• facebook
  • twitter
Wednesday, 12 February, 2025

বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে কলকাতা, তবে প্রদীপের নীচে অন্ধকারও আছে

বিজ্ঞান-গবেষণার পরিকাঠামো, উন্নত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা থেকে শুরু করে গবেষকদের আর্থিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা— কোনও দিক থেকেই কলকাতার ছবিটি অত্যুজ্জ্বল কি?

বিশ্বের বড় বড় শহর ও ‘মেট্রোপলিটন এরিয়া’র বিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষকরা কেমন কাজ করছেন, কত সংখ্যক এবং কত উচ্চমার্গের বিজ্ঞান-বিষয়ক পেপার প্রকাশিত হচ্ছে তাঁদের— সেই তথ্যের ভিত্তিতে প্রতি বছর বিশ্বের সেরা দু’শো বিজ্ঞান-নগরীর তালিকা প্রকাশ করে ‘সায়েন্স ইন্ডেক্স’। গত বছরের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি তালিকাটি প্রকাশ পেল সম্প্রতি,সেখানেই দেখা গেল, প্রথম একশোয় স্থান পেয়েছে ভারতের কলকাতা, বেঙ্গালুরু ও মুম্বই, যথাক্রমে ৮৪, ৮৫ ও ৯৮ নম্বরে; ১২৪ নম্বরে আছে দিল্লিও। এই ভারতীয় শহরগুলি এর আগেও স্থান পেয়েছিল এই তালিকায়, কোভিডধ্বস্ত ২০২০ সালেও বেঙ্গালুরু ও কলকাতা ছিল একশোর মধ্যে। তবে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চিন: এ বারের তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় সেরা শহর বেজিং ও শাংহাই, প্রথম কুড়ির মধ্যে দশটিই চিনের। নিউ ইয়র্ক, বস্টন, সান ফ্রান্সিসকো, বাল্টিমোর, টোকিয়ো, প্যারিস, সোল, লন্ডন, লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগোও আছে প্রথম কুড়িতে।চিন এক বিরল ও প্রবল ব্যতিক্রম: অ্যাথলেটিক্স থেকে বিজ্ঞান, বুলেট ট্রেন থেকে নগর-পরিকল্পনা, সব কিছুতেই সেরার শিরোপা পেতে তাদের সরকার স্থিরলক্ষ্য ও দরাজ।

অন্য শহরগুলির নাম ও মানচিত্রের অবস্থান দেখলেও বোঝা যাবে, সেরা বিজ্ঞান-নগরী তালিকায় তারাই উপরের দিকে, রাষ্ট্রীয় ভাবে যাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পরিকাঠামো নির্বিকল্প। আবার শহরের নাগরিক পরিকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা যে বিজ্ঞান-গবেষণার কাজে ছাপ ফেলতে পারে তাও প্রমাণিত; ‘নেচার ইন্ডেক্স’ কর্তৃপক্ষ উদাহরণ দিয়েছেন সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়া-য় অস্বাভাবিক বেশি বাড়িভাড়া বা খরচের, গবেষকরা সেই ভাড়া গুনতে অপারগ হলে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের সরে যেতে হবে অন্যত্র, তার জেরেও একটি বড় শহরের ‘ক্রমাবনতি’ ঘটতেই পারে! আবার তথাকথিত ছোট অনেক চিনা শহর যে এ বছর তালিকায় ঈর্ষণীয় স্থানে তার কারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক-একটি বিশেষ ক্ষেত্র ধরে ধরে এক-একটি শহর বা অঞ্চলকে তৈরি করা হচ্ছে বিশ্বমানের।এই যেখানে সার্বিক চিত্রটি, তার পাশে প্রথম একশোর মধ্যে বেঙ্গালুরু ও বিশেষ করে কলকাতার স্থান পাওয়া, উপরন্তু সেই গৌরব ধরে রাখতে পারার ধারাবাহিকতাকে প্রশংসা না করে উপায় নেই।

বিজ্ঞান-গবেষণার পরিকাঠামো, উন্নত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা থেকে শুরু করে গবেষকদের আর্থিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা— কোনও দিক থেকেই কলকাতার ছবিটি অত্যুজ্জ্বল কি? রাজ্য বা কেন্দ্র, কোনও সরকারেরই এ বিষয়ে ভাবনা বা আগ্রহের প্রমাণ মেলে না, বিজ্ঞানে বরাদ্দ-হ্রাস ও বহুবিধ অব্যবস্থা নিয়ে এ শহর, রাজ্য ও দেশেরও বিজ্ঞান-মহল সরব বহুকাল। শাসকদের রাজনৈতিক মতাদর্শও আর কোনও দেশে জ্ঞান-চর্চায় এমন দুস্তর বাধা হয়ে দাঁড়ায় কি না, সে কথাটিও ভাববার। এত কিছু সহ্য করেও কলকাতা যে সেরা দু’শো বিজ্ঞান-নগরীর মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে, তার কৃতিত্ব একান্ত ভাবেই এই বিজ্ঞানী ও গবেষকদেরই: এ তাঁদের মেধা, প্রতিভা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়েরই জয়, সরকার ও রাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে গৌণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ও পঠনপাঠন এবং গবেষণার কাজে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিয়েছে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতেও বহু নামী গবেষক কাজ করে গেছেন। বসু বিজ্ঞান মন্দির, মেঘনাদ সাহা ইনস্টিটিউটে একাধিক গবেষণাপত্র বিশ্বের নামী জার্নালগুলিতে প্রকাশিত হয়। কথা হচ্ছে এর পরেও যদি রাষ্ট্রের ঘুম না ভাঙে, তবে তা হবে আরও দুর্ভাগ্যের।

বিজ্ঞান-চর্চার সুযোগ মানে যে স্রেফ এআই-এর পাঠক্রম খুলে দেওয়া নয়, বিজ্ঞান-গবেষণা ও গবেষক উভয়েরই সামগ্রিক ও সযত্ন লালন, বুঝতে হবে সবার আগে।২০২১ সালে মাধ্যমিক-উত্তীর্ণদের মাত্র ১০ শতাংশ (৮০ হাজার) বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে আবার গণিত-সহ বিজ্ঞান পড়তে চায় মাত্র ২০ হাজার ছাত্রছাত্রী। গণিতে অনীহার কারণগুলি খুঁজে বার করার দায়িত্ব কি রাজ্য শিক্ষা দফতরের নয়? সামাজিক অসাম্যের প্রশ্নও ওঠে। গণিত-সহ বিজ্ঞানে ভাল নম্বর পাচ্ছে যারা, তাদের কত শতাংশ গ্রামের ছেলেমেয়ে? গ্রামাঞ্চলের কতগুলো সরকারি স্কুলে নতুন করে বিজ্ঞান-শাখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে? বিজ্ঞান-শিক্ষকের অভাবে কতগুলো স্কুলের বিজ্ঞান শাখার অনুমোদন বাতিল হয়েছে? কতগুলো স্কুলে নতুন করে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি তৈরি হয়েছে?উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ, পড়াশোনার খরচ। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাইলে আগে চাই ভাল প্রাইভেট টিউটর। কিন্তু কেন? আর যদি বা বিজ্ঞান-শিক্ষার খরচ বেশি হয়, স্কলারশিপের ব্যবস্থা কি করা যায় না?চারটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে শিক্ষাব্যবস্থা, সিলেবাস, পাঠ্যবই, শ্রেণিকক্ষের অনুশীলন, মূল্যায়ন ব্যবস্থা।

বিজ্ঞান-শিক্ষকদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস সর্বভারতীয় সিলেবাসকে অনুসরণ করে তৈরি হলেও, রাজ্যের নবম-দশম শ্রেণির সিলেবাসের সঙ্গে একাদশ-দ্বাদশের সিলেবাসের বিস্তর দূরত্ব। সিবিএসই বা আইসিএসই বোর্ড তাদের সেকেন্ডারি সিলেবাস, শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি যতটা উচ্চ মাধ্যমিক সিলেবাসের মূল্যায়ন পদ্ধতির কাছাকাছি আনতে পেরেছে, এ রাজ্যে সে দিকে অনেকটাই ফারাক থেকে গিয়েছে, বিশেষত বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে। অনেকে মনে করছেন, মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক নম্বর বাড়ানোর দিকেই জোর থাকছে বেশি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত শিখন-দক্ষতা (লার্নিং আউটকাম) কতটা তৈরি হচ্ছে, সে দিকে নজর থাকছে না। যার ফলে দেখা যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাসের অভাব, উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার অনীহা।
শিশু-কিশোর মননে কতটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হল, যা প্রতিফলিত হতে পারত জাতির জীবনে— তা কে ভাবছে? বিজ্ঞান-শিক্ষার সুফল পেল কি তারা, না কি অন্ধ উপভোক্তার মতো ইন্টারনেট আসক্তিতেই মগ্ন রইল?সেই অন্যমনস্কতা, উপেক্ষার সুযোগে বিজ্ঞান-শিক্ষার পরিসর সঙ্কুচিত হচ্ছে।২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলে বিজ্ঞান শাখায় পড়ুয়ার সংখ্যা যেখানে তিন লক্ষ, ২০২৪ সালে সেই পড়ুয়ার সংখ্যা কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে এক লক্ষে (১,০৫,৮১০)। রাজ্যের কলেজগুলোতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিদ্যার মতো বিষয়ে ‘সিট’ ফাঁকাই পড়ে থাকছে।

গোটা দেশের ছবিটাও আশাজনক নয়— দশম শ্রেণির পর মোট পড়ুয়ার মাত্র ১৫-১৭ শতাংশ ভর্তি হচ্ছে বিজ্ঞান শাখায়। ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে বিজ্ঞান-শিক্ষায় পড়ুয়াদের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ রাজ্যের স্কুলগুলির প্রধানদের চিঠি পাঠিয়ে আবেদন করে, ক্লাসে বিজ্ঞান-শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো হোক। তাতে কাজ হয়নি। ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রী কলাবিভাগ থেকেই বেশি। আর বিজ্ঞানমনস্কতার কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। আবাল বৃদ্ধ বনিতা এখনও বগলামুখী কবজেই পড়ে আছে। শরীরে পশ্চিমি পোশাক, হাতে,কানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রাদি, কিন্তু কোমরে বা হাতে রয়েছে মন্ত্রপূত মাদুলি, এ দৃশ্যে আমরা এতটাই অভ্যস্থ হয়ে গেছি যে এই অভূতপূর্ব বৈপরীত্য আমাদের মনে কোনও প্রশ্নের জন্ম দেয় না। দৃশ্য মাধ্যম ছেয়ে গেছে জ্যোতিষী আর তন্ত্রসাধকদের বিজ্ঞাপনে। যে শহরের চার মাথার মোড়ে শোভা পায় ভাগ্য ফেরানোর জন্য আসল গ্রহরত্নের বিশাল বিজ্ঞাপন,সেই শহরই আবার বিজ্ঞান চর্চার সেরার মুকুট জয় করে, এই অসম্ভব দ্বান্দ্বিকতার আরেক নামই হয়ত কলকাতা।