বিশ্বজুড়ে সরবরাহ করা ৭৫ শতাংশ জাল ওষুধ ভারতেই তৈরি হয়। ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অনুমান অনুযায়ী, ভারতে ৫ শতাংশ ওষুধ জাল এবং ০.৩ শতাংশ ওষুধ ভেজাল। ভারতে ওষুধের বাজারের আনুমানিক মূল্য ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিআর সিং নামে এক গবেষক ওষুধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে এক সমীক্ষা-রিপোর্টে জানান, ভারতের ওষুধ বাজারের ২০ শতাংশ জাল, নিম্নমানের এবং ভেজাল ওষুধের দখলে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে প্রতি ১০টি ওষুধের মধ্যে একটি নিম্নমানের বা জাল হওয়ার কারণে রোগ সারাতে ব্যর্থ হয়। আমাদের দেশ তার মধ্যে অন্যতম। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতে ওষুধের ব্যবসার পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যার মধ্যে দেশের বাজারে বিক্রি হয় এর অর্ধেকেরও কিছু কম, বাকিটা রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে। উৎপাদনের পরিমাণের দিক থেকে ভারতের ওষুধ শিল্প বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এবং উৎপাদনের মূল্যের দিক থেকে ১৪তম স্থানে রয়েছে। এই পরিমাণের ২০ শতাংশ নিম্নমানের, জাল বা ভেজাল ওষুধ দেশের মানুষ না জেনেই খেতে বাধ্য হচ্ছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে জাল বা ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ যাচাই করে কেনা কোনও মতেই সম্ভব নয়। ফলে এই ওষুধ খেয়ে কেউ মরেছেন, কারোর অসুখ সারছে না, অথচ চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। একমাত্র সরকারই পারে এই ঘৃণ্য মানুষ মারা ব্যবসা বন্ধ করতে। যদিও এই ভেজাল কারবারে যুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২০ বছর পর্যন্ত সাজার ব্যবস্থা আইনে আছে। তবে আজ পর্যন্ত কাউকেই এমন সাজা দেওয়া হয়নি। এতেই সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণ হয়।
Advertisement
দেশের ও রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের হাতে। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল কাঠামো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে কোভিড সংক্রমণের সময়ই। শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে অথবা ৪-৫ দিনের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছেন সারা দেশে। ন্যূনতম অক্সিজেনের ব্যবস্থা না করে দেশবাসীকে থালা বাজাতে বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কর্পোরেট ওষুধ কোম্পানির টিকা নিতে বাধ্য করলেন দেশবাসীকে। নিজের ছবি ছাপিয়ে সার্টিফিকেট বিলিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কর্পোরট কোম্পানির টিকা বিক্রি করতে সকাল-বিকাল ভাষণ দিলেও, জাল, নিম্নমানের বা ভেজাল ওষুধ বন্ধ করতে নেতাদের ভাষণ দিতে বা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। মানুষ ভুগলে ভুগুক, মরলে মরুক, ওঁদের কর্পোরেট মিত্ররা বাঁচলেই হলো। আমাদের রাজ্যে জাল ওষুধ নিয়ে সম্প্রতি হৈচৈ হচ্ছে এবং সরকার ব্যবস্থা নিতে সচেষ্ট হয়েছে। জাল ও ভেজাল ওষুদের কারবার বন্ধ করতে রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তর ও ড্রাগ কন্ট্রোল বোর্ড খুবই সক্রিয়। এই সক্রিয়তা সারা বছর ধরে থাকা উচিত। যদি থাকতো তাহলে চারদিকে মাকড়সার জালের মতো জাল ওষুধের কারবার ছড়িয়ে পড়তে পারতো না। কত মানুষ এইসব ওষুধ খেয়ে মারা গেছেন, অসুস্থ হয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন, সেই খবর কে-ই বা রাখেন?
Advertisement
আমাদের মতো বিশাল দেশে যদি সরকারি পরীক্ষা ব্যবস্থা জোরদার, নিয়মিত এবং বিস্তৃত না করা যায়, তাহলে এই ভেজাল ব্যবসা বন্ধ করার কোনও রাস্তাই খুঁজে পাওয়া যাবে না। একদিকে ভেজাল ওষুধ, অন্যদিকে, সরকারি চিকিৎসার অপ্রতুলতা, সাধারণ মানুষের জীবনকে নাজেহাল করে তুলেছে। সমগ্র দেশের কথা বাদই দিলাম, মোদীর মডেল রাজ্য গুজরাতে ও সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা লাটে উঠেছে। বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। নিয়োগ না হওয়ায় শূন্যপদের সংখ্যা বাড়ছে। রাজ্যের বিজেপি সরকার বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার ফলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার এই বেহাল দশা। সিএজি রিপোর্টে এর উল্লেখ করা হয়েছে।
বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ও সুসংহত স্বাস্থ্যনীতি গ্রহণ করে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়ন না ঘটালে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়বে বলে সিএজি রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় মূলধনী খাতে খরচ গত ছয় বছরে বিপুল হারে কমেছে, ফলে নতুন নতুন সরকারি হাসপাতালও গড়ে ওঠেনি। বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের কাজেরও বিশেষ অগ্রগতি ঘটেনি। ফলে এই বর্জ্য থেকে পরিবেশ দূষণের সমস্যা গভীর হয়েছে। শুধু ভেজাল ওষুধই নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আগাপাশতলা পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
Advertisement



