• facebook
  • twitter
Wednesday, 12 February, 2025

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

‘ভাতার-খাকী’ কথাটি রবীন্দ্রনাথের কাছে অশালীন মনে হয়েছে

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

লৌকিক জীবন থেকে উদ্ভূত বলে ইডিয়ম হল ভাষার মজ্জাগত অংশ। উচ্চশিক্ষিত সম্ভ্রান্তরা সাধারণের জীবন থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন বলেই ভাষার ঐ ইডিয়মের সঙ্গে তাঁদের খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে না। তাঁদের হাতে সাহিত্য রচিত হয়েছে ব্যাকরণসম্মত বিশুদ্ধ ভাষার। নবীন লেখকরা যে গ্রাম্য চাষী মজুরদের কিংবা শহরের বস্তিবাসীদের বাক্যালাপ তাদের মুখের ভাষাতেই লিখেছেন তাতে ভাষার ঐ জীবন্ত ইডিয়মটা আমাদের সাহিত্যে ব্যবহৃত ভাষার অঙ্গীভূত হতে পেরেছে। বলা বাহুল্য ইডিয়ম বলতে শুধু আঞ্চলিক ভাষা নয়; ভাষা যেখানে আপন স্বরূপ অর্থাৎ অন্তরঙ্গ রূপে প্রকাশ পায় তাকেই আমরা বলি ইডিয়ম-সম্মত ভাষা। বাংলা গদ্যের শৈশবেই উইলিয়ম কেরির ‘কথোপকথন’ নামক পুস্তকে এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের কোনো কোনো রচনায় আমরা বাংলা ইডিয়ামের ব্যবহার লক্ষ্য করেছি।

‘আলালী’ ভাষায় এবং ‘হুতোমী’ ভাষায় খুব স্বাভাবিক কারণেই বাংলা ইডিয়ম যথাযোগ্য স্থান পেয়েছে। অবশ্য একটি দুটি দৃষ্টান্তকে নিয়মের ব্যতিক্রম বলতে হবে। রামমোহন বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বেশির ভাগ গদ্যরচয়িতাই ছিলেন সংস্কৃত-ভাষাভিজ্ঞ সুপণ্ডিত। সুললিত সুমার্জিত সাধু ভাষার প্রতি যতখানি তাঁদের নজর ছিল, কৌলীন্যহীন প্রাকৃত ইডিয়মের প্রতি ততখানি ছিল না।

আজকে বাংলা গদ্যের যে মহিমান্বিত রূপ তা বহুলাংশে রবীন্দ্রনাথের দান। তাহলেও বলতে বাধা নেই যে বাংলা ইডিয়মের সঙ্গে তাঁর পরিচয় তেমন ঘনিষ্ঠ ছিল না। এর প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘ছেলে ভালানো ছড়া’র আলোচনায় তাঁর একটি মন্তব্য আজ অনেকের মনেই একটু কৌতুকের সঞ্চার করবে। বিবাহান্তে কন্যা শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। মা মাসি পিসিরা কাঁদছে, বোনেরা কাঁদছে—বাঙালি গৃহের অতি পরিচিত সংসারচিত্র। যে বোনের সঙ্গে সারাক্ষণ খিটিমিটি লেগেই থাকত সেও কাঁদছে—
বোন কাঁদছে, বোন কাঁদছে খাটের খুরো ধরে
সেই য়ে বোন গাল দিয়েছে ভাতার-খাকী বলে।

‘ভাতার-খাকী’ কথাটি রবীন্দ্রনাথের কাছে অশালীন মনে হয়েছে। তিনি ঐ কথাটির পরিবর্তে ‘স্বামী-খাকী’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। দেশজ ইডিয়ম সম্বন্ধে যাঁদের ধারণা আছে তাঁরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় ‘ভাতার’ কথাটি এখানে যেমন লাগসই ‘স্বামী’ কথাটি আদৌ তেমন নয়। সত্যি বলতে কি, স্বামী কথাটি এখানে নিতান্তই রসভঙ্গ করেছে।

(ক্রমশ)