নারায়ণ দাস
ভারত একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। তার লোকসংখ্যা ১৪০ কোটি। ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই দেশের শাসন কার্য চালাচ্ছে— এবার তৃতীয় দফা। প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে আসীন। তিনি একটি স্বচ্ছ ভারতের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন— যে ভারতে মানুষ সুখে বাস করবেন। দারিদ্র্য দূর হবে, অভাব ঘুচে যাবে, ঢালাও কর্মসংস্থান হবে, যাতে বেকারিত্ব দূর হয়। ভারত উন্নয়নে টেক্কা দেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে। এই হল প্রধানমন্ত্রীর স্বচ্ছ ও উন্নতিশীল দেশ গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করার কোনও চেষ্টা এখনও দেখা যায় না।
Advertisement
কিন্তু তাঁর দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যেমন সাংসদ এবং বিধায়করা প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নকে সফল করতে কতটা চেষ্টা করছেন সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ বিজেপির জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় রত। দেশের সিংহভাগ রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়। বাকি রাজ্যগুলিতে ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন এই দল। নির্বাচনের আগে বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধিরাই ছিলেন বিত্তবান। শাসক দলের প্রতিনিধি হয়ে তাঁরা আরও বিত্তশালী হয়েছেন। তাঁরা জনসাধারণের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে, নিজেদের স্বার্থই বড় করে দেখছেন। ফলে অনেকেই কোটিপতি হয়েছেন, বিশাল অট্টালিকা তৈরি করেছেন— মানুষের স্বার্থ বিঘ্নিত করে, মানুষকে ঠকিয়ে। বিজেপি সাংসদ এবং বিধায়করা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের বিত্তশালী করে তুলছেন। এই দলের জনপ্রতিনিধিরা যদি মানুষের সুখ-দুঃখের কথা দেশের স্বার্থের কথা ভুলে, গরিব সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে, দলের স্বার্থ ভুলে নিজেদের স্বার্থই বেশি করে দেখেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর স্বচ্ছ ভারতের স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে— তা বাস্তবে রূপায়িত হবে না। দলের সাংসদ বা বিধায়ক— বেশির ভাগ যে কেন্দ্র থেকে ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই কেন্দ্রের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা ভাবেন না। দুঃসময়ে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান না— উল্টে তাঁদের নানাভাবে ঠকিয়ে ধনবান হচ্ছে। যাঁর বেশি বিত্ত আছে, সে আরও বিত্তবান হওয়ার চেষ্টায় রত।
Advertisement
একজন সাংসদের অধীনে রয়েছে সাতটি বিধানসভার কেন্দ্র। সাংসদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হল মাঝে মাঝেই তিনি যে কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, তার অধীন সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে যাওয়া। সেখানে মানুষের কোনও সমস্যা থাকলে তা বিশদে জানা এবং তা সমাধানের চেষ্টা করা। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রের উন্নতিকল্পে নানা প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়িত করা। এই কাজের জন্য প্রত্যেকটি সাংসদ ভাতা পান। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, একবার নির্বাচিত হলে, তারপর সেই কেন্দ্রে গিয়ে মানুষের সার্বিক অবস্থা কেমন, তাদের কোনও সমস্যা আছে কিনা, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল হওয়া বা খোঁজখবর নেওয়ার কোনও চেষ্টা করেন না। তিনি সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগী হবেন, তাঁদের কোনও সমস্যা থাকলে তার সমাধান করবেন, কেন্দ্রের উন্নতির জন্য বিভিন্ন জনহিতকর প্রকল্প গ্রহণ করবেন— এই সব কাজের জন্যই সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের মানুষ তাঁকে নির্বাচিত করেছেন ভোট দিয়ে। কিন্তু একবার নির্বাচিত হলে বেশির ভাগ সাংসদ তাঁদের কেন্দ্রের মানুষ কীভাবে কালাতিপাত করছেন, তাঁদের কোনও সমস্যা আছে কিনা, তার খোঁজখবর করার প্রয়োজন মনে করেন না। দেশেরর মানুষ সাংসদদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সমস্যার কথা বলারও সুযোগ পান না। তবে সব সাংসদ এবং বিধায়করা যে এই দোষে দোষী, তা বলা যাবে না। অনেক সাংসদ এবং বিধায়করা আছেন, তাঁরা নিয়মিত যে কেন্দ্র থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে যান। যান কেন্দ্রের অধীন বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে— এবং মানুষের কোনও সমস্যা থাকলে তা মেটানোর চেষ্টা করেন।
একজন জনপ্রতিনিধি এই কাজে প্রধান। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সাংসদ এবং বিধায়করা যদি তাদের কেন্দ্রগুলির উন্নতিকল্পে সচেষ্ট হতেন, তাহলে দেশের আরও উন্নতি হত। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শাসক দলের প্রতিনিধিরা বেশির ভাগই নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার, বিত্তশালী হওয়ার চেষ্টায় রত থাকেন। সেজন্য দেশের উন্নতি তেমন চোখে পড়ে না। কিন্তু অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সাংসদ ও বিধায়কদের শাসক দলের জনপ্রতিনিধিদের মতো অনেক সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত। দেশের জন্য সাংসদ উন্নেয়নের বিভিন্ন দাবি তুললেও, তা মেনে নেওয়া হয় না। ফলে উন্নয়নের কাজে তাঁরা শাসক দলের জনপ্রতিনিদিদের মতো সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
এটা ভুললে চলবে না, জনগণের দ্বারা ভোটে নির্বাচিত সাংসদ ও বিধায়কদের দেশের উন্নতিকল্পে, মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অনেক দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে— কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে দায়িত্ব পালন করেন না। শাসক দলের জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন— অপরদিকে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিরা জনহিতকর, জনকল্যাণকর কাজ করতে তেমন কোনও সুযোগ পান না। বাধ্য হয়ে তাঁদের শাসক দলের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমি উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি বিধানসভার প্রতিনিধিকে জানি— তিনি সকালে প্রাতঃরাশ সেরে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে তাঁর কেন্দ্রের মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতেন, তাঁদের কোনও ব্যাপারে অসুবিধা বা সমস্যা আছে কিনা জানতে। সাধ্যমতো তিনি তা মেটানারও চেষ্টা করেন। নিজে না পারলে তিনি তা ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এটা ছিল তাঁর প্রতিদিনের কাজ। রাজ্য বিধানসভার অধিবেশনে তিনি তাঁর কেন্দ্রের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরতেন। তিনি সরকারের কাছে আর্জি জানাতেন মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে সমস্যাগুলির সমাধান করা। তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে এই কেন্দ্রের মানুষ প্রতিটি বিধানসভার নির্বাচনে তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতেন। কিন্তু এমন জনদরদি, জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা আমাদের দেশে কম। তাই দেশের যতটা উন্নয়ন হওয়া দরকার, তা হতে পারছে না।
প্রধানমন্ত্রী চান ভারত হবে এমন একটি দেশ, যেখানে দারিদ্র থাকবে না— মানুষ স্বচ্ছন্দে বাস করবেন। এমন উন্নত ভারতের কথা তিনি প্রায়ই উচ্চারণ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন তাঁর দলের বেশির ভাগ সাংসদ ও বিধায়করা তাঁর এই স্বপ্ন যাতে বাস্তবায়িত হয়, তার জন্য কোনও চেষ্টা করেন না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর সেই স্বপ্ন যে কবে পূরণ হবে, তা বলা কঠিন। কারণ তিনি জনকল্যাণের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ পায় না। তিনি অনেক বড় বড় কথা বলেন, তা শুনে মানুষও ভাবেন এখন তাঁদের দুঃখ, তাঁদের অভাব দূর হবে— কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথা কথাই থেকে যায়। স্বাধীনতার পর যত সরকার এসেছে, সব সরকারই দেশের দারিদ্র মোচনের কথা বলেছেন। ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু এখনও দারিদ্র্য দূর হওয়া তো দূরের কথা— মানুষের অভাব আরও বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে মানুষ নাজেহাল।
দেশের সবচাইতে বড় সমস্যা বেকারিত্ব। ঘরে ঘরে বেকার, তাঁরা বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তাঁরা উপযুক্ত কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। কিন্তু কোথায় কাজ? দেশে কর্মসংস্থান দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে, আর ভারী শিল্পের দেখা নেই। দেশে এখনও অসংখ্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষ, দারিদ্র্যপীড়িত মানষে রয়েছে। তাঁরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। এই সব গরিব সর্বহারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা না মিটিয়ে কী ভাবে তিনি স্বচ্ছ ভারত গড়বেন, তা নিয়ে সবার মনেই সংশয় বিরাট করছে। বিরোধীরা তাই বলেন, প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, কাজে তা করেন না। ভুলে যান দেশের মানুষের পিছিয়ে পড়া মানুষের দুঃখদুর্দশার কথা। সুতরাং সবদিক থেকে একটি উন্নত ভারত গড়া এখনও কল্পনার স্তরেই। .
Advertisement



