স্বপনকুমার মণ্ডল
রাত পোহালেই চ্যানেলে চ্যানেলে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে এসএসসি-র মামলা নিয়ে ব্রেকিং নিউজ শুরু হয়ে যাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এসএসসি-র ২০১৬-র নিয়োগ নিয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিচার এখনও শেষ হয়নি, তার রায়ও মুলতবি থেকে যাওয়ার অনিশ্চয়তার ঘনঘোর অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে। বিগত বছর থেকে চলা মামলাটি এ বছর ৭ জানুয়ারির পর আবার ১৫ জানুয়ারিতেও নিষ্পত্তি ঘটেনি। আগামীকাল ২৭ জানুয়ারি তার রায় দানের প্রতীক্ষায় তাকিয়ে আছে তীব্র সংকটে পড়া অসংখ্য ভুক্তভোগী মানুষ । এদিকে অনিশ্চিত জীবনের গভীর উৎকণ্ঠায় চাকরি প্রার্থীরা, শিক্ষানুরাগীদের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। আসলে এসএসসি-র মাধ্যমে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগের চূড়ান্ত দুর্নীতির রায় নিয়ে চাকরি প্রার্থীদের মতো রাজ্যের শিক্ষানুরাগী মানুষ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিকে অধীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ইতিমধ্যেই বিগত বছরের শেষের দিকে ১৯ ডিসেম্বরে যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করার অসম্ভবতায় গোটা প্যানেলটাই বাতিলের কথা ডিভিসন বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতিদ্বয়ের কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠায় স্বাভাবিকভাবেই যোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে জীবনে সর্বস্বান্ত হওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের অবৈধভাবে নিয়োগের জন্য বিপুল সংখ্যক চাকরি বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে প্রথমে তা স্থগিত হওয়ায় যেমন অবৈধ পথে চাকরি পাওয়াদের মধ্যে কিছু না হওয়ার খুশির হাওয়া বইতে থাকে, তেমনই যোগ্যদের মনে সুবিচারের আশাও জেগে ওঠে। সেক্ষেত্রে যোগ্যদের মধ্যে যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল, যোগ্য-অযোগ্যদের বিভাজনের অসাধ্যতায় বিচারপতিদ্বয়ের আগাম বক্তব্যে তাও অচিরে মিলিয়ে যায়। অন্যদিকে যোগ্য চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়ানো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে যেভাবে প্রথমদিকে প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছিল,তা সময়ান্তরে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই ব্যাপক সংখ্যক চাকরি হারানোর বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে। দুর্নীতির ইস্যুতে তা যেন সরকারবিরোধী টাটকা প্রমাণের সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল। একের সর্বনাশ, অন্যের পৌষমাস মনে হলেও এরকম ভয়ঙ্কর পরিণতি কেউ প্রত্যাশা করেনি,ভাবতেই পারেনি।
Advertisement
সেক্ষেত্রে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ২০১৬-র প্যানেলের ২৫৭৫৩ জনের চাকরি চলে যাওয়ার খবরে সারা রাজ্য জুড়ে তা নিয়ে তুমুল হৈচৈ পড়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। তাতে বাতিল হওয়া চাকরির মধ্যে প্রায় তিনভাগই শিক্ষকের চাকরি। যারা এতদিন পথে নেমে শিক্ষকের হকের চাকরি পাওয়ার জন্য জীবনপণ করে রাস্তায় পড়ে থেকে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দাতে দাঁত চেপে দিনের পর দিন সুবিচারের প্রত্যাশায় সরকারি রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সুদীর্ঘ সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিল, অভ্যাসের ফেরে আমজনতার উদাসীনতায় তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরও ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে তা জাগিয়ে তোলার প্রয়াসেও টালবাহানার খেলায় উপেক্ষা আর উদাসীনতা নেমে আসে। যে বিচারপতির সৎসাহসে ভর করে আন্দোলনের রাস্তাই একমাত্র রাস্তা মনে হয়েছিল, সেই বিচারপতির কর্মক্ষেত্র থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতিতে যোগদানের মাধ্যমে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই সেই রাস্তাই দুর্গম হয়ে ওঠে। সবদিক থেকেই বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের গতি রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপরেও তাদের নাছোড় মনোভাবে যখন মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ে যোগ্যতার প্রশ্নে গোটা প্যানেলটাই বাতিল হয়ে যায়, তখন তাদের দাবি মান্যতা পেলেও চাকরিহারা শিক্ষকদের হাহাকারে তারা পিছনে চলে যায়।
Advertisement
সেখানে যোগ্য ও অযোগ্যদের তরজা বা অবৈধ চাকরির জন্য বৈধ শিক্ষকদের নিয়ে রাজ্যজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে, নির্বাচনী প্রচারের আলো শুষে নেয়। শুধু তাই নয়, তাতে মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ের প্রতিও তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। মহামান্য সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ে সেই অসন্তোষ ক্রমশ নিস্তেজ হলেও চাকরিহারা শিক্ষকদের তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন রাজপথে নেমে আসে। স্বাভাবিক ভাবে তাতে শিক্ষকতায় বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন পেছনের সারিতে চলে যায়। অন্যদিকে যোগ্য চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়ে যায় তীব্র প্রতিযোগিতা। সেখানে নির্বাচনী প্রচারে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাতে শুধু সময়ের দাবিই নয়, সেই সময় অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ মনে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে শুধু যোগ্যদের চাকরি ফিরে পাওয়ার হাতছানিই নেই, অযোগ্যদের অবৈধ চাকরির পরিবর্তে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। অথচ প্রত্যাশিত ভোটের রেজাল্ট না হওয়ার পর তার করুণ চিত্র সামনে চলে আসে। আসলে এক যুগের বেশি সময় ধরে এ রাজ্যের সরকারি কর্মক্ষেত্রে শূন্যতাবোধে কর্মপ্রার্থীরাই শুধু ভুক্তভোগী নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনেও ভয়ঙ্কর হতাশা গ্রাস করছে। সেখানে শুধু চাকরি চুরির কথাই মনে আসেনি, ভবিষ্যতের সাধ ও স্বপ্নও চুরির কথাও মনে করিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে হারানো চাকরি ফিরিয়ে দিলেই তার সমাধান হবে না, বৈধ পথে যোগ্যতার নিরিখে চাকরি পাওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাও ফিরিয়ে আনা জরুরি। সেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর জরুরি তৎপরতায় সেই বৈধ পথের সুরাহা ও সুরক্ষা নতুন করে প্রত্যাশা জাগিয়েও অস্তাচলে দিনমণি।
আসলে সময়ে শুধু অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায় না, অস্তিত্বকেও নতুন করে চিনিয়ে দেয়। সেখানে বৈধ-অবৈধের ধারণা থেকে যোগ্য-অযোগ্যের চেতনা স্বাভাবিক ভাবেই আরও বেশি মুখর হয়ে ওঠে। চাকরি হওয়াতেই যেমন অবৈধ ধারণা বৈধতা লাভ করে বা চাকরি হলেই তার যোগ্যতা প্রমাণিত হয়, এরকম বদ্ধমূল ধারণা যে ঠিক নয়, মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়েই তা প্রতীয়মান। শুধু তাই নয়, এর আগে পাকা চাকরি চলে যাওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারেনি। যেখানে চাকরি পাওয়ার চেয়ে তা হারানোকে আরও কঠিন বলে তার স্থায়িত্বকে অক্ষয় করার সযত্ন প্রয়াস চলে, সেখানে স্থায়ী চাকরি চলে যাওয়ার মতো আকস্মিকতা সাধারণের মনে ভয়ঙ্কর নিঃস্বতাবোধ অত্যন্ত স্বাভাবিক। বাঙালির চাকরিসর্বস্ব জীবনে চাকরিই তার অস্তিত্বের উৎকর্ষ, পায়ের নীচের মাটি থেকে সামজিক প্রতিষ্ঠা সর্বত্র তার বিস্তার। সেখানে ছাত্রজীবন থেকেই তার মনে চাকরিই ধ্যান-জ্ঞান, উচ্চতর যোগ্যতার মাপকাঠি। এজন্য একের পর চাকরি সোপান বেয়ে অনেকেই মোটা মাইনের বা বড় চাকরিতে থিতু হয়ে থাকে। সেখানে চাকরিহারাদের মধ্যে অনেকেই পুরনো চাকরি ছেড়ে শিক্ষতার চাকরিতে এসেছেন বা জায়গা পরিবর্তন করেছেন। তাদের সমস্যা আরও ভয়াবহ। কেননা চাকরি হারিয়ে তারা আর পুরনো জায়গাতে আর ফিরে যেতে পারবেন না। অন্যদিকে বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে বয়স, যোগ্যতা থেকে রেজাল্ট, অনুশীলন, স্বাস্থ্য সবেতেই পিছিয়ে থাকার প্রবল সম্ভাবনা।
একে চাকরি হারানোয় পারিবারিক জীবনের আর্থিক বিপর্যয়, তার ওপরে সামাজিক সম্পর্ক ও সম্মানহানির ভয়, সর্বত্র আতঙ্ককে পুঁজি করে বেঁচে থাকার লড়াই জারি হয়। সেখানে অবৈধ পথে অযোগ্যদের চাকরির জন্য সেই সব যোগ্যদেরই আজ মূল্য দিতে হচ্ছে, ভাবা যায়! আজ স্কুলের প্রাঙ্গণ ছেড়ে চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য যোগ্যদের আন্দোলনে নামতে বাধ্য করেছে। চাকরি হয়ে গেলেই কেউ আর তাদের অবৈধ বলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবে না-র বদ্ধমূল ধারণা থেকেই যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের চাকরি বিক্রি করার মতো ভয়াবহ দুর্নীতি যে ঘটেছে, কোর্টের রায়েই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে । শুধু তাই নয়, সেই অবৈধ চাকরিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সরকারের সুপার নিউমারিক পদ সৃষ্টির অসাধু উপায়ও সংবদ্ধ দুর্নীতিকে চিনিয়ে দেয়।
সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার স্বপ্নটাই আজ বাস্তব জীবনে দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে যারা সেই দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ওঠার স্বপ্নে বছরের পর বছর রাস্তায় পড়ে থেকে আন্দোলন চালিয়েছে, তারা জনতার করুণা পেলেও মর্যাদা পায়নি। তাদের অবিরত আন্দোলন ও আইনি পথের লড়াইয়ে যখন শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণে গোটা প্যানেলটাই বাতিল হওয়ায় চাকরিহারা শিক্ষকেরা পথে নেমে এলেন, তখন তাঁদের দাবি-দাওয়ার চেয়ে হারানো চাকরি ফেরতের কথা জোরদার হয়ে ওঠায় তাঁরাই ব্রাত্য হয়ে গেলেন। অথচ তাঁরাই সবচেয়ে উপেক্ষিত হয়েছেন। কতগুলো বছর তাদের জীবন থেকে চলে গেছে, জীবনের প্রতি জেগে উঠেছে অবিশ্বাসের নিবিড় হাতছানি। আর্থিক প্রতিষ্ঠা, সামাজিক নিরাপত্তা, জীবন গড়ে তোলার আয়োজন সবটাই তাদের অধরা মাধুরী হয়ে থেকে গেছে। অন্যদিকে যোগ্য চাকরিহারা থেকে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীর বাইরেও রয়েছে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী যারা সেই অনিশ্চিত অজানা ভবিষ্যতের দিকে অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এক যুগের বেশি সময় ধরে কর্মক্ষেত্রের অকর্ষিত জমিতে ফসলের কোনও চিহ্ন নেই, তার বদলে দুর্নীতির আগাছায় তা পরিপূর্ণ, কোথাও ফসলের আশা নেই, জমির চাষযোগ্যতাই হারিয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবে একে কর্মসংস্থানের তীব্র আকাল, তার মধ্যে দুর্নীতির লাগামহীন নৈরাজ্য, সবদিক থেকেই বর্তমান অনিশ্চয়তায় ভোগা কর্মপ্রার্থী থেকে দিশাহীন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তার কুপ্রভাব গোটা সমাজজীবনকে অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নেমে এসেছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
সেখানে পড়াশোনা করে কী হবে’র প্রশ্নটি অবিরত ঘুরপাক খায়। এজন্য এসএসসি-র প্যানেলটি বাতিল না করে যোগ্যদের চাকরি সুনিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। বঞ্চিতদেরও সব সুদে আসলে ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক। তাহলেই সব হবে না, যারা অবৈধ পথে দুর্নীতির কারবারি ও বিভিন্ন ভাবে তার সহায়ক, যারা দুর্নীতি করে অন্যের চাকরি আত্মসাৎ করেছে, সুবিচারের স্বার্থেই তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা উচিত। দুর্নীতি করে যে যোগ্যদের কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না, যোগ্যদের বঞ্চিত করে চাকরি বিক্রি করলেও তা শেষ রক্ষা করা অসম্ভব, হকের চাকরি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, তা সুনিশ্চিত করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার স্বার্থেই প্যানেল বাতিল না করে প্যানেলটিকে দুর্নীতিমুক্ত করা জরুরি। যোগ্যতাই যে শেষ কথা সেই যোগ্যতার মানদণ্ডকে আবার ফিরিয়ে এনে সুশাসনে বিশ্বাসের ছবিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সেই বিশ্বাসের ছবি মনে জেগে উঠলেই বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার হৃতগৌরব ফিরে আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। এজন্য দ্রুততার সঙ্গে সুবিচারের মাধ্যমে শিক্ষার সৌরভে বিশ্বাসের নিভন্ত বাতিঘর আবার জ্বলে উঠুক, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে আবার শিক্ষায় স্বপ্ন দেখা শুরু হোক। এজন্য এসএসসি-র প্যানেল নয়,বাতিল হোক অবৈধ নিয়োগ।
Advertisement



