স্বপনকুমার চ্যাটার্জি
অনেকদিন ধরে তাঁর সম্বন্ধে কিছু লিখবো বলে ভাবছিলাম। এ ব্যাপারে আমাকে পবিত্রদা (ডাঃ পি. কে. গোস্বামী), সুশীলদা (ডাঃ এস. কে. ভট্টাচার্য), ডাঃ সুভাষ মন্ডল, গৌরব মহলানবিশ (বিশিষ্ট অঙ্ক শিক্ষক), রিন্টু, তাজমুল উৎসাহ যুগিয়েছেন। বস্তুত তাঁর স্বর সম্বন্ধে বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। সেজন্য আমি তাঁর গান নিয়ে কিছু বলা থেকে বিরত থাকছি। আমি বরং এমন একটি দিক নিয়ে আলোচনা করবো মনে হয় সেটা অনেকটা অজানা। সালটা সম্ভবত ১৯৬১। আমি তখন স্কুলছাত্র ৷ সে সময়ে সেই বাংলা গান এ জীবনে যদি আর কোনোদিন দেখা হয় দুজনা… আজ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে মনে হয় যে কৈশোরের সেই স্বর কীভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছিল। ভালবাসা, আবেগ, ব্যথা সেই সময়ে যেন উপলব্ধি করেছিলাম। সুরের মূর্ছনা সব কিছুকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। তখন থেকেই আমার স্বপ্নের সম্রাটকে খুঁজতে শুরু করেছিলাম। স্বীকার করছি আমি না তখন থেকেই তাঁর গানে পাগল হয়েছি। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার বড় সাধ ছিল। তাঁকে কাছে পেলাম ডায়মন্ডহারবার ফাংশনে ১৯৭৫ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি। আমার অফিসের বন্ধু হিটলুদা তার পাড়ার স্বর্গীয় অজয় বিশ্বাসকে বলে আমাকে স্টেজে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
আমি সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ, বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর পা ছুঁলাম অর্থাৎ প্রণাম করলাম। সেদিন অবাক হয়ে দেখলাম কত সরল মনের মানুষ তিনি। স্বেচ্ছাসেবকের কাছ থেকে চায়ের ভাঁড়ে চা খাচ্ছেন। এই ব্যাপারটা আজও দর্শকরা হয়তো ভোলেননি। আমি তারপর তাঁকে অনুরোধ করলাম তাঁর অটোগ্রাফ এবং ভিজিটিং কার্ড দেওয়ার জন্য। উনি হাসলেন এবং রাজি হলেন। সেদিনের ঘটনার কথা বলি। আমাদের সময় ঝর্ণা কলম অর্থাৎ কালি ভরা পেন ব্যবহার হত । আমিও তাই আমার কলমটা তাঁকে দিলাম সই করার জন্য। কিন্তু পেনটা খুব ঝঞ্ঝাট করলো, আমার কলম থেকে কালি বেরিয়ে এলো। আমি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছি দেখে তৎকালীন এস.ডি.পি.ও. ডায়মন্ডহারবার তাঁর কলমটা এগিয়ে দিলেন। তারপর জাহীর সাহেব তাঁর সেক্রেটারি ও শ্যালককে বললেন আমাকে একটি কার্ড দেওয়ার জন্য। মি. জাহীর কার্ড বার করতেই অনেকে কার্ড নিতে চাওয়ায় জাহীর সাহেব আমাকেও কার্ড দিতে ইতস্তত করছিলেন।
উনি বললেন কেবল একেই কার্ড দাও। তারপর প্রথম ১৯৭৬ সালে তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গেলাম। যাওয়ার আগে আমাদের প্রতিবেশী বিখ্যাত বেহালা বাদক দিলীপদা আমাকে প্রয়াত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং প্রয়াত ভি. বালসারার কাছে এক সকালে টালিগঞ্জ স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন এবং দিলীপদা দুজনকে বললেন যে আমি তাঁর প্রতি কতটা অনুরক্ত। দিলীপদা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে একটা চিঠি লিখে দিতে অনুরোধ করলেন। বালসারা সাহেব জাহীরের উদ্দেশে আমাকে একটি চিঠি লিখে দিলেন। আমি তাঁর বাড়িতে গেলাম৷ উনি আমাকে অতিথি হিসেবে আপ্যায়ন করলেন। উনি আমি ও আমার পরিবার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বিদায় নেবার আগে উনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন “তুমি কখনো রেকর্ডিং দেখেছো?” আমি বললাম “না”। উনি সেইদিন বিকেলবেলা মেহেবুব স্টুডিওতে আমাকে আমন্ত্রণ করলেন। আমি যথাসময়ে সেখানে পৌঁছে দেখলাম উনি আমার আগে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তারপর আমি তাঁকে অনুসরণ করলাম। উনি আগে আমি তাঁর পিছনে আসছিলাম। কিন্তু প্রহরী আমাকে আটকে দিলেন। উনি পিছনে আমাকে দেখতে না পেয়ে আবার স্টুডিওর দরজায় ফিরে এলেন এবং তাঁর কথায় প্রহরী আমাকে ঢুকতে দিলেন। আমার মনে হল সমগ্র স্টুডিও তাঁর পদার্পণে ধন্য হয়ে উঠলো। সকলে সশ্রদ্ধভাবে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন। আমি ওখানে প্রায় ২ ঘন্টা ছিলাম। তারপর আমি বিদায় নেবার অনুমতি চাইলাম ৷ উনি অনেকটা পথ আমার কাঁধে হাত দিয়ে আমায় বিদায় জানালেন। তাঁর নম্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে উনি হাতজোড় করে বললেন ভাই সাহাব আবার দেখা হবে ।
উনি আমাকে একটি ৭৮ আর পি এম বেসিক রেকর্ড ও তাঁর আত্মজীবনী আমার অনুরোধে আমায় দিয়েছিলেন। আমি প্রতিবছর আমার বন্ধু লাট্টুর দোকানের সামনে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে তাঁর জন্মদিন পালন করতাম। যেটা আমি এখনো করি। আমি প্রতিবছর তাঁর জন্মদিনে ২ কিলো কে. সি. দাশের প্যাকেট বন্দি রসগোল্লা তাঁর বাড়িতে পাঠাতাম এবং উনি সাদরে গ্রহণ করতেন। এর কিছুদিন পর আমি আবার ১৯৭৯ এপ্রিল মাসে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলাম৷ আমি যখন পৌঁছলাম তখন উনি বাড়ি ছিলেন না। উনি রেকর্ডিং এর জন্য বাইরে ছিলেন, তাঁর স্ত্রী আমাকে আপ্যায়ন করলেন ও বাড়ির ড্রইংরুমে বসিয়ে ঠান্ডা পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি দিলেন। আমিও কলকাতা থেকে আনা কে. সি. দাশের মিষ্টি দিলাম। কিছুক্ষণ পর উনি পাঞ্জাবী, লুঙ্গি পরে ভিতরে এলেন। আমি তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। উনি বললেন কত কষ্ট করে এসেছো! তারপর জিজ্ঞাসা করলেন “কেমন হয়েছে আমার বাংলা গান তোমাদের আশীর্বাদে”, আমি বললাম খুব ভাল। তারপর উনি আমাকে তাঁর বিভিন্ন পুরস্কার সোনার সরস্বতী, নটরাজ মূর্তি ইত্যাদি সব দেখালেন। এগুলি অত্যন্ত যত্ন সহকারে সংরক্ষিত ছিল। তারপর আমি আবদার করলাম তাঁর সঙ্গে একটা ছবি তোলার এবং উনি তৎক্ষনাৎ রাজি হলেন।
আমি একটা সস্তা ক্যামেরা আগফা ক্লিক থ্রি নিয়ে গিয়েছিলাম এবং ওই ক্যামেরা আমার পৈতেতে উপহার পেয়েছিলাম। তা যাই হোক, আমি তাঁকে বললাম একটা “ফ্ল্যাশগান” পাওয়া যাবে? উনি হেসে বললেন গলা ছাড়া আমার কাছে কিছু পাওয়া যাবে না। আমি তাঁর বাড়িতে প্রায় ৪৫ মিনিট ছিলাম। আমি তাঁর স্ত্রীরও পরিচিত ছিলাম। উনি কত সহজ, তাঁর সহজ সরল মন কখনো ভোলা যাবে না। উনি বলেছিলেন ঈশ্বর এবং সত্য এছাড়া কারও কাছে মাথা নত করবে না। উনি ছিলেন উদার, দয়ালু, প্রচারবিমুখ ব্যক্তি। সেইজন্য উনি যোগ্য ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও মরণোত্তর ভারতরত্ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁর যে কত দান ও বিভিন্ন গরীব মানুষকে সাহায্য প্রায় সবই অজানা থেকে গেছে। অগণিত মানুষের ভালবাসা তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। আমি প্রতিবছর মহালয়ার পিতৃতর্পণের দিন আমার বাবার সঙ্গে তাঁকেও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ও তর্পণ করি। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে উনি সবাইকে ভালবাসতেন। তাঁর স্নেহ থেকে কেউ বঞ্চিত হতেন না এবং কারও কষ্ট দেখলে উনি অত্যন্ত দুঃখ পেতেন। উনি বলেছিলেন বড় হওয়া ভাল, তার চেয়েও বড় ভাল হওয়া। উনি সত্যি ভীষণ ভাল মানুষ ছিলেন। আমি শেষবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম ১০-২-১৯৮০ কলকাতার পার্ক হোটেলে। প্রাথমিকভাবে হোটেল রিসেপশনিষ্ট আমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দিতে চাইছিলেন না। কারণ আমার আগে এক দম্পতি রাহুল দেববর্মণের চিঠি নিয়ে দেখা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু অনুমতি মেলেনি। আমি তখন রিসেপশনিস্টকে বললাম আপনি ইন্টারকমে ওঁর স্ত্রীকে বলুন যে বেহালা থেকে স্বপন দেখা করতে এসেছে। তখন তাঁর স্ত্রী বললেন স্বপনকে পাঠিয়ে দাও। আমি তাঁদের সঙ্গে প্রায় আধ ঘন্টা ছিলাম। তাঁর স্ত্রী আমায় কথা দিয়েছিলেন যে পরের বার যখন কলকাতায় আসবেন আমাদের বকুলতলা বাড়িতে আসবেন। হায়, সেই স্বপ্ন আর কোনদিন সফল হল না।
উনি গত হওয়ার প্রায় ৯ বছর বাদে ভাঙা মন নিয়ে ১৯৮৯ তে আবার তাঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। তাঁর স্ত্রী সম্ভবত আমাকে চিনতে পারেননি। আমি তাঁর স্ত্রীকে বললাম যে তাঁকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে আমি সেখানে যেতে চাই। তাঁর স্ত্রী এক ব্যক্তিকে পাঠালেন আমার সঙ্গে তাঁর সমাধিস্থলে। সমাধিস্থলের মৌলবি সাহেব অবাক হয়ে গেলেন যে, সুদুর কলকাতা থেকে এসেছি তাঁর পবিত্র মাটি সংগ্রহের জন্য। মৌলবি সাহেব বললেন বুঝতে পারলাম তুমি তাঁকে কত ভালবাস। এবার বলি কিছুদিনের জন্য উনি অস্তমিত ছিলেন। বেশ কিছু সংগীত পরিচালক ও এস. ডি. বর্মণ ছাড়া অন্যান্য যথা নৌশাদ সাহাব, ও. পি. নায়ার, রোশন, মদনমোহন, রবি, সি রামচন্দ্র, শংকর জয়কিষান, বসন্ত দেশাই, একবাল কুরেশী, জয়দেব, চিত্রগুপ্ত, রামলাল, খৈয়াম, সি. অর্জুন, লছিরাম, এস.এন. ত্রিপাঠি, সর্দার মালিক, জি.এস. কোহলী, এন. দত্তা, দত্তারাম, ঊষা খান্না ইত্যাদি দিকপাল সংগীতকার সে সময় অন্তরালে ছিলেন। একটা সময়ে এইসব প্রথিতযশা ব্যক্তি উদয় হন এবং কালের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নেন। এখানে প্রাসঙ্গিক একটি কথা বলি, ১৯৬৯ শেষের দিকে উনি হজ থেকে ফেরার পর তাঁর কিছু আত্মীয় পরিজন তাঁকে ধর্মীয় কারণে গান গাইতে নিষেধ করেন। ধর্মভীরু শিল্পী ইংল্যান্ডে তাঁর ছেলেদের কাছে চলে যান এবং বম্বে সিনেমা জগৎ তাঁকে কিছুদিন পায়নি। তাঁর ছেলেরা বললেন ঈশ্বর-প্রদত্ত স্বর্ণকন্ঠের অধিকারী এভাবে কন্ঠ স্তব্ধ করতে পারেন না এবং তিনি পুনরায় ফিরে এসে তাঁর কন্ঠের জাদু দিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত সকলকে মাতিয়ে গেছেন। তাঁর মত আরেকজন কিংবদন্তী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন সেই ধন্য নরকুলে লোকে যারে নাহি ভোলে। সত্যি তাই আজ তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেও উনি চিরনতুন। তাই উনি বলেছেন, আমি চলে যাওয়ার পর যুগ আমায় খুঁজবে। উনি ছিলেন শান্তি, প্রেম, ভালবাসার প্রতিমূর্তি।