• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির স্নেহধন্যা দেশহিতৈষী মালতী চৌধুরী

মালতীদেবী জমিদার, মহাজনদের শোষণের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। গঠন করেন ওড়িশা কৃষক সভা।

ফাইল চিত্র

বিমলকুমার শীট

সে সময় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি অনেকে সমানভাবে সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মালতী চৌধুরী (১৯০৪-১৯৯৮)। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্মা গান্ধীর ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে মিনু, গান্ধীর কাছে তুফানি এবং ওড়িশাবাসীর কাছে নুমা নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। মালতীদেবীর জন্ম কলকাতায়, কিন্তু কর্মক্ষেত্র ওড়িশায়। তাঁর মা স্নেহলতা শান্তিনিকেতনের স্মৃতিচারণ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মালতী খুব খুশি ছিলেন এবং ছাত্রী হিসাবে বিশ্বভারতীতে তাঁর বাসস্থান থেকে তিনি অনেক উপকৃত হয়েছিলেন। গুরুদেবের ব্যক্তিগত প্রভাব এবং তাঁর শিক্ষা, তাঁর দেশপ্রেম এবং আদর্শবাদ, মালতীকে তার জীবনজুড়ে প্রভাবিত এবং পরিচালিত করেছে”। স্বাধীনতার পরও ওড়িশাতে তাঁর সমাজসেবার কর্মধারা অব্যাহত ছিল। ওড়িশা সরকার তাঁকে ‘উৎকল রত্ন’ সম্মানে ভূষিত করে।

Advertisement

শান্তিনিকেতন আশ্রমে মেয়েদের দেখভালের জন্য রবীন্দ্রনাথ একজন মহিলার খোঁজ করছিলেন। পেলেন স্নেহলতাদেবীকে (১৮৭৪-১৯৬৭)। তিনি রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী ছিলেন। ১৯০৭ সালে তাঁর স্বামী কুমুদনাথ সেনের মৃত্যু হলে এবং কলকাতার শহরজীবনে বীতস্পৃহা হয়ে বিশ্বভারতীর কাজে যোগ দিতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে ৯ অক্টোবর ১৯২১ সালে তাঁকে লিখলেন— ‘তুমি ছুটির পরে শান্তিনিকেতনে আসচ শুনে খুব খুশি হয়েছি। আমি নিশ্চয় জানি তুমি যদি ছেলেদের পড়াবার ভার নেও তাহলে খুব ভালই হবে। —কলকাতার চেয়ে এখানে তুমি শান্তিতে থাকবে, তার সন্দেহ নেই। আমার খুব বিশ্বাস এখানকার কাজ তোমার ভাল লাগবে।’ স্নেহলতা পুজোর ছুটির পরে কন্যা মালতীকে (মিনু) নিয়ে শান্তিনিকেতনে কাজে যোগ দেন। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর। শান্তিনিকেতনে তিনি কেবল ডিগ্রি অর্জন করেননি বরং বিভিন্ন নাটক এবং সংগীতের আসরে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

Advertisement

সে সময় কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে মোদপুর ও শান্তিনিকেতনে ছেলেদের স্কাউট দল গঠিত হয় এবং তাঁদের কাজ সকলের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। মেয়েদের অনুরূপভাবে সংগঠিত করার জন্য স্নেহলতা সেন ও গ্রেচেন গ্রিন কলকাতায় গার্ল-গাইডের অধীনেত্রী ললিতা মুখার্জিকে চিঠি লিখে শান্তিনিকেতনে একটি শাখা খোলার অনুরোধ জানান। সেইমত শান্তিনিকেতনেও মেয়েদের জন্য গার্ল-গাইড খোলা হয়। ১৪ জন ছাত্রীকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। দুটি দলের পেট্রল লিডার হন মঞ্জুশ্রী ঠাকুর ও মালতী সেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন-শাখা গার্ল-গাইডের নামকরণ করেন ‘সহায়িকা’। এঁদের সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হত। মালতী দেবী সহ অন্যান্য মেয়েরা তা নিতে রাজি হয়নি। এ সময় সবরমতী আশ্রম থেকে শান্তিনিকেতনে পড়তে আসেন ওড়িশার নবকৃষ্ণ চৌধুরী (১৯০১-১৯৮৪)। মালতী সেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। এরপর ১৯২৭ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

বিয়ের পর তাঁরা ওড়িশায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং গ্রামীণ উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করেন। দরিদ্র কৃষকদের আখ চাষ উন্নত করতে সাহায্য করেন এবং তাঁরা আশপাশের প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা প্রদান করেন। ১৯৩০ সালে গান্ধীজি লবণ সত্যাগ্রহের ডাক দিলে দেশময় তার প্রভাব পড়ে। ওড়িশাতে মালতী চৌধুরীর প্রভাবে ইনচুদি ও কুজাঙ্গ এর একশ জন মহিলা লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দেন। মালতী চৌধুরী গ্রেপ্তার হন এবং ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে কারারুদ্ধ থাকেন। পরে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত হাজারিবাগ জেলে কাটান। ১৯৩৩ সালে মালতী চৌধুরী এবং তাঁর স্বামী নবকৃষ্ণ চৌধুরী উৎকল কংগ্রেস সমাজবাদী কর্মী সংঘ গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীকালে অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির ওড়িশা প্রাদেশিক শাখায় পরিণত হয়। ১৯৩৪ সালে ওড়িশায় গান্ধীজির পদযাত্রায় মালতী চৌধুরী তাঁর সঙ্গী হন। সেদিন গান্ধীজির হরিজন পল্লিতে যাওয়ার কথা থাকলেও শরীর ক্লান্ত থাকায় তিনি যেতে পারেননি। গ্রামবাসীরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে হতাশ হয়েছিলেন। মালতীদেবী স্পষ্টত গান্ধীজিকে বলেন, ‘বাপু, আপনি সঠিক কাজ করেননি।’ এর জন্য গান্ধীজি ক্ষমা চেয়েছিলেন।

১৯৪০ সালে মালতী চৌধুরী ওড়িশা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হন। ১৯৪২ সালে হন সারা ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য। কটক জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু হলে মালতী চৌধুরী তাতে অংশ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন কিন্তু তাঁর এক বছরের শিশুকন্যা থাকায় গান্ধীজি তাঁকে বারণ করেন। বেরহামপুর ও রাসেলকুণ্ডাতে লক্ষীবাঈ ও চম্পাদেবী ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ করায় পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। ৪ আগস্ট ১৯৪২ সালে বোম্বেতে জাতীয় কংগ্রেসের অনুষ্ঠানে মালতীদেবী যোগদান করেন। ওড়িশায় ১৯৪২-এর গুপ্ত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দ্বিবেদী। তাতে মালতীদেবী তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। ভারত ছাড়ো প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর বোম্বের মেয়র ইউসুফ মেহের আলির বাড়িতে সমাজবাদীদের এক গোপন বৈঠক হয়। সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মালতী চৌধুরী সহ অচ্যুত পট্টবর্ধন, রামমনোহর লোহিয়া, অশোক মেহেতা, সুরেন্দ্রনাথ দ্বিবেদী প্রমুখ। সেখানে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে গোপনে আন্দোলন চালাবার প্রস্তাব গৃহীত হয়। দেশময় কংগ্রেস নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়। রামাদেবী সহ চার শীর্ষনেতাকে গ্রেপ্তার করে কটক জেলে রাখা হয়। মালতী দেবী ওড়িশায় আগস্ট বিপ্লবের ঝড় তুললেন। র‍্যাভেনশ কলেজের ছাত্রীরা, নার্সিং হস্টেলের আবাসিকরা, ছাত্র ফেডারেশনের ছাত্রীরাও স্বতঃর্স্ফুতভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মালতীদেবীর পনের বছরের কন্যা উত্তরা চৌধুরীও আন্দোলনে সাহায্য করেন। গোপনে প্রচারিত বুলেটিন ধারাবাহিক আন্দোলনে সাহায্য করে। মালতীদেবী আত্মগোপন করে সমগ্র ওড়িশায় আন্দোলনের বিস্তার ঘটান। অবশেষে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং কটক জেলে অন্যান্য নেত্রীর সঙ্গে তাঁকেও আটক রাখা হয়।

মালতীদেবী জমিদার, মহাজনদের শোষণের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। গঠন করেন ওড়িশা কৃষক সভা। এর মুখপত্র ছিল ‘কৃষক’ নামক এক পত্রিকা। মালতীদেবী জমিদারী প্রথা বিলোপের জন্য প্রচেষ্টা চালান। ঢেঙ্কানল, তালচের, নীলগিরি প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যে প্রজাদলনের বিরুদ্ধে মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন মালতীদেবী। তিনি সরাসরি ওড়িশার বাইরেও আন্দোলন করেন। প্রজামণ্ডল আন্দোলনে তিনি ‘জোয়ান অব আর্ক’ নামে পরিচিত। এই দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের দুঃখের সীমা ছিল না। রাস্তাঘাট নেই, জমি জায়গা জোর করে রাজা দখলে নিয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ দিন করে কৃষকদের রাজা বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করত। ‘কৃষক’ পত্রিকা এই অত্যাচারের বিবরণ তুলে ধরত। জেনাপুর কৃষক সভা ছিল ঢেঙ্কানল প্রজামণ্ডল আন্দোলনে এক মাইলফলক, যা মালতী দেবী এবং নবকৃষ্ণ চৌধুরীর দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল।
দেশ স্বাধীনতা লাভের পর মালতীদেবী ওড়িশার একমাত্র মহিলা সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং উৎকল প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে কয়েকটি অধিবেশনে যোগদানের পর তিনি অস্বস্তি বোধ করেন এবং পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালী যাত্রায় যোগদান করেন। যার লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধস্ত অঞ্চলগুলিতে শান্তি ও সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা। মালতীদেবী পরে লিখেছিলেন, ‘আমার কাছে গণপরিষদের শেষ বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়ার চেয়ে এটি বেশি মূল্যবাণ বলে মনে হয়েছিল।’ গ্রামীণ পুনর্গঠন, শিক্ষা, বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্কের শিক্ষার উপর জোর দেন। ১৯৫০ নবকৃষ্ণ চৌধুরী ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী হন। এ সময় আচার্য বিনোবা ভাবে ভূদান ও গ্রামদান আন্দোলন শুরু করলে এই আন্দোলনের সঙ্গে তিনি গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। গ্রামদানের বার্তা ছাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিনোবার সঙ্গে তিনি ওড়িশার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

১৯৪৬ সালে কারাবাস থেকে মুক্তিলাভের পর মালতী চৌধুরী ওড়িশা রাজকীয় রাজ্যে দুঃস্থ রাজনৈতিক কর্মিদের সন্তানদের শিক্ষা প্রদানের জন্য শহীদ বাজি রাউতের স্মরণে অঙ্গুলে বাজি রাউত ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে গড়জাত শ্রমিকদের ছেলেদের ভর্তি করা হলেও পরবর্তীকালে ১৯৪৯ সাল থেকে দরিদ্র আদিবাসী ও হরিজনদের সন্তানদের ভর্তি করা হয়। উৎকল নবজীবন মণ্ডল, সারঙ্গধর দাস ও গোপবন্ধু দাসের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও মালতি চৌধুরীর উপর এর পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি তাদের উন্নয়ন এবং চেতনা জাগ্রত করার জন্য কাজ করতে থাকেন। মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি মাহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন। সেখানে বিধবা পরিত্যক্ত মহিলাদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মহিলারা যথেষ্ট শিক্ষিত না হলেও তাঁদেরকে মহাজন, রাজস্ব পুলিশ ও বনকর্তাদের অন্যায় নিপীড়ন এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে প্রশিক্ষিত করা হয়। মালতীদেবী আদিবাসী গ্রামে তাদের সঙ্গে থেকেছেন, হেঁটেছেন। তাঁর প্রভাবে গুনুপুর, দুর্গি, বিসম কটক, রায়গড়, কোলাসাকাটা, কোরাপুট, পাটাঙ্গি, সুনাবেদা, উপারাবোণ্ডা, নওরঙ্গপুর ইত্যাদি কেন্দ্রের কর্মীরা অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।

মালতী দেবীর কাজের সুবিধা তখনই হল যখন তাঁর স্বামী নবকৃষ্ণ চৌধুরী উড়িশার মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫০-১৯৫৬) হলেন। তিনি উৎসাহের সঙ্গে অনেক কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেন। নির্ভিকভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র, সামন্তদের বিরুদ্ধে যেমন লড়াই করেছেন তেমনি ভারত সরকারের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরী অবস্থা জারি করলে তাঁর এই সৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে মালতীদেবী প্রতিবাদ করেন, ফলে তাঁকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। নিরলসভাবে প্রত্যন্ত এবং চ্যালেঞ্জিং জায়গায় তিনি কাজ করেছেন। তাঁর উন্নয়নমূলক কাজের জন্য রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয় সরকার মালতীদেবীকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করেছে (শিশুকল্যাণ জাতীয় পুরস্কার, যমুনালাল বাজাজ পুরস্কার, উৎকল সেবা সম্মান ১৯৯৪, ঠাকুর স্বাক্ষরতা পুরস্কার ১৯৮৮, বিশ্বভারতী কর্তৃক দেশিকোত্তম প্রভৃতি)। সম্ভবত তিনিই ছিলেন স্বাধীন ভারতে সমঅধিকার লাভের লড়াইয়ে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা।

Advertisement