• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

আলোর হাটে অন্ধকার, ভূত চতুর্দশী থেকে শুরু

মনে পড়ে আমাদের মুলি বাঁশের বেড়ার ঘর থাকার জন্য প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালানোর একটা রিস্ক ছিল। যদি কোনোভাবে আগুন লেগে যায় তবে পুরো ঘরদোর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

সুকান্ত পাল

আঁধার তাড়িয়ে আলোর জগতে প্রবেশ করতে চারিদিকে, ঘরবাড়ি, উঠোন, মন্দির, গাছে গাছে, রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের মাথায় সব জায়গায় আলোর রোশনাই ছড়িয়ে দিয়ে আলোকিত আনন্দের হাটের আয়োজন চারিদিকে।
এতো আলোর আয়োজন কেন ?

Advertisement

তবে কি আমাদের জীবনে আলোর অভাব ঘটে গেছে। আর সেই অভাব দূর করতেই এতো আলোর সমারোহ!‌ তবে যে কবি বলেছেন, আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা।
যতদূর মনে পড়ে ছোটবেলায় বাপ ঠাকুর্দার কাছে শুনেছিলাম এই সময় শস্যক্ষেত্রের শস্য কেটে ফেলার জন্য মাঠে শস্যবনের যত পোকা আছে তারা

Advertisement

সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপের আলো জ্বাললে সেই আলোর কাছে ছুটে আসত এবং সেই আলোর শিখার আঁচে তাদের প্রাণ যেত। এদের বলা হয় শ্যামা পোকা। এই শ্যামা পোকা শ্যামা পুজোর পরই প্রায় শেষ হয়ে যেত। কারণ প্রতিটি বাড়িতে ভূত চতুর্দশী ও দীপাবলির দিন প্রদীপের আলো দিয়ে সাজানো হতো। মনে আছে তখন গ্রামে পাকা বাড়ি প্রায় দেখাই যেত না। ফলে বর্তমান কালের মতো ছাদের রেলিং থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রদীপ বা মোমবাতির আলোয় আলোকিত করতে পারত না গ্রামের লোক। বারান্দার চারিদিকে নিজেদের হাতে তৈরি প্রদীপ বা মোমবাতি দিয়ে সাজানো হতো।

মনে পড়ে আমাদের মুলি বাঁশের বেড়ার ঘর থাকার জন্য প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালানোর একটা রিস্ক ছিল। যদি কোনোভাবে আগুন লেগে যায় তবে পুরো ঘরদোর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এই কারণেই বাবা সকালবেলা থেকেই কলাগাছ কেটে সেই গাছের কান্ডকে এফোঁড় ওফোঁড় করে বাঁশের চটা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলত। তারপর বাড়ির সামনের ফাঁকা উন্মুক্ত জায়গায় তাকে মাটিতে গর্ত করে বসিয়ে দিত। আমরা ভাইবোনেরা নাওয়া খাওয়া ভুলে বাবার সঙ্গে হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে চরম উৎসাহে অপেক্ষা করতাম কতোক্ষনে সেই কলাগাছ তার চারিদিকে বাঁশের চটার অসংখ্য হাত ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াবে।

তারপর সন্ধ্যা নামতেই বাবা সেই সেই কলাগাছের ছড়িয়ে দেওয়া সব হাতের উপর মোমবাতি বসিয়ে দিতেন।
অবশেষে এসে যেত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। একে একে সব মোমবাতিতে আগুনের ছোঁয়া। এক অপূর্ব নরম আলোর বিচ্ছুরণ সমগ্র মাঠটাকে আলোকিত করে তুলত। সত্যি তখন যেন সেই আলোর প্রভায় গিলে যাওয়া মোমবাতির মতো আমাদের মনের সব গ্লানি, অন্ধকার, মূঢ়তা সব যেন গলে গলে ঝরে পড়ত। এক নির্মল ও স্নিগ্ধ পবিত্রতায় মন ভরে উঠত।

অবশ্য এই সময় প্রদীপের আলো জ্বেলে আঁধার দূর করার একটা ধর্মীয় অনুষঙ্গ জুড়ে আছে। সেই বিষয়টি খুব বেশি যুক্তিযুক্ত না হলেও তার একটা পরোক্ষ গুরুত্ব আছে। সেটা এই পৃথিবীতে যেদিন থেকে ধর্ম নামক বিষয়টির উদ্ভব ঘটেছে সেদিন থেকেই চলে আসছে।
কিন্তু এই বয়সে এসে একটা প্রশ্ন বঁড়শির মতো মস্তিষ্কের কোষে আটকে যায়।
এই আলোর উৎসবের এতো এতো বৈদ্যুতিক আলোর বিস্তার কি আদৌ আলোর উৎসবের মুখ্য কারণের ধারেকাছে যেতে পারছে?

প্রদীপের নীচে অন্ধকারের কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। এই উৎসব আমাদের সবার মনে কি আলো ফেলতে পারছে ? এখনো তো অন্নহীন, বস্ত্রহীন, স্বাস্থ্যহীন, শিক্ষাহীন সংখ্যাধিক্য মানুষের জীবনে শুধুই
অন্ধকার আর অন্ধকার। তাদের কাছে এই তথাকথিত এবং উচ্চ – বিজ্ঞাপিত আলোর উৎসব কী বার্তা বহন করে আনছে ? তার খোঁজ খবর কি আমরা নিতে পারছি ?

অন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বুভুক্ষু মানুষের কাছে তো অন্ন চিন্তা চমৎকারা! এই পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে অন্নই কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৈত্তরিয় উপনিষদ তো অন্নকেই ব্রহ্মজ্ঞানে উপাসনা করার কথা বলেছে। অন্ন না থাকলে হাজার বাতির রোশনাই ছড়িয়েও যে আঁধার দূর করা যায় না গো!
তাই তো কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন,
” অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্নই আরাধনা।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।।”
মানুষও যদি অন্নহীন থাকে তবে সবই আঁধার। এতো আলোর ঝলকানি তখন সবটাই যে ঝুটা হয়ে যায় !

Advertisement