‘শিক্ষার সুযোগ স্বল্প, তবুও তোষণের অভিযোগ?’ শিরোনামে সাবির আহমেদ-এর একটি উত্তর সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ হয়েছিল কলকাতার একটি নামী বাংলা দৈনিকে। উল্লেখ্য, সাবির আহমেদ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত প্রতীচী ট্রাস্টে কর্মরত। ইতিপূর্বে তাঁর একাধিক প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ হয়েছে এবং সেসব প্রতিবেদনের বাস্তবতা নিয়ে কখনও প্রশ্ন ওঠেনি একথা বলাইবাহুল্য। ক্ষেত্র সমীক্ষার রিপোর্ট সাধারণতঃ ভ্রান্ত হয় না, যদি না তার সঙ্গে প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত বদ্ধমূল ধারণা বা মতামত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়! আলোচ্য প্রতিবেদনটি পড়ে মনে হয়েছে, পরিসংখ্যানের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে পোষণ করা কিছু ভ্রান্ত ধারণারও সংমিশ্রণ ঘটেছে। ফলে প্রতিবেদনটি কোনওভাবেই যথার্থ হয়ে ওঠেনি।
আলোচ্য নিবন্ধের শিরোনামের মধ্যেই ভ্রান্তি স্পষ্ট। কীরকম সে ভ্রান্তি? ‘শিক্ষার সুযোগ’-এর সঙ্গে ‘তোষণের অভিযোগ’-এর আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি? বিষয়টি একটু বিশদভাবে বলা যাক। না হলে প্রিয় ও প্রাজ্ঞ পাঠকের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে যাবে। নিরপেক্ষ আলোচনার ক্ষেত্রে খোলাখুলি মত বিনিময় একান্তভাবেই দরকার এবং সম্প্রদায়গত সংকীর্ণ মানসিকতাকে আপাত মুলতুবি রাখাটাও বিশেষভাবে জরুরি। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এই ব্যাপারগুলিই কোনও নিরপেক্ষ আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়াটা অনুচিত। কারণ বিশেষ কোনও ‘ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে নয়, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদের বিবেচনা করে, তাদের উন্নয়নের জন্যে অবিলম্বে নীতি নির্ধারণ জরুরি।’ সাবিরের এই কথাগুলির যথার্থতা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
Advertisement
প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে, সাবিরের পেশ করা পরিসংখ্যানে কোনওরকম ভুল-ত্রুটি নেই। তবে একইসঙ্গে একথাও ঠিক যে, বিগত শুধু তিন বছরেই নয় এবং এ রাজ্যে উচ্চশিক্ষাতেও শুধু নয়, প্রাথমিক শিক্ষাতেও মুসলমানদের অংশগ্রহণ অপেক্ষাকৃত কম। শিক্ষায় এই কম অংশগ্রহণের পিছনে শুধুই কি মুসলমান সম্প্রদায়ের দারিদ্র্যই দায়ী? তাদের সাবেকি সংস্কার, মন-মানসিকতা কোনওভাবেই দায়ী নয়? জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দারিদ্রতা গ্রামের সিংহভাগ প্রান্তিক মানুষের মধ্যেই ছিল এবং এখনও আছে। সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না হলে আগামীদিনেও এসব থাকবে একথা বলাইবাহুল্য। তবুও অন্য সম্প্রদায়ের মোটা অংশের মানুষ নিজেদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে আগ্রহ দেখান, তা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম।
Advertisement
নিরপেক্ষ আলোচনার খাতিরে স্বীকার করতেই হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের সিংহভাগ মানুষ যদি সাবেকি সংস্কার ও গোঁড়ামি করে প্রাচীন টোল-প্রথার শিক্ষা আঁকড়ে থাকতেন, তাহলে সংস্কৃত আর ধর্মীয় পাঠের শিক্ষা নিয়ে হিন্দুঘরের ছেলেমেয়েরা আজকের প্রযুক্তি-অধ্যুষিত সভ্যতায় কোথায় কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতেন? যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষা বা পাঠ না নিলে এই তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে টিঁকে থাকাই দায়! তাই গোঁড়ামী দু’পায়ে মাড়িয়ে হিন্দুরা আধুনিক শিক্ষাগ্রহণে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। তুলনামূলকভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও অনেকটাই পিছিয়ে, এ কথা কি কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায়? তাই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার চেয়ে মাদ্রাসা (যেসব মাদ্রাসায় কেবল ধর্মীয় শিক্ষাদান করা হয়) শিক্ষার দিকে ঝোঁক এখনও অপেক্ষাকৃত বেশি!
রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রক উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বেছে বেছে মুসলমান অধ্যুষিত জেলাগুলিতে দূরে দূরে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছে এমন অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। এ রাজ্যের অনেক জেলার গ্রামগুলিতেই স্কুল-কলেজ অনেকটাই দূরে। ফলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদেরই শিক্ষালাভের জন্য বহুপথ পায়ে হেঁটে কিম্বা সাইকেল-বাসে অতিক্রম করে দূরের স্কুল-কলেজে পৌঁছতে হয়। এই প্রাত্যহিক কষ্ট যাঁরা ভোগ না করেছেন, তাঁদের পক্ষে তা উপলব্ধি করা সত্যি খুব কঠিন। তবে সত্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হয় যে, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ যদি এই কষ্ট স্বীকার করে শিক্ষালাভে এগিয়ে আসতে পারেন, তো মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ পারবেন না কেন? যদি না পারেন, তো সে দোষ সম্প্রদায়গতভাবে অন্যের কাঁধে চাপানো ঠিক কি?
পুরুলিয়া, দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম সহ দুই চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষেরা বহু কষ্ট স্বীকার করে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করান। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোরাঘুরির অভ্যেস থাকায় দেখেছি, কিভাবে ঝড়-বৃষ্টি-রোদ উপেক্ষা করে ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে বহু দূরের স্কুলে হাজির হয়! কোথাও চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে, কোথাও-বা দশ-বারো কিলোমিটার সাইকেল, কিম্বা অন্য যানবাহনে চেপে তাদের স্কুল-কলেজে যেতে হয়। কলকাতা শহর বা শহরতলিতে বসে এসব কষ্টের কথা সঠিক বোঝা যায় না। তবুও গ্রাম-গঞ্জের প্রান্তিক মানুষ তাঁদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে পড়াশুনার জন্য এগিয়ে দেন। কারণ তাঁরা এটুকু বুঝেছেন, শিক্ষা ছাড়া দরিদ্র পরিবারের আর্থিক উন্নতির বিকল্প কোনও পথ নেই।
প্রতিবেদক সাবির আহমেদ ঠিকই বলেছেন যে, ‘সমাজ কাঠামোতে শহরের আধিপত্যের ফলে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলি বেশিরভাগ শহরকেন্দ্রিক। রাজ্যের মুসলমানদের বেশির ভাগই গ্রামে থাকে।’ তবে গ্রাম-গঞ্জে শিক্ষা-সংক্রান্ত সমীক্ষার কাজ করা সাবির এটাও নিশ্চয়ই মানবেন যে, শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষই নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষও গ্রামেই থাকেন। কারণ কলকাতা শহর ও শহরতলিতে যত লোক থাকেন, তার প্রায় পাঁচগুণেরও বেশি লোক থাকেন রাজ্যের গ্রাম-গঞ্জে এবং স্বভাবতই উভয় সম্প্রদায়ের সিংহভাগ মানুষের আবাসস্থলই গ্রাম-গঞ্জ। জনবসতির ক্ষেত্রে এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের চালচিত্র নয়, গোটা ভারতেরই সামগ্রিক চালচিত্র। সুতরাং, মুসলমান সম্প্রদায়ের অশিক্ষার জন্য ‘গ্রামে থাকাটাই একমাত্র কারণ নয়। আরও অনেক কারণই এজন্য দায়ী এবং সে কারণগুলি নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ না করলে সমস্যার জট-জটিলতা কাটিয়ে সমাধানে পৌঁছনো কখনও সম্ভব নয়। অন্যকে দোষারোপ করার আগে নিজেদের অসচেতনতা, ধর্মীয় সংস্কার ও গোঁড়ামি সহ অন্যান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। সমস্যার প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করে তার দ্রুত সমাধানটাই আসল ব্যাপার। সমস্যার জন্য অপরকে দোষারোপ না-হয় পরে করা যাবে। কিন্তু সমস্যা হ’ল, আমরা অন্যের দোষ-ত্রুটি ধরতেই বেশি আগ্রহী, বেশি ব্যস্ত, নিজেদের দোষ-ত্রুটি কখনও সেভাবে দেখার প্রয়োজনবোধ করি না। এটা বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের নয়, মনুষ্য প্রজাতিরই এক মস্তবড় ত্রুটি। আর একথা তো ঠিক যে, নিজেদের দোষ-ত্রুটি না দেখলে তার সমাধানও সম্ভব হয় না। আসল ট্র্যাজেডি বোধহয় এখানেই।
সত্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হয় যে, মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনেরা ধর্মীয় বিষয়ে যতটা আগ্রহী ও সরব, নিজেদের সম্প্রদায়ের পিছিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা প্রসারে ততটা নন। সময়ের প্রেক্ষাপটে শিক্ষায় সারা রাজ্যে হাতে-গোণা দু’একটা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাঁরা ক’টা মিটিং-মিছিল-সেমিনার-সমাবেশ করেন? প্রতিষ্ঠানগতভাবে (আল-আমিন মিশন, জিডি অ্যাকাডেমি, স্ন্যাপ) ছাড়া আর কারা মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষাবিস্তার নিয়ে কাজ করেন? বিশ্বের ‘ধর্মপ্রাণ মুসলিম দেশগুলি এদেশের মাদ্রাসা-মসজিদ নির্মাণে দান-অনুদান করেন, কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের অনগ্রসর ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুল-কলেজ-হস্টেল নির্মাণের জন্য দান করেন না। সাবির আহমেদ এই প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি নিয়ে তাঁর প্রতিবেদনে কিছুটা আলোকপাত করলে বরং ভালো হতো।
রাজ্যের গ্রামে-গঞ্জে তথা প্রান্তিক অঞ্চলে পড়াশুনায় না-হয় অসুবিধে আছে, আছে নানাবিধ প্রতিকূলতা। কিন্তু খোদ কলকাতা মহানগরের পার্কসার্কাস – রাজাবাজার-খিদিরপুর – ওয়াটগঞ্জের কতভাগ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের ছেলেমেয়েদের এখনও নিয়মিত স্কুল-কলেজে পাঠানোর আগ্রহ বা প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন? কলকাতার মধ্যে উল্লেখিত জায়গাগুলিতে তো স্কুল-কলেজ বাড়ির একেবারে দোরগোড়ায়! পায়ে হেঁটেও স্কুলে পৌঁছনো যায়। তা সত্বেও কেন স্কুল-কলেজের কাঠগোড়ায় পা রাখে না তাঁদের সিংহভাগ ছেলেমেয়ে? কিম্বা অভিভাবকেরাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠানোর তেমন তাগিদ বোধ করেন না? বিষয়ের গভীরে না ঢুকে দায়সারা প্রতিবেদন লিখে কোনও সম্প্রদায়েরই প্রকৃত কল্যাণ বা মঙ্গলসাধন করা যায় না একথা বলাই বাহুল্য।
তবে একথা ঠিক যে, কলকাতা মহানগরে উচ্চশিক্ষার জন্য আসা বাইরের মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের থাকার সমস্যা আছে। হাতে-গোনা যে ক’টি হস্টেল কলকাতায় আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। সময়ের দাবি মেটাতে এ বিষয়ে আগেভাগেই রাজ্য সরকারের নজর দেওয়া দরকার ছিল। কারণ আমরা বাইরে অনেকটা চকচকে হলেও মন-মানসিকতায় আসল চকচকে হতে পারিনি। তাই হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ঘর ভাড়া পাওয়া সত্যিই মুশকিল। অনেকেই মুসলমানদের ঘর-ভাড়া দিতে এখনও অনিচ্ছুক। এই অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা কোনওভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা কথা-বার্তা, বেশ-ভূষায় আধুনিক ও উন্নত হলেও মন-মানসিকভাবে উন্নত হইনি। আমরা অনেকেই মুখে প্রগতিশীল হলেও সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
আমাদের চলার পথে, চারদিকে মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদ্বার মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেও মানুষের বেঁচে থাকার পক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটুকুর আজও প্রচণ্ড অভাব। কলকাতার কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পাঠরত কলকাতার বাইরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় হস্টেল এখনও গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা অপেক্ষাকৃত বেশি। একই কথা কলকাতায় কর্মরতা মহিলাদের সম্পর্কেও ভীষণভাবে প্রযোজ্য। এই দিকটা বরাবরই অবহেলিত থেকে গিয়েছে এবং তার মাশুল গুনছেন কলকাতার বাইরের ছাত্রছাত্রী ও কর্মরতা মহিলারা। মুসলমান সম্প্রদায়ের জনপ্রতিনিধি কিম্বা বিশিষ্টজনেরাও বিষয়টি নিয়ে কখনও জোরালো দাবি জানাননি। রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরও এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বোধ করেনি।
প্রসঙ্গত, কলকাতা মহানগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে সম্পত্তির পরিমাণ তো কম নয়। সেই দান করা বা দাবিহীন বিশাল সম্পত্তির কিছু অংশ থেকে বাইরে থেকে পড়তে কিম্বা চাকরি করতে আসা মুসলমান ছাত্রছাত্রী ও কর্মরতা মহিলাদের জন্য কয়েকটি মেস ও হস্টেল অনায়াসেই নির্মাণ করা যেতো। কিন্তু এই অতি-প্রয়োজনীয় বিষয়ে এ যাবৎ কেউ নজরই দেননি! যাঁরা সংখ্যালঘুদের জন্যে অনবরত চোখের জল (প্রচলিত কথায় ‘তোষণ’) ফেলতে অভ্যস্থ— তাঁরাও দীর্ঘকাল এ রাজ্যে নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতা ভোগ করে গেলেও সমস্যাটি নিয়ে মাথা ঘামাননি। আসলে সবকিছু ভোটের হিসেবে বিচার করলে যা হয় আর কি! মতবাদ বা রাজনীতি নির্বিশেষে শাসকদল সংখ্যালঘুদের ভোটার ছাড়া আর কিছু ভাবতেই চান না।
আর এখানেই হ’ল মুশকিল। সমস্যাও জট বেঁধে আছে ঠিক এখানেই। শাসক কিম্বা রাজনীতিকরা তাঁদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে নিজেদের চিন্তাচেতনার প্রসারতা না ঘটাতে পারলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কোনও সম্প্রদায়েরই প্রকৃত কল্যাণসাধন করা সম্ভব নয়। সবার আগে রাজনীতিক বা শাসকদের ভোট-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল চাই। এই প্রয়োজনীয় বদল ঘটাতে না পারলে কোনও ইতিবাচক কাজ করাই সম্ভব নয়। শুধু আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আর ‘তোষণ’ করে সংখ্যালঘুদের প্রকৃত উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের শুধু ভোটার নয়, দেশের সম্মানিত নাগরিক অর্থাৎ মানুষ হিসেবে দেখার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে ভোটমুখী রাজনীতিকদের। না হলে সবটাই মাটি হয়ে যাবে।
সাবির আহমেদ তাঁর প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘রাজ্যের মুসলমানদের ৮০ শতাংশ পরিবারের আয় পাঁচ হাজার টাকার নীচে। অন্যদিকে উচ্চ-শিক্ষায় ক্রমশঃ ফি বৃদ্ধি ও বেসরকারিকরণের ফলে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের কাছে উচ্চশিক্ষা অধরা।’ আর্থিক অস্বচ্ছলতা এখনকার ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তরায় নিঃসন্দেহে। তবে রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়েরই শুধু নয়, সব সম্প্রদায় নির্বিশেষেই গ্রামের প্রান্তিক মানুষের গড়-পড়তা মাসিক রোজগার বা আয় পাঁচ হাজার টাকারও অর্ধেক! রাজ্যের গ্রামীণ পরিবারগুলির সামগ্রিক আর্থিক চালচিত্রই এরকম। যাঁরা এ বিষয়ে বছরভর কাজ বা সমীক্ষা করছেন, তাঁরা বিষয়টি স্বীকার করবেন নিশ্চিত। তবুও তো গ্রাম-গঞ্জের নিম্ন আয়ের ‘দিন-আনি-দিন-খাই’ মানুষেরা তাঁদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি করছেন।
প্রতিবেদক সাবির আরও বলেছেন, ‘আর্থিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা যে ভবিষ্যতে রুটিরুজি জোগানোর ব্যবস্থা করতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা না থাকার কারণে উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমছে (২০১৫-১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রী মাত্র ৭.৬৫ ভাগ)।’ কথাটি আংশিক ঠিক, সবটা অবশ্যই নয়। তবুও তো ভবিষ্যতে রুটিরুজি জোগানোর ব্যবস্থা করতে পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা না থাকলেও জেনারেল কাস্ট-এর ছাত্রছাত্রীদের ৬৯.৫৮ ভাগই (২০১৫-১৬) কিন্তু এখনও উচ্চশিক্ষায় নিজেদের সম্পৃক্ত করছে! ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে কেন? ‘চান্স অ্যান্ড প্রবাবিলিটি’ তত্ত্ব মেনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেবে না কেন তারা? উচ্চশিক্ষায় মুসলমান সম্প্রদায়ের যোগদান না থাকলে ভবিষ্যতে রুটিরুজি জোগানোর ব্যবস্থা যে পুরোটাই বন্ধ হয়ে যাবে!
শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ওবিসি হিসেবে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুযোগ আছে এবং সেকথা সাবিরও স্বীকার করছেন তাঁর নিবন্ধে। কিন্তু ভর্তির মরশুমে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নাকি ‘সংরক্ষণের নিয়ম নীতিকে কার্যতঃ বুড়ো আঙুল দেখায়!’ এমন অভিযোগ উঠেছে! অভিযোগের সত্যতা কতখানি তা নিজের চোখে না দেখে এমন অসার অভিযোগ তোলা বোধহয় ঠিক নয়। বাম-ডান কোনও আমলেই ভর্তির মরশুমে রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন অনৈতিক আচরণ করেন বলে কেউ অভিযোগ করেননি। কোন অভিযোগের ভিত্তি কতটুকু আগে তা যাচাই করে নেওয়া কোনও সমীক্ষক-প্রাবন্ধিকের প্রাথমিক কর্তব্য নয় কি! যাচাইয়ের পরই তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করলে ভালো হয়। নাহলে ভুল বার্তা দেওয়া হয়।
Advertisement



