শোভনলাল চক্রবর্তী
সারা ভারতের রাজনীতিতে মহিলা-ভোটারের ভোটদানে উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের মতামতের প্রতিফলন রাজ্য সরকার থেকে আরম্ভ করে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ রাজ্যে সরকার মহিলাদের জন্য নানা ধরনের প্রকল্প ঘোষণা করেছে, যা প্রতি মাসে সরাসরি মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করছে। এই ধরনের অনুদানের অঙ্ক একটু একটু করে বাড়ছে প্রতি বছর। গ্রামাঞ্চলে, নিম্ন আয়ের মহিলাদের কাছে প্রতি মাসে এই টাকার গুরুত্ব অপরিসীম। এই ধরনের অনুদান ভাল না মন্দ, এই নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। অথচ, নারীর সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনে সচেষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে না।
Advertisement
গণপরিবহণগুলিতে মহিলা-যাত্রীরা স্বস্তিতে থাকেন না। রাস্তায় পরিচ্ছন্ন শৌচালয় তেমন নেই বললেই চলে। যে মেয়েরা অফিসের কাজে সকালে বার হন বাড়ি থেকে, তাঁদের শৌচালয় যেতে হয় অফিস পৌঁছে। সংবাদপত্র খুললেই নারীর উপরে অত্যাচারের খবর চোখে পড়ে। খাতায়-কলমে নানা আইন আছে। অথচ, এই আইনের আওতায় অধিকাংশ নারী আসতে পারছেন না। নারী পাচারকারীদের রমরমা বাড়ছে। স্কুলে যাওয়ার পথে অনেক ছাত্রী নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে। বাল্যবিবাহ এখনও বহাল তবিয়তে আছে। অনেক পরিবার ১৮ পেরোলেই কন্যাসন্তানের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে নানা ধরনের শারীরিক থেকে মানসিক সমস্যায় জেরবার হচ্ছেন তাঁরা। শুধুমাত্র মাসে কিছু টাকা অনুদান প্রদান করে নারী-উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে না। মহিলাদের আসল উন্নতি করতে হলে সমাজের পরিকাঠামো পরিবর্তন করতে হবে যা একমাত্র সরকারি ভাবেই সম্ভব।
Advertisement
মহিলারা নিজেদের ভাল-মন্দ খুব ভাল ভাবে বোঝেন। একটা সময় আসবে যখন এই সহজ সরল হিসেবে ভোট আদায়ে ব্যর্থ হবে সব দলই। সেই দিনের খুব বেশি দেরি নেই ! দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যিই যে, মহিলাদের নামে বণ্টন করা এই টাকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চলে যায় পুরুষদের দখলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো দেখাশোনা করেন পুরুষেরা এবং এই টাকার বেশিটাই বা পুরোটাই খরচ হয় তাঁদের ইচ্ছামতো। অবশ্য যখন দেখা যায়, পুরসভা বা পঞ্চায়েতে নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধিদের হয়ে সমস্ত কার্যকলাপই নিয়ন্ত্রণ করেন সেই প্রতিনিধির পুরুষ অভিভাবক, তখন অনুদানের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ তো নিতান্তই মামুলি ঘটনা। সমকাজে পুরুষের তুলনায় মেয়েদের মজুরি বা বেতন বৈষম্যের যে কথা প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে, তা নিয়ে সরকারের যথাযথ নজরদারি আছে বা আদৌ আছে কি না, এর উত্তর একমাত্র সরকারই দিতে পারবে। এই বিষয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো এবং প্রতিটি বিরোধী দল তাদের দায় কোনও মতেই এড়িয়ে যেতে পারে না। রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ, নিম্নমানের ব্যক্তিগত আক্রমণ, অতীত নিয়ে টানাটানি, দুর্নীতি নিয়ে বচসা ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় বিষয় এবং অনুদানমূলক প্রকল্প নিয়ে প্রচারের আলোয় ঢাকা পড়ে যায় নারীর প্রকৃত অধিকার বা মর্যাদা। এই সমস্ত অনুদানের থেকেও মানুষের বেশি সুরাহা হতে পারে, যদি প্রতিটি পরিবারের ন্যূনতম রোজগার কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা সুনিশ্চিত করার দিকে জোর দেয় প্রত্যেক সরকার। এতে যেমন মানুষ মুক্ত হবেন শ্রমবিমুখতা থেকে, তেমনই পরজীবী হয়ে থাকতে হবে না কাউকেই। সর্বোপরি, মেয়েদের নিজস্ব অধিকারের দাবিতে মেয়েদেরই এগিয়ে আসতে হবে, একজোট হয়ে গড়ে তুলতে হবে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলি যে দানখয়রাতির খেলায় মেতে উঠেছে, তাতে রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে ইতিমধ্যে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। মিড-ডে মিলে বরাদ্দ কম, অঙ্গনওয়াড়ি শিশুকেন্দ্রে খিচুড়ি বিলি করার জন্য কর্মী-সহায়কের অভাব, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের অনুপাতে ভয়ঙ্কর কম শিক্ষক সংখ্যা, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাবে পঠনপাঠন ব্যাহত হওয়া— এই হল রাজ্যের শিক্ষাচিত্র। আরও আছে। গ্রাম-মফস্সলের অনেক জায়গায় জলের পাইপগুলো শুকনো অবস্থায় পড়ে থাকে, গ্রামের রাস্তাগুলির বেহাল অবস্থা, রাজ্য সরকারি কর্মীদের বাকি থাকা মহার্ঘ ভাতা, নতুন শিল্প-কলকারখানা নেই, নদীবাঁধ নির্মাণে টাকা নেই, বেকারত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। অথচ, ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক দলগুলি মহিলাদের জন্য দানখয়রাতির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। তাতে হাতেগরম ফলও পেয়েছে দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ইত্যাদি রাজ্য।
কিন্তু, সাধারণ মানুষের করের টাকায় শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মহিলাদের কিছু নগদ টাকা হাতে দিয়ে এই ভাবে তাঁদের প্রভাবিত করা যায় কি? এই দান-অনুদানের মাধ্যমে মেয়েদের জীবনে তেমন কি কোনও উন্নতি ঘটছে? সেই ধান কাটা, চারা রোপণ, রাস্তা নির্মাণ, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে, বিড়ি বাঁধা, সেলাই কারখানায় কাজ, বাসনওয়ালি, ফুলওয়ালি, চা বাগানের মজুর এখনও সেই মেয়েরাই। পুরুষের তুলনায় অনেক অল্প মজুরিতে তাঁদের কাজ করতে হয়।
এই বৈষম্য নিয়ে কোনও সরকার বা রাজনৈতিক দলের কোনও বক্তব্য আছে কি? এই শ্রমজীবী মেয়েদের জীবনযাত্রার সার্বিক কোনও পরিবর্তন ঘটানো যায় কি না, এটা নিয়ে নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী, আমলারা নীরব। বরং ভোটে জিতে দু’পয়সা কী করে কামানো যায়, সেটাই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। ভোটে জেতার জন্য করদাতার টাকায় নানা রকম প্রকল্পের নাম দিয়ে মেয়েদের কিছু নগদ টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই কি তাঁদের প্রকৃত উন্নয়ন হয়? সমান কাজের সমান মজুরি মেয়েরা পান না। যেমন, খবর নিয়ে জানলাম— বারুইপুরে পেয়ারা বাগানে আট ঘণ্টা কাজ করে মেয়েরা পান দৈনিক ১৭০ টাকা, একই কাজে পুরুষেরা পান ৪০০ টাকা। তার উপর যদি জ্বালানির ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়, দু’মাইল হেঁটে পরিষ্কার পানীয় জল আনতে হয়, ছোট শিশুর পুষ্টি, প্রাথমিক পাঠ অমিল হয়, টাকার অভাবে শিক্ষা, পুষ্টি, চিকিৎসা করাতে পারেন না শ্রমিক মেয়েরা, তবে কিসের উন্নয়ন? মাসে হাতে কিছু টাকা দিলেই কি সার্বিক উন্নতি সম্ভব? এ যেন ক্ষুধা নিবৃত্তির ব্যবস্থা না করে মুখের সামনে কয়েক দানা ভাত ছড়িয়ে দেওয়া।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে শিল্প, কলকারখানা নেই, মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন, চাকরি নেই, ঠিকাকর্মী দিয়ে সর্বত্র অল্প টাকায় কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তা সে স্কুল কলেজ, পুলিশ বিভাগ, রাজ্যে সরকারি কাজ যা-ই হোক না কেন, সেখানে যেটুকু অনুদান পাওয়া যায় মেয়েরা তাই আঁকড়ে ধরছেন। দরকারি সর্বক্ষেত্রে ব্যয়সঙ্কোচ করে, ভোটের ঠিক আগে এই অনুদান বাড়ানো হয় জয় নিশ্চিত করার জন্য। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মেয়েদেরও যেখানে চাকরি দিলে মাসে অন্তত কুড়ি হাজার টাকা দিতে হত, সেখানে এক হাজার টাকা অনুদান দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর প্রশ্ন, জনগণের করের টাকা ব্যয় করা উচিত শিশুপুষ্টি, কর্মসংস্থান, পরিকাঠামো তৈরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের খাতে। সেটিকে শাসক দলের ভোটে জেতার উপায় হিসেবে ব্যয় করা কতটা নৈতিক?
Advertisement



