• facebook
  • twitter
Wednesday, 12 February, 2025

এক দেশ এক ভোট

তিনি বলেছেন, যাঁরা বলছেন একদেশ এক ভোট হলে খরচ সাশ্রয় হবে— এই যুক্তি খাটে না। তিনি বলেছেন, ২০১৯ থেকে ২০২৪ মধ্যে সরকারের নির্বাচনের জন্য খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার ওপর। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন চালাতে খরচ হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।

প্রতীকী চিত্র

সম্প্রতি লোকসভায় এক দেশ এক ভোট বিল পেশ হল— কিন্তু সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে এই বিলটি পাশ হওয়ার পর যদি তা বাস্তবে রূপ পায়, অর্থাৎ লোকসভা ও বিধানসভাগুলির ভোট একসঙ্গে হবে অদূর ভবিষ্যতে, তাহলে নির্বাচনের ব্যয় বাড়বে না কমবে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, একসঙ্গে ভোট হলে নির্বাচন পর্বের খরচ কমবে। তাছাড়া বার বার নির্বাচন হলে, সে লোকসভারই বা রাজ্যগুলির বিধানসভারই হোক, উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার জন্য লোকসভা নির্বাচনকে দায়ী করলেন। নির্বাচনের জন্য উন্নয়নে খরচের গতি কমে যায়। সুতরাং এক দেশ এক ভোট হলে খরচ আদৌ কতখানি কমবে, অর্থনীতির আদৌ মহ্গল হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিশেষজ্ঞ মহলে। কিন্তু মোদী সরকারের যুক্তি, বার বার নির্বাচন হলে আদর্শ আচরণবিধি মানার জন্য কোনও নতুন উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা করা যায় না— চালু প্রকল্পগুলির রূপায়ণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। উন্নয়নের গতি বেশ কিছুদিনের জন্য থেমে থাকে।

সুতরাং এক দেশ এক ভোট হলে, তার ভালমন্দ দুই দিকই আছে। ভালো একসঙ্গে সারাদেশের ভোট হয়ে গেলে সারা বছরভর কোনও না কোনও রাজ্যের নির্বাচন করতে হবে না। কিন্তু অপরদিকে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কথায় মন্দ দিক হল, আর্থিক বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়া। অর্থমন্ত্রী এক দেশ এক ভোট নিয়ে সওয়াল করলেও এতে অর্থনীতির কতটা লাভ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি ভালো করে অনুধাবন করেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন অর্থসচিব সুভাষচন্দ্র গর্গ। তিনি বলেছেন, যাঁরা বলছেন একদেশ এক ভোট হলে খরচ সাশ্রয় হবে— এই যুক্তি খাটে না। তিনি বলেছেন, ২০১৯ থেকে ২০২৪ মধ্যে সরকারের নির্বাচনের জন্য খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার ওপর। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন চালাতে খরচ হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে একসঙ্গে ভোট করাতে গেলে যে বিপুল সংখ্যয় ইভিএমের প্রয়োজন হবে, তার বাবদ একটা মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হবে। অর্থাৎ এর পিছনে খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তাছাড়া এক দেশ এক ভোট করাতে গেলে বিপুলসংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রয়োজন পড়বে। তার জন্যও বিপুল অর্থের প্রয়োজন পড়বে।

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোব্দেরি নেতৃত্বাধীন উচ্চস্তরীয় কমিটি বলেছিল, এক দেশ এক ভোট করাতে গেলে যা ফায়দা হবে, তা সংখ্যায় মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কমিটিকে জানিয়েছিলেন, ২০২৯ লোকসভা ভোট করাতে গেলে আনুমানিক খরচ হবে ৭,৯৫১ কোটি টাকা। লোকসভায় কংগ্রেসের উপ দলনেতা গৌরব গগৈ বলেছেন, মোদী সরকার যুক্তি দিচ্ছে একসঙ্গে ভোট হলে নাকি কোটি কোটি টাকার সাশ্রয় হবে। কী করে তা হবে? কারণ কেন্দ্রীয় বাহিনী ও ইভিএমের পিছনেই তো বিপুল টাকা খরচ করতে হবে। সুতরাং এক দেশ এক ভোট হলে আর্থিক সাশ্রয় তো হবেই না, বরং বেড়ে যাবে। তবে সারা বছর ভরেই কোনও না কোনও রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছে— তার ফলে বিপুল অর্থ যেমন খরচ হচ্ছে, তেমনই উন্নয়নের গতিও থেমে যাচ্ছে। সরকারি অফিসে কাজের গতিও মন্থর হয়ে যাচ্ছে।

নতুন বিলে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের সুপারিশে বিধানসভা ভেঙে দিতে পারেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু এতদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অথবা রাজ্যপালের সুাপরিশ মতো এই কাজ করতেন রাষ্ট্রপতি। এখন নির্বাচন কমিশনের হাতে বাড়তি ক্ষমতা দিতে চাইছে মোদী সরকার এই বিলে। যদিও সরকার এই বিলের যৌক্তিকতার কথা বলতে গিয়ে বলেছে, এই বিলের উদ্দেশ্য হল নির্বাচনী সংস্কার। এই বিল পাশ করাতে গেলেসরকারের এক তৃতীয়াংশ সমর্থন চাই, তা বিলক্ষণ জানে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই যেদিন লোকসবায় বিলটি পেশ হল, তাতে ভোটাভুটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন অমিত শাহ। তিনি সরাসরি বিলটি জেপিসির কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। বিলটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা কালে তা জেপিসির কাছে পাঠানোর কথা বলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।

কিন্তু লোকসভায় বিলটির ওপর বিতর্ক শেষে, ভোটাভুটির জন্য সরব হন তৃণমূলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্মিলিত চাপের মুখে ভোটাভুটির দাবি মেনে নিতে হয় শাসক শিবিরের। ভবিষ্যতে যদি লোকসভার ৫৪৩ জন সাংসদের মধ্যে ভোটাভুটি হয়, তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেতে শাসক দলের ৩৬২ জন সাংসদের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান লোকসভায় এনডিএর শক্তি ২৯৩। রাজ্যসভাতেও বিলটি আনলে সরকারের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন নেই। তা ঘরোয়াভাবে স্বীকার করেছে বিজেপি নেতৃত্ব।

সুতরাং শুধু একজনের ইচ্ছা (নরেন্দ্র মোদী) পূরণ করার জন্য বিলটি পেশ হল লোকসভায়। বিজেপি ভালো করেই জানত, বিলটি পাশ করার মতো শক্তি দলের নেই। বিলটি পেশ হলেও যে তা পাশ হবে না, তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছে গৈরিক শিবির। যেখানে অর্থমন্ত্রী নিজে স্বীকার করেছেন, বিলটি পেশ হলে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়া যাবে না। উল্টে প্রচুর অর্থের ব্যয় হবে কেন্দ্রীয় ফোর্স এবং ইভিএমের জন্য। তবে অর্থমন্ত্রীকে বিলটির পক্ষে সওয়াল করা ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ তিনি যে বিজেপি সরকারের অর্থমন্ত্রী। তাই বিলটি কি ঠান্ডা ঘরে?