• facebook
  • twitter
Thursday, 18 December, 2025

শুধু একটা স্নান! তাতেই সব পাপ মুক্তি?

কথাটা হচ্ছিল ১৪৪ বছরের পুণ্যস্নানে গিয়ে অনেক পুণ্যার্থীর প্রাণ যায় পদপিষ্ট হয়ে। সে বিষয়ে ধরে নেওয়া গেল যাঁরা চলে গেলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই মোক্ষ লাভ করেছেন।

ফাইল চিত্র

কবিতা মুখোপাধ্যায়

শুধু একটা স্নান, তাও আবার দূষণযুক্ত জলে আর তাতেই সব পাপ থেকে মুক্তি এবং মোক্ষ লাভ! সত্যি বিষয়টা ভাবাচ্ছে। বিশেষ করে একটু ভাবতেই হল যখন গত ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার মুখে স্থানীয় শনি মন্দিরের সামনে দেখা হল দূরের এক প্রতিবেশীর সঙ্গে। এক অঞ্চলের বাসিন্দা তাই প্রতিবেশী, কিন্তু এক পাড়া অবশ্যই নয়। মানুষটি আমাকে দেখে এগিয়ে এসে একগাল হেসে বলেন— ‘দিদি, কুম্ভ স্নান করে এলাম। স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম।’ তাঁর মুখে-চোখে তৃপ্তি, পুণ্যস্নানের আবেগে একেবারে আপ্লুত। শুনে বললাম, তবে তো অনেক পুণ্য করে এলেন।মানুষটি বৈষ্ণব, বিনয় ওদের স্বভাবগত। —না… না… ও কথা বলতে নেই। মানুষটি আমায় এও জানালেন যে ওঁদের পাড়ার আরেকজন, যাঁকে আমিও চিনি, সে পরের দিন দলবল নিয়ে শেষ শাহী স্নানের জন্য রওনা হবেন। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল ধর্ম মানুষের চোখে কতটা আবরণ দিয়ে দেয় যে এই এক অস্ত্রেই বধ হয়ে যায় বহু মানুষের মন-প্রাণ। প্রাসঙ্গিক ভাবেই মনে পড়ছিল জন্মাষ্টমীর সময় এঁদের পাড়াতেই ৬-৭ দিন ধরে কৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে বিরাট নাম-কীর্তন হয়ে থাকে। এর জন্য বহু অর্থ ব্যয় হয়। বহু মানুষ এদের প্রচুর অর্থ সহ চাল-ডাল-সবজি দিয়ে থাকেন। অথচ এঁদেরই ঘরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় সাহায্য করতে চেয়ে এদের কাছে কিছুটা সহযোগিতা চেয়ে এঁদের কাছে কিছুটা সহযোগিতা চেয়েছিলাম, সাহায্য পাইনি। খুব খারাপ লেগেছিল— ধর্মের জন্য অর্থ আছে, শিক্ষার জন্য অর্থ নেই। যদিও শুধু সহযোগিতা, তা দিতেও তাঁরা অগ্রসর হতে চাননি। আসলে এদেশে সমাজকল্যামের কাজে মানুষের তেমন প্রসারিত চিন্তা-ভাবনা নেই। অধিকাংশ মানুষেরই ভাবনা সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনের দায় একমাত্র সরকারেরই। কিন্তু যদি প্রতিটি সক্ষম নাগরিক একটু করে হাত বাড়িয়ে দেন, তবে অনেক কল্যাণকর কাজ সাফল্যের মুখ দেখতে পারে। থাক সে বে-হিসাবী ভাবনার কথা। বলছিলাম কুম্ভ স্নানের পুণ্যের বিষয়ে।

Advertisement

২০২৫-এর জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ, সবার চোখ ছিল ‘পূর্ণকুম্ভ’ ইভেন্টে— ১৪৪ বছর পরে এই পুণ্য যোগ এসেছে। এই কুম্ভে যাঁরা পুণ্য স্নানে মোক্ষ লাভ করতে পারেননি, (সে দলে আমিও আছি) তাদের কোনও দুঃখ করতে হবে না, কেননা এই পুণ্য যোগ আসবে ২০২৯-এ। কী ভাবছেন? এর মধ্যে ১৪৪ বছর পূর্ণ হবে কী করে? হয়… হয়…। গল্পের গরু গাছে উঠতে পারলে, মানুষের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতে ২০২৯-এ ১৪৪ বছরের পূর্ণ কুম্ভের পুণ্য যোগ আসবে না? দেশের মানুষের পুণ্যের জন্য দেশের মহান নেতারা এটুকু আয়োজন করতে পারবেন না, তাও কি কখনও হয়?
মহাভারত-পুরাণ অনুসারে সমুদ্র মন্থনে উঠে আসে ‘অমৃত’ চলকে পড়েছিল যে চারটি জায়গায়, সেখানেই কুম্ভ সংগঠিত হয়। এমনও কথা আছে, এই চারটি জায়গাতে সেখানেই কুম্ভ সংগঠিত হয়। এমনও কথা আছে, এই চারটি জায়গাতে ডুব না দিলে ‘কুম্ভস্নান’ সম্পূর্ণ হয় না। আর মনুষ্য জন্মও সার্থক হয় না। তা সে নয় ডুব দিয়ে নেওয়া গেল। কিন্তু এ বছরের ১৪৪ বছরের যে যোগ এসেছিল, সেটা কতটা সঠিক সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেল। প্রশ্ন তুললেন অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিরা এবং এ নিয়ে বিতর্কও থেকে গেল। তা সে যে কথাই উঠুক না কেন, অনেক প্রাণের মূল্যে আমরা পুণ্য অর্জন করেছি তা সে রাস্তায় দীর্ঘ ঘুমহীন, খাদ্যহীন অমানবিক যাত্রাই হোক, বা গঙ্গার জলের দূষণ মাত্রাছাড়াই হোক, বা খুব সাধারণ মানুষের জন্য আশ্রয়ের কোনও ব্যবস্থা ছাড়াই, তবু মানুষ অন্ধের মতো ছুটে গেছেন পুণ্য স্নানের মোক্ষ লাভের আশায়। অথচ কুম্ভ স্নান তো এদেশে নতুন নয়। আবাল্য শুনে আসা দেশের চারটি স্থানে যে আয়োজন চলে আসছে আবহমান কাল ধরেই। যেমন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্নানের আয়োজন হয়ে থাকে গঙ্গাসাগরে। পাহাড় থেকে নমে গোটা দেশকে স্পর্শ করে যে গঙ্গা এসেছে মিলেছে সাগরে তার গুরুত্ব বা মাহাত্ম্য কোনওটাই কি অস্বীকার করার? পাহাড় থেকে গঙ্গাকে উদ্ধার করে সমতলে নিয়ে আসার কাহিনি ভারতবাসী মাত্রেই জানেন, আর এই কপিলমুনির মন্দির (যা বহুবার সাগরে নষ্ট হয়ে গেছে) তার ঐতিহ্য কি বলা যায় না— ‘হেরিটেজ’ স্থান?

Advertisement

কথাটা হচ্ছিল ১৪৪ বছরের পুণ্যস্নানে গিয়ে অনেক পুণ্যার্থীর প্রাণ যায় পদপিষ্ট হয়ে। সে বিষয়ে ধরে নেওয়া গেল যাঁরা চলে গেলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই মোক্ষ লাভ করেছেন। ধনী-দরিদ্র সমস্ত মানুষই প্রায় দু’মাস ধরে হ্যামলিনের বাঁশির ডাকে ডুব দিয়েছেন কুম্ভে। তবে এদের মধ্যে যে কতজন সঠিক জায়গায় ডুব দিতে পেরেছিলেন, সেটা বলতে পারা আর লটারিতে কোটি টাকা লাভ প্রায় সমার্থক।

কুম্ভ স্নান নতুন কোনও ঘটনা নয়, যেমন নয় গঙ্গাসাগরে স্নান। আবাল্য শোনা অর্ধ কুম্ভ এবং পূর্ণ কুম্ভর কথা বহুল প্রচলিত। এখন বহু মানুষের পুণ্য স্নানের সুবিধার জন্য সেখানে স্থানীয় প্রশাসন যাতায়াতের ব্যবস্থা, থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এগিয়ে আসেন বিভিন্ন আখরাগুলোও. তবে প্রহসন তখনই হয়, যখন গল্পের গরুকে গাছে তুলে দিতে যে সত্য-মিথ্যা বিজ্ঞাপনের ঢাক পেটানো হয়, সেটাই সৃষ্টি করে অসহায় মৃত্যুর ঘটনা। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’। তার কারণ গঙ্গাসাগরে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই, আছে শুধু জলপথ। এখন অবশ্য তৈরি হচ্ছে ব্রিজ। তবু সব বাধাকে অতিক্রম করেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ গঙ্গাসাগেরে আসেন। তবু এই মেলা ‘জাতীয় মেলা’র স্বীকৃতি পায়নি আজও। কুম্ভতে যত অর্থ ব্যয় করা হয়, তার সামান্য কিছু টাকা পেলে এখানকার ব্যবস্থা আরও সুগম হতে পারে। গহ্গাসাগরের গুরুত্ব একেবারেই আলাদা। কেননা এখানেপাহাড় থেকে বার হয়ে গঙ্গা মিসেছে সাগরে। এর তাৎপর্যই আলাদা।

হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল। ২০২৫ দেখল ১৪৪ বছর পরে পূর্ণকুম্ভের ধামাকা। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী এমন ডাক দিলেন যে দেশের অতি প্রত্যন্ত প্রান্তের দিন আনে দিন খায় মানুষটিও লোটা-কম্বল সম্বল করে শীতের ছোবলকে উপেক্ষা করে উঠে বসলেন ট্রেনে। তারপর‘ খাদ্যহীন, আশ্রয়হীন, সহায়তাহীন মানুষগুলি পুণ্যস্নানে ডুব দিলেন। কিন্তু ডুবটা যে কোথায় দেওয়া গেল, সে বিচারে কাজ নেই। ইতিমধ্যে ঘটে গেল পদপৃষ্ট হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু। মৃত্যু ঘটলো দিল্লি রেল স্টেশনেও। যে অমানবিক পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষগুলির প্রাণ গেল, তাঁদের শেষ পরিণতি হল— অবহেলা ও অসম্মান। মৃত্যুর কোনও শংসাপত্র ছাড়াই দেহগুলিকে পরিবারের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। সচেতনভাবেই কোনও পোস্টমর্টেম করা হয়নিষ দেওয়া হয়নি মৃত্যুর শংসাপত্র, যা ভবিষ্যতে দাবিকরতে পারে ক্ষতিপূরণের। বিস্ময়ের এটাই যে, সমস্ত সরকারি বিজ্ঞাপন, যা এই অতি সাধারণ মানুষগুলিকে এতটা উন্মত্ত করে তুলেছিল তার দায় কি উত্তরপ্রদেশ সরকার বা কেন্দ্র সরকার নিয়েছে?

এত মৃত্যুর দরকার ছিল না, যদি একটি মৃত্যু ঘটত বা কোনও মানুষ আহত হতেন, অথবা কোনও বিশৃঙ্খলা ঘটত পশ্চিমবঙ্গের কোনও উৎসবে বা মেলায়, তবে কিন্তু চিত্রটা অন্যরকম হত। প্রথমেই ছুটে আসত জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন, তার পিছনে মানবাধিকার কমিশন, এরপর জাতীয় মহিলা কমিশন। এতেও রেহাই পেত না এই রাজ্যটি। প্লেনে চেপে চলে আসতেন কেন্দ্রীয় সরকারের দলীয় সাংসদদের টিম। যারা ঘুরে গিয়ে রিপোর্ট পেশ করত দলীয় সভাপতির কাছে, অবশ্যই পরামর্শ থাকত ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের। এতেও রাজ্য প্রশাসন ছাড় পেত, তা নয়। ঘটনা ঘটার ১ ঘণ্টার মধ্যে রাজভবন থেকে রিপোর্ট তলব করা হত, আর এর উপরে খাড়া নেমে আসত শীর্ষ আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত মামলা। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে প্রয়াগরাজে। তাই চিত্রনাট একেবারে মনের মতো, বরং পূর্ণ কুম্ভের অসাধারণ সাফল্যের জন্য সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী গাইলেন পূর্ণ কুম্ভের আয়োজনের অসাধারণ সাফল্যের গল্প।

আসলে সাধারণ মানুষ যতদিন না সচেতন হচ্ছেন যে, গঙ্গার ওই দূষিত জলে স্নান করে কোনও পুণ্য, কোনও মুক্তি লাভ হয় না। তাছাড়া মহাভারতের কালে ঘটে সমুদ্র মন্থনে উঠে আসা অমৃত চলকে পড়েছিল নাসিক, প্রয়াগ, উজ্জ্বয়নী এবং হরিদ্বারে, সে অমৃত কি আজও সেখানে অবশিষ্ট আছে, এ কথা কি মান্যতা পায়? সে তো নদীর প্রবাহে ভেসে গেছে কবেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের বোধদয় হচ্ছে, ততক্ষণ এ ধরনের রাজনৈতিক প্রহসন চলতে থাকবেই।

কুম্ভ অর্থ সমস্ত অকল্যাণ দূর করে সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণ সাধন এবং মানুষের মধ্যে শুভবোধ জাগ্রত করা। তাই যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনুগ্রহ করে রাজনৈতিক রং লাগাবেন না। শুধু সেটুকু করুন, যেটুকুতে উৎসবটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে। সর্বক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন থাকুক নীরব সহযোগী হিসেবে ভোটের ডিভিডেন্ড বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে নয়। একজন নাগরিক হিসেবে সব দলের কাছে এটাই একমাত্র অনুরোধ।

Advertisement