• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

চতুরঙ্গ

জগলুল পাশা, কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে মৌলনার পত্রবিনিময় সব সময়ই ছিল, কিন্তু মৌলনা ক্রমে ক্রমে তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে।

প্রতীকী চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মহাত্মা গান্ধী ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত হন এবং সে আন্দোলনের সঙ্গে সাদ্ জগলুল্ পাশার মিশরের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং গাজী মুস্তাফা কামাল পাশার তুর্কীর নবজাগরণের সঙ্গে সেতু নির্মাণ করেন।
এর পরের ইতিহাস ভারতীয় মাত্রই জানেন।

Advertisement

শ্বেত সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ এবং বিশ্ব-মুসলিম প্রেম মৌলনা আজাদের পরিবারে অবিচ্ছিন্ন অংশরূপে গণ্য করা হ’ত। তিনি জন্মগ্রহণ করেন মক্কায়—যেখানে হজ্ উপলক্ষে বিশ্বের তাবৎ মুসলিম প্রিত বৎসর সম্মিলিত হয়ে প্রাচ্য ভূমি থেকে কি করে শ্বেতাঙ্গ ও শ্বেত-স্বৈরাচার দূরীভূত করা যায় তার পরিকল্পনা করতো এবং ভারত, মালয়, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশকে আপন আপন কর্তব্য ও জিম্মাদারী ভাগ করে দেওয়া হত। এ পরিকল্পনা কোনো বিশেষ দেশে সীমাবদ্ধ ছিল না বলে একে ন্যাশনালিজম না বলে প্যান-ইসলামিজম (বিশ্ব-মুসলিম-সংহতি) নামে পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই সুপরিচিত ছিল। দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত মৌলনা এ-মন্ত্রই অহরহ শুনেছিলেন।

Advertisement

কলকাতা আসার সঙ্গে সঙ্গেই মৌলনার পরিবর্তন আরম্ভ হয়। এ-কথা সত্য যে বিশ্ব মুসলিমরে প্রতি তাঁর দরদ কখনো শুকিয়ে যায়নি, কিন্তু ক্রমে ক্রমে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসাহ ও উদ্দীপনার উৎস হয়ে উঠল স্বদেশ প্রেম। উর্দু ভারতবর্ষের ভাষা। তাঁর মাতৃভাষা আরবীকে তাঁর জীবনাদর্শ এবং রাজনৈতিক সাধনার মাধ্যমরূপে গ্রহণ না করে তিনি সর্বান্তঃকরণে বরণ করে নিলেন উর্দুকে। এ বড় সহজ কুরবানী বা আত্মবিসর্জন নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগেই শুধু নয়, আজও দেখতে পাই বহুলোক স্বার্থলাভের জন্য স্বদেশী ভাষা বর্জন করে বিদেশী ভাষার সাধনা করেন এবং আমাদের মত বাঙাল তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে না বলে আমাদের প্রতি রুষ্ট হন।

এবং সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি, এই উর্দু গ্রহণের জন্য জীবন সায়াহ্নে মৌলনাকে আবার অকরুণ কটুবাক্য শুনতে হলো সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মণ্ডলীর কাছ থেকে।

হিন্দী ভাষা কেন রাতারাতি ভারতবর্ষের তাবৎ ভাষার কণ্ঠরুদ্ধ করে ‘জাতীয় ভাষা’ রূপে জগদ্দল প্রতিমার মত ভারতের মন্দিরে মন্দিরে পূজা পাচ্ছেন না, অপেক্ষাকৃত অনুন্নত শিশু ভাষাগুলোকে কেন কচি কচি পাঁঠার মত তাঁর সামনে বলি দেওয়া হচ্ছে না, তার কারণ অনুসন্ধান করে তাঁরা আপন ‘বুদ্ধিতে’ আবিষ্কার করলেন ‘হিন্দী-বিদ্বেষী’ ‘হিন্দী ভাষাকা কট্টর দুশমন’ মৌলনা আজাদকে। ‘যেহেতু মৌলনা উর্দুভাষী তাই তিনি শিক্ষামন্ত্রীরূপে হিন্দীর প্রচার এবং প্রসার কামনা করেন না— এই হ’ল তখন তাঁদের ‘যুক্তি’। হিন্দী যে দুর্বল কমজোর ভাষা সে-কথা স্মরণ করবার অস্বস্তিকর প্রয়োজন কেউ বোধ করলেন না। পণ্ডিত নেহরুও যে উর্দুভাষী এ-কথা বলতে তাঁরা সাহস পেলেন না— এ-কতা বললে উভয়ের হৃদ্যতা বেড়ে যাবে যে!

মাত্র একবার মৌলনা লোক-সভায় তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। এবং যাঁরা সেদিন এই সভায় ছিলেন তাঁরা সবাই দেখেছিলেন মৌলনার আবেগময়ী আন্তরিক বক্তৃতার ফলে প্রতিপক্ষ কি রকম লজ্জায় অধোবদন হয়েছিলেন—শত্রু মিত্র কারো দিকেই মুখ তুলে তাকাবার সাহস পর্যন্ত সেদিন তাঁদের আর হয়নি।

জগলুল পাশা, কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে মৌলনার পত্রবিনিময় সব সময়ই ছিল, কিন্তু মৌলনা ক্রমে ক্রমে তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। সে ইতিহাস লেখবার শক্তি আমার নেই; আমি শুধু এ-স্থলে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মক্কা শরীফের প্যান-ইসলামী বালক যৌবনে পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদী হয়ে গেল। মৌলনার যে সব বিপক্ষদল একদা মুসলিম জাহানের স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা পর্যন্ত আজ কঠিন অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়ে বুঝতে পেরেছেন, সে স্বপ্ন গেছে— এখন তাঁরা পুরো পাকিস্তানী হয়ে গিয়ে জাতীয়তাবাদের আদর্শই বরণ করেছেন। দুঃখ এই, তাঁরা এ আদর্শটি কয়েক বৎসর আগে বরণ করে নিলেই তাঁদের মঙ্গল, আমাদের মঙ্গল, সকলেরই
মঙ্গল হত।

(ক্রমশ)

Advertisement