সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
রাতের দিকে ঘুমাতে যাবার আগে যাদের সঙ্গে চ্যাটিং হয় সাধারণত তাদের সঙ্গে কিছুটা অন্তরঙ্গতা আছে এটা ভেবে নেওয়া হয়। তেমনই এক সখার সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুনলাম সে রাতে তার খুব মন খারাপ। কেন জানতে চাইতেই সে আশ্চর্য হয়ে বলল কেন ? জানোনা কিছু ? আমি বললাম কই না তো। তারপর এ কথায় সে কথায় জানতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুর বাড়িটা নাকি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তাই তার মন খারাপ। অথচ মাত্র কয়েকমাস আগেও রাতের পর রাত তার সঙ্গে ঝগড়া চলত জুলাই বিপলব নিয়ে। সে যাকে বিপলব বলে চালাতে চাইত আমি কিছুতেই তা মানতাম না। পরবর্তীতে গঙ্গা এবং পদ্মা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেছে। রাজ্যের …রাষ্ট্রের …
ভালবাসার…সম্পর্কের … সেই সখার আমার আজ মনখারাপ। … বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙা নিয়ে … আমি স্তম্ভিত। … দুঃখিত। … বিপর্যস্ত। …ফের অশান্ত বাংলাদেশ। রাতের পর পরদিন সকালেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ধানমন্ডির বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে। বাংলাদেশের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে আরও একবার …বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি এখনও শান্ত হয়নি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে আসার কয়েক মাস পরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ … যার প্রমাণ গোটা বিশ্ব দেখল…বাংলাদেশবাসীর জন্য ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন শেখ হাসিনা….ওই বক্তব্য পেশের আগেই শেখ মুজিবর রহমানের ৩২ নম্বর ধানমান্ডির বাড়ি ভাঙচুর শুরু … রীতিমতো তাণ্ডব চালানো হয় সেই বাড়িতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া বেশ কয়েকটি ছবিতে দেখা যায় জেসিবি নিয়ে বাড়ি ভাঙা হচ্ছে। পরে আগুনও লাগিয়ে দেওয়া হয়।পর দিন সকালেও সেই বাড়ি ভেঙে ফেলার কাজ চলছে। বাড়ির ভিতর থেকে যে যা পারছেন লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরেও ভাঙচুর চলছে… ডিপ ফেকের দুনিয়ায় আসল নকল চেনা তো খুব কষ্টকর… তবু মনখারাপের তো আর ডিপ ফেক হয় না … দেখি কেউ বই লুঠ করছেন তো কেউ অন্যান্য সামগ্রী লুঠ করে পালাচ্ছেন। কয়েকজন আবার লোহা, ইট, কাঠও লুঠ করছেন।আশ্চর্য ভাবে প্রশ্ন আসে এই বাড়িটার কী অপরাধ? কেন এত ভয় এই বাড়িটিকে? এই বাড়ি থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের … তাহলে এই বাড়ি কারা ভাঙে? দেশের স্বাধীনতা কয়েকজন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলবে, এই শক্তি কাদের … বাড়ি ভেঙে কি ইতিহাস মুছে ফেলা যায় ? ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করল।একটি সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। একদল লোক প্রকাশ্যে একটি ভবন ভাঙচুর করছেন, অথচ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা প্রতিরোধ করছে না, দাঁড়িয়ে দেখছে- এমন ছবি আর্ন্তজাতিকভাবে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের দুর্বলতা এবং অযোগ্যতা সামনে আনল।বিভিন্ন কারণে মব তৈরি হতে পারে। কিন্তু যে সরকার মব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না, তার ক্ষমতায় থাকার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তো ওঠেই ।
শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার মুক্তি আন্দোলনের অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন৷ এ-কথা সত্য৷ একাত্তর পূর্ববর্তী মুজিবকে মনে রাখবে ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে চলে যান, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশে ফিরলেন৷ অথচ এই ৯ মাসে রক্তের নদীতে স্নান করে বাংলাদেশ যে আমূল বদলে গিয়েছে, তা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে থেকে দেখার সুযোগ তিনি পাননি৷
আর এর মূল্য দিতে গিয়ে একটা নতুন ইতিহাস তৈরি হয়ে গেল। আর আজ যখন ইঁট কাঠ পাথর ভেঙে সেই ইতিহাসের সন্ধিক্ষণকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়েছে তখনই প্রশ্ন ওঠে তবে কি এভাবেই কোনও ‘ছোট’ ঘটনার গহীন থেকে বেড়ে ওঠে আগামীর ‘বড়’ ফ্যাসিবাদ৷ যে কোনও কিছুকে ‘নির্মূল’ করার প্রচেষ্টা, ভেঙে মেরে শেষ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা আসলে অধিকাংশ সময়েই সফল হয় না… কিন্ত ফ্যাসিবাদ এর পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় কি কোথাও?