শোভনলাল চক্রবর্তী
মা আমার কাছে ঝড়ও, আশ্রয়ও – লিখেছেন অরুন্ধতী রায়, তাঁর বহু-প্রতীক্ষিত স্মৃতিকথা “মাদার মেরি কামস টু মি”-তে।বিটলস-এর গানের লাইনের অবলম্বনে দেওয়া গ্রন্থনামে ধরা আছে অরুন্ধতীর মায়ের নামও, মেরি। যিনি আশ্রয়, তিনিই কি ঝড় হতে পারেন? অথবা, তিনি যদি ঝড়ই হন, তা হলে কি তাঁর পক্ষে আদৌ আশ্রয় হয়ে ওঠা সম্ভব? অরুন্ধতী রায় তাঁর স্মৃতিচারণে এই প্রশ্নের কোনও সুনির্দিষ্ট উত্তর দেননি। বরং, বইটির ৩৭৪ পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠকের জন্য রেখে গিয়েছেন এই দুর্ভেদ্য ধাঁধার উত্তর খোঁজার বিভিন্ন সূত্র। বইটির মুখ্য চরিত্র দু’জন— স্বয়ং লেখিকা; এবং তাঁর মা, কেরলের বিশিষ্ট নারীবাদী ব্যক্তিত্ব মেরি রায়। ‘মা’ বলতেই বিশেষত ভারতীয় সমাজের চোখে ভেসে ওঠে যে সর্বংসহ সর্বত্যাগী মূর্তিটি, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় অরুন্ধতী ভাঙচুর করেছেন তাকে। লিখেছেন, কী প্রবল বদমেজাজি, নির্মম, স্নেহহীন মাতৃত্বের নির্বিকল্প আশ্রয়ে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। পাঠক ধাক্কা খাবেন— ভাবতে বাধ্য হবেন, মাতৃমূর্তিকেও তবে প্রশ্ন করা যায়, করা সম্ভব! এবং, হয়তো একই সঙ্গে শিখে নিতে পারবেন, অবিশ্বাস্য যন্ত্রণাকে সয়েও কী ভাবে সেই যন্ত্রণার উৎসে থাকা মানুষটির আচরণের কারণগুলিকেও বিশ্লেষণ করা সম্ভব, চূড়ান্ত সহমর্মিতার সঙ্গে। সন্তান হয়ে মায়ের কাছে প্রত্যাশিত স্নেহ না পাওয়ার ক্ষোভ নিয়ে নয়, বরং এক জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যে ভাবে আর এক জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে দেখেন, তাঁকে বোঝার চেষ্টা করেন, সেই ভাবে। এই পাঠটি হয়তো ভারতীয় সমাজকেও প্রাপ্তমনস্ক করে তুলতে পারে— বোঝাতে পারে, মাকে দেবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আসলে আমরা তাঁর মনুষ্য সত্তাটিকে অস্বীকার করতে থাকি; তাঁর সমগ্র অস্তিত্বকে শুধু মা হিসাবে সাফল্য-ব্যর্থতার দ্বিত্বে বেঁধে রাখতে চাই। এই ‘বাইনারি’টিকে ভাঙতে পারলেই বোঝা যায়, যে মা আশ্রয় আর যে নারী ঝড়— একই দেহের মধ্যেও আসলে তাঁরা দু’জন আলাদা মানুষ। দু’টি পৃথক সত্তা। একের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে নেই। এই লেখা মনে পরায় তসলিমা নাসরিনকে। তিনিও তাঁর মা ও বাবাকে পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সাহস দেখিয়েছিলেন।
Advertisement
অরুন্ধতী রায়ের লেখা পড়ে মনে প্রশ্ন ওঠে ভারত নামক দেশটিও কি তেমনই নয়— একই সঙ্গে আশ্রয় এবং ঝড়? ঝড়, কারণ এই দেশই কেড়ে নিতে চায় আজন্ম নাগরিকের নাগরিকত্ব, পরিচিতির কোনও বিশেষ সূত্র ধরে; শাসকের সম্মতিতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন গ্রাস করে নেয় অজস্র মানুষের জীবন? ঝড়, কারণ কার্যত কোনও অকাট্য প্রমাণ ব্যতিরেকেই ফাঁসি হয়ে যেতে পারে কারও, শুধু অনেক মানুষ সেই ফাঁসি চাইছে বলে; নিতান্ত অকারণে এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের বেয়নেটের সামনে নিরন্তর জীবনযাপন করে বাধ্য করা যেতে পারে জন্মসূত্র কাশ্মীরি বলেই; অথবা, বহু শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদের জমিতে আদালতের সম্মতিক্রমে গড়ে উঠতে পারে মন্দির, কারণ ‘তেমনটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস’। অরুন্ধতী বলেছেন, কী ভাবে অরণ্যের মাটির নীচে খনিজ ভান্ডারের দখল নেওয়ার লালসা শেষ পর্যন্ত এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের ঘোষিত শত্রু করে তুলতে পারে। আবার, এই ভারতই আশ্রয়ও বটে— নির্বিকল্প আশ্রয়; কারণ, এই মানুষদের আর যাওয়ার জায়গা নেই। শুধুই কি ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা জনজাতিভুক্ত মানুষের জন্য ঝড় হয়ে ওঠে ভারত? একা নারীর জন্য, প্রান্তিক যৌনতার মানুষের জন্য, এমনকি শুধু ‘স্বাভাবিক’ হয়ে থাকার বাধ্যবাধকতাকে অস্বীকারের জন্যও কি প্রতিনিয়ত ঝড়ের সামনে বাঁচতে হয় না অনেককে? অরুন্ধতী তাঁদের কথা বলেছেন, তাঁদের সেই ঝড়ের মুখে আপ্রাণ বাঁচার কথা বলেছেন। সেই ঝড় যে শেষ অবধি আশ্রয়কে মিথ্যা করে দিতে পারে না, বলেছেন তা-ও।
Advertisement
নিকটতম ব্যক্তি-সম্পর্ক থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্ক— অরুন্ধতীর আখ্যান কখনও স্পষ্ট ভাবে, আবার কখনও আভাসে যাতায়াত করেছে এই দুইয়ের মধ্যে। কোন দ্বন্দ্বে শেষ অবধি কোন পক্ষের জয় হয়, সে প্রশ্ন এ আখ্যানে গৌণ। এ এক অত্যাগসহন সম্পর্কের গল্প— মায়ের সঙ্গে যেমন, ভারত নামক দেশটির সঙ্গেও তেমন। আর এই বিন্দুটিতে এসেই এই আখ্যান ব্যক্তিগত থেকে সামূহিক হয়ে ওঠে। কারণ, রাষ্ট্রের সঙ্গে দুর্বিষহ কিন্তু অত্যাগসহন এই সম্পর্ক সব নাগরিকের উত্তরাধিকার— সকলে সে বিষয়ে সর্বদা সচেতন নন, সে কথা ভিন্ন। সেই ঝড়কে মেনে নেওয়াই কি নিয়তি; অথবা, তার থেকে পালিয়ে খুঁজে নেওয়া অন্য কোনও ঠিকানা? না কি, ক্রমাগত চেষ্টা করে যাওয়া, ঝড় যাতে কোনও মতেই আশ্রয়ের চিহ্নটুকু মুছে দিতে না পারে?
যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ঝড় কেড়ে নিতে চায় বেঁচে থাকার ন্যূনতম অবলম্বনটুকুও, আর যে দেশ তার পরও মায়ার আঁচল দিয়ে ঘিরে রাখতে চায় সেই আহত মানুষগুলিকে, সে দু’টিও কি পৃথক সত্তা নয়? পাঠককে বারে বারেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে নিজের মতো করে।আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাই যদি ভাবি। ছেলেবেলায় সন্ধ্যার পর উঠোন পেরোতে ভয়ে কাঠ হতাম। মা শিখিয়েছিলেন, ভয় করলেই ভয়, না করলেই নয়। বছর দুয়েক পর পাঠ্যবইয়ে পেলাম অন্নদাশঙ্কর রায়কে: “জগৎ জুড়ে ভয়ের মেলা/ ভয় লাগে যে সারা বেলা/ কেমন করে করব খেলা/ ভয় ভেঙে দাও প্রভু।” আরও পরে পেলাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে, এ বার অবশ্য পাঠ্যবইয়ের বাইরে। “চলো, বেরিয়ে পড়ি।/ আকাশ এখন ক্রমেই আরও রেগে যাচ্ছে।/ যাক্।/ ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছু না।” কিন্তু ভয় যে দিন-দিন জাঁকিয়ে বসে! ঘরের অন্ধকার কোণে নিরাপত্তা খুঁজি। এই সর্বগ্রাসী ভয়ই রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতার হাতিয়ার। কয়েক মাস আগে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর জার্নালে ‘ফিয়ার: আ পাওয়ারফুল মোটিভেটর ইন ইলেকশনস’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ বেরোয়। লেখক কার্ক ওয়ালড্রফ, নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে ভয় ও ভয় ছড়ানোর যে সম্পর্ক রয়েছে তার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দেন। রচনাটি শেষ আমেরিকান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে মাথায় রেখে লেখা, কিন্তু যুক্তি-কাঠামো ও বর্ণনা এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়। অচিরেই ভারতে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু হয়ে যাবে, এই ভয়ই তো হিন্দুদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় ভোটকেন্দ্রে। বাংলাদেশে ‘জনতার অভ্যুত্থান’-এর পর হিন্দুদের বেছে বেছে আক্রমণ, খুন, বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেশে মুসলিম-বিদ্বেষ বেড়েছে শতগুণ। এতে শাসক শ্রেণির পোয়াবারো। এ বার নতুন ভয়, অচিরেই গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশ দখল নেবে এবং তৈরি হবে নতুন পূর্ব পাকিস্তান।
ফলে এখন রাষ্ট্রবাদী দেশবাসীর পবিত্র কর্তব্য বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি জাতীয় ছেঁদো কথায় কান না দিয়ে এক দেশ এক নেতার চরণে আত্মনিবেদন করা। নতুন এই ভয় অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে। ২০১৮-তে মনার্কি অব ফিয়ার লিখেছিলেন দার্শনিক মার্থা নুসবম। বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমেরিকার রাজনৈতিক পটচিত্রে ভয়ার্ত নাগরিকদের মনের গতিপথের হদিস খুঁজেছেন। লিখছেন, “বিভাজিত সমাজে নাগরিকরা গঠনমূলক আলোচনা ও বিতর্কের পরিসরই পান না।” কারণ সেই ভয়। এ বারের নির্বাচনে আমেরিকার জনগণকে সফল ভাবে তিনটি ভয় দেখিয়েছিলেন ট্রাম্প।
এক, বেআইনি অভিবাসীদের তাড়াতে না পারলে দেশ গোল্লায় যাবে। দুই, মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধি আটকাতে হবে। নইলে সাদা আমেরিকানদের সমূহ সর্বনাশ। তিন, কোনও মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসালে আমেরিকার পুরুষতান্ত্রিক মহান ইতিহাস কালিমালিপ্ত হবে। নারীবিদ্বেষী ট্রাম্পের কোনও সমস্যাই হয়নি মহিলা ভোটারদের মন পেতে। রুশোর এমিল উদ্ধৃত করে মার্থা দেখিয়েছেন, ভয়তন্ত্র তৈরি করে যে একনায়কেরা দেশ শাসন করেন, তাঁদের মানসিক গঠন ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে অপরিণত বালকের বিস্তর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।এ সব তো সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের কথা। কিন্তু আমি আমার দেশের কথা ভেবে ভয়ের তাড়সে লুকিয়ে পড়ি। এই ভয় থেকে মুক্তির পথ কী? সঙ্কল্প করা, ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’। তাই রবীন্দ্রনাথেই আশ্রয় নিই। ভিতরের ‘আমি’টা আমাকেই বলে ওঠে, “তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা…”। ভয়কে জয় করার এর চেয়ে ভালো মন্ত্র এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
Advertisement



