাদেরও কমবেশি জানা। এখন প্রশ্ন হল, জানা কথার উল্লেখ করার প্রয়োজন কোথায়? দামি নিউজপ্রিন্ট আর সময় নষ্ট করেই-বা কী লাভ? আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নের যৌক্তিকতাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। তবুও নিবন্ধের প্রয়োজনে তা উল্লেখ করতেই হল।
কিভাবে আমি বা আমরা প্রতিনিয়ত এই সুন্দর পৃথিবীকে অসুন্দর করে তুলছি অর্থাৎ ক্ষতি করে চলেছি এবং এই ক্ষতি কিভাবে অপরের জীবনকে দারুণভাবে দুর্বিষহ করে তুলছে তা নিয়েই দু’চারকথা আর কী। এই ‘অপর’ আমার-আপনার পাড়া-প্রতিবেশি হতে পারেন, আমার-আপনার ঘরের মানুষ হতে পারেন; এমন কি, আমার-আপনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রিয়জনও হতে পারেন। হতে পারেন আমার-আপনার রাজ্য এবং দেশের মানুষও। এমন কি, হতে পারেন তাঁরা ভিন দেশের মানুষও। মোটকথা যেকেউ হতে পারেন।
আপনি হয়তো ভাবছেন, কী উল্টো-পাল্টা বকে চলেছে এই কলাম-লেখক! যত্তসব পাগলের প্রলাপ! সংবাদমাধ্যমের লোকজনেরা এতোবেশি কথা বলে (কিংবা লেখালেখি করে) যে পাঠকের বিরক্তি ধরে যায়। ঠিক এজন্যেই অনেকে কাগজ পড়াও নাকি ছেড়ে দিয়েছেন। কোনও একটা স্টোরি-ম্যাটার পেলেই হল। তা-ই নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে দেবে! কারণে-অকারণে কেবল কথার ফুলঝুড়ি ফাটাবে। আরে বাব্বা, এসব করে আর যাহোক, ভালো কাগজের সাংবাদিক হওয়া যায় না। এসব আর কবে বুঝবেন এরা?
ঘুম ভাঙার পর অর্থাৎ দিনের শুরু থেকেই না-হয় ক্ষতি করার খতিয়ান শুরু করা যাক। এবং পর্যায়ক্রমে রাতে বিছানায় শুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। সকালে উঠেই আমার-আপনার ক্ষতি করার পর্ব শুরু হয়ে যায়। কিভাবে? পাশের বাড়ির কেউ দেখার আগেই আগের দিনের পলিথিনে মোড়া বর্জ্যদ্রব্য ড্রেনে কিংবা রাস্তায় ফেলে দিই অনেকে। যদিও কোনও কোনও এলাকায় পৌরসভার আবর্জনা নেওয়ার গাড়ি আসে। কিন্তু আমাদের অনেকেরই কু-অভ্যাস হল, নির্দিষ্ট পাত্র কিংবা স্থানে নয়-যত্রতত্র নোংরা ফেলে দেওয়া।
কেউ কেউ আবার আশপাশের ফাঁকা জমিতে কিংবা পুকুরের জলে। এরফলে ড্রেন, রাস্তা, ফাঁকা জমি ও পুকুরের জল নোংরা হচ্ছে। পথ-কুকুরের দল বর্জ্য-ভর্তি ওই পলিথিনের প্যাকেট টেনে এনে ছিঁড়ে গোটা রাস্তাকে নোংরা করছে। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। অন্যদিকে ড্রেনের নিকাশি ব্যবস্থা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই জল ড্রেন উপচে পড়ছে। গোটা এলাকা জুড়ে চলাচলে অসুবিধে হচ্ছে। সবাই দেখছি কিন্তু দিনের পর দিন একই কাজ করে চলেছি আমাদের অনেকেই। কেউ একজন এগিয়ে এসে সামান্য প্রতিবাদটুকুও করছি না।
প্রতিদিন প্রতিবার ওয়াশরুমে গিয়ে ইউরিন ত্যাগের পর ফ্ল্যাশ করে পাঁচ লিটার জল নষ্ট করছি যেখানে এক মগ জলে কাজ হয়ে যায়। ওয়াশরুমে একটা বালতি আর মগ রাখলে জলের অপচয় বন্ধ করা সহজ হয়। কিন্তু সেদিকে আমাদের কারও নজর নেই। এরপর আছে ট্যাপ ওয়াটার-এর মুখ খুলে রেখে কাজ করা। এরফলে পরিশুদ্ধ জলের অকারণ অপচয় হচ্ছে। রাস্তায় জলের কলগুলির মুখও অনেক সময়ই খোলা থাকে। কেউ কেউ জল নেওয়ার পর কলের মুখ আর বন্ধ করার প্রয়োজনবোধ করেন না।
কোনও কোনও কলের মুখ আবার ভাঙাও থাকে। এভাবেই প্রতিদিন পুরসভার সরবরাহ করা গ্যালন গ্যালন পরিশুদ্ধ জলের অপচয় করে চলেছি আমরা। ‘জলের অপর নাম জীবন’—বিজ্ঞের মতো মুখে একথা বললেও সেই অমূল্য জীবনকেই সচেতনভাবে নষ্ট করে চলেছি আমরা। খুব বেশিদিন নয়, বছর বিশ-পঁচিশ পরেই পানীয় জলের অভাবে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়বে। যদি না ততোদিনে সমুদ্রের জলকে পানের উপযুক্ত করে তোলা সম্ভব হয়। পানীয় জল নিয়েই হয়তো আগামীদিনে যুদ্ধ-বিগ্রহের সন্মুখিন হতে হবে দেশকে।
এখন প্রায় ঘরে ঘরেই এসি মেশিন। গরম আর কারও সহ্য হচ্ছে না। তাই সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও একটি ঠান্ডা মেশিন চাই। ওই ঠান্ডা মেশিন থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ বাইরের পরিবেশকে গরম ও দূষিত করে তুলছে। অপরের ক্ষতি করছে। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথাই নেই। আমাদের ভাবখানা যেন এই, আমার সামর্থ্য আছে; আমি এসি চালাব-তাতে বাপু তোমার কী হে? তোমার ক্ষতির জন্য তো আমি গরম ভোগ করতে পারি না। স্বাধীন দেশে ‘ভালোভাবে থাকা’র স্বাধীনতাটুকু কী আমার থাকতে পারে না?
ব্যাঙ্ক কিংবা আর্থিক সংস্থা থেকে সহজ ইএমআই-এর কল্যাণে এখন ঘরে ঘরেই চার কিংবা চু’চাকার ছড়াছড়ি। পেট্রোল কিংবা ডিজেল চালিত এই ব্যক্তিগত মালিকানার গাড়ির ধোঁয়া আর ধূলোয় আমাদের চারপাশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ১২ মিনিটে ১৭৫টি দু’চাকার গাড়ির যাতায়াত। সারাদিনে তাহলে কতো পরিমানে শুধু দু’চাকার গাড়ি রাস্তায় চলছে। এরসঙ্গে আছে গণপরিবহনের জন্য প্রতিদিন সরকারি ও বেসরকারি চলাচলা এবং পণ্য পরিবহনের জন্য লরি-ম্যাটাডোর।
নতুন নতুন উপনিবেশ গড়ে তোলা সহ নানাবিধ খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য বন’ বা অরণ্য ধ্বংসের কর্মকাণ্ড চলছে। পর্যটকদের সুবিধের জন্য আছে পাহাড় কেটে প্রশস্ত পথ ও অত্যাধুনিক বিলাসবহুল হোটেল-রেস্তোরাঁ-গেস্ট হাউস নির্মাণের লাগাতার উদ্যোগ। এছাড়াও ভঙ্গুর পাহাড়ি জমির ওপর বিশালাকার মল তৈরি করা। পরিবেশ বিশারদদের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে কেবল ব্যবসায়িক কথা ভেবে চলছে এমন পরিবেশ ধ্বংসকারী বেআইনি উদ্যোগ। যার চড়া মাশুল গুনতে হচ্ছে নিরপরাধ স্থানীয় ভূমিপুত্রদের।
লোভী ও ভোগী মানুষের শখ আর ভোগ-বিলাসিতার জন্য গাছকেও মূল্য চোকাতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বৈধ ও অবৈধপথে গাছ কেটে বনাঞ্চল সাফ করে ফেলা হচ্ছে। আসবাবপত্র বানানোর জন্য দামি গাছ চলে যাচ্ছে কাঠ-চেরাইয়ের কারখানায়। সেখান থেকে আসবাবপত্র নির্মাণকারীর হাতে। বাড়িঘর সাজানোর জন্য তা চলে আসছে শহর ও শহরতলির ধনীদের ফ্ল্যাট কিংবা ঘরে। বিয়েতেও যৌতুক হিসেবে কনেপক্ষকে দিতে হচ্ছে আসবাবপত্র। ক্রমাগত গাছ কাটার ফলে সেখানকার আবহাওয়ারও পরিবর্তন ঘটছে। বৃষ্টির সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।
এছাড়া সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে লাগাতার পাহাড় কেটে পাথর (বাড়ির ঢালাইয়ের কাজের জন্য স্টোনচিপ) সংগ্রহের কাজ চলছে। ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোয় পাহাড়ের বাকি অংশ ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। ফলে আচমকাই বিপজ্জনক ধ্বস নামছে সংশ্লিষ্ট পাহাড়ে। পাহাড় এবং পাহাড় সংলগ্ন আশপাশের গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জীবনে নেমে আসছে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়। বাস্তুচ্যূত হচ্ছেন সেখানকার অসংখ্য অসহায় মানুষ। পাহাড়ে পর পর বিধ্বংসী ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, এমন কি, হরপাবানও আমাদেরকে কিছুমাত্র সচেতন করতে পারেনি! অপরিকল্পিত নদী বাঁধও বিপদ ডেকে আনছে সেখানকার মানুষের জীবনে। তাদেরকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। সাবেকি বাসস্থান সহ জীবন ও জীবিকায় টান পড়ছে। অনেকে পুনর্বাসনও পাচ্ছেন না। অন্যদিকে নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে বদলে দেওয়ায় তারা ফুঁসে উঠছে মাঝেমধ্যে। প্রতিশোধ নিচ্ছে বন্যার জলে নদির দু’কুল প্লাবিত করে। ইছামতি, তিস্তা সহ আরও অনেক নদির দু’দিকের জমি জবর-দখল হয়ে যাওয়ায় তাঁর গতিপথও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সামান্য বর্ষায়ও দু’কুল ভাসিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
পরিবেশ দূষণ এড়াতে পুরনো বাড়ি ভাঙা ও নতুন বাড়ি নির্মাণকালে (যা শহর ও শহরতলি জুড়ে হামেশাই হচ্ছে) যে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত দরকার-তা কোথাও নেওয়া হয় না। ফলে পুরনো-নতুন সিমেন্ট-বালি-স্টোনচিপ থেকে যে ব্যাপক ধুলোর ঝড় তৈরি হয়, তা চারদিকের পরিবেশকে দূষিত করে তোলে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলতে থাকা এই ক্ষতিকারক ধুলোর ঝড় সম্বন্ধে আমরা উদাসীন। আমাদের অনেকেই এসবের গুরুত্ব বোঝেন বলে মনে হয় না। বুঝলে ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন নিশ্চিত।
কারণে-অকারণে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বপরিবেশকে দূষিত করে তুলেছি আমরা। যুদ্ধে ব্যবহৃত আনবিক অস্ত্র সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে তো বটেই তার আশপাশের দেশের পরিবেশকেও বিষাক্ত করে তুলছে। দীর্ঘদিন তার রেশ থাকছে পরিবেশের ওপর। হিরোসিমা-নাগাসাকির স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। এই মুহূর্তে রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ চলছে। বছর ঘুরে চলছে; কিন্তু যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণই নেই। যুদ্ধ নামক মারণ-যজ্ঞের বলি যুদ্ধরত দেশের অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ। এমন কি, নিষ্পাপ শিশু ও অসহায় রুগিও!
ক্ষতির খতিয়ান এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। পুরো তালিকা দিতে গেলে এই প্রতিবেদনের কলেবর বৃদ্ধি পাবে। সচেতন পাঠক অবশ্য নিশ্চয়ই জানেন সেসব। তাই পুরো তালিকা পেশে বিরত থাকা গেল। আর এভাবেই প্রতিদিন এই গ্রহের স্বঘোষিত ‘উন্নত’ ‘শিক্ষিত’ ‘সচেতন’ মানুষ গোটা বিশ্বের ক্রমাগত ক্ষতি করে চলেছে। এই ক্ষতির ফলে একদিন এই সুন্দর পৃথিবীটা মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। মানুষ আরও কিছুটা সচেতন হলে এই ক্ষতির সবটা না হলেও অনেকটাই হয়তো কমানো যেত। কিন্তু সে গুড়ে বালি!