আগামী নভেম্বরে বিহার বিধানসভার নির্বাচন। বিহারের নির্বাচনের আগে আচমকাই ভোটার তালিকার বিশেষ পুনর্মূল্যায়নের অভিযান শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। তাকে কেন্দ্র করে বিহারের সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তেমনই রাজনৈতিক পরিসরে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া, সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া অপ্রত্যাশিত এই পদক্ষেপে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি শুধু ক্ষুব্ধই নয়, তারা মনে করছে এর পেছনে শাসক বিজেপির গভীর ষড়যন্ত্র আছে। রীতিমতো ছক কষে কয়েক কোটি গরিব আদিবাসী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের তালিকা থেকে বাদ দেবার কাজে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজেপি আন্দাজ করেছে আসন্ন ভোটে বিহারে ক্ষমতায় ফেরা সহজ হবে না।
তাই বিজেপি-বিরোধী সম্ভাব্য ভোটারদের যতটা সম্ভব ভোটার-তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলা হলে দুশ্চিন্তা খানিকটা লাঘব হয়। মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটের আগে ভোটার তালিকায় কারচুপি করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। এই অভিযোগের পক্ষে যেসব যুক্তি উত্থাপিত হয়েছে তার সদুত্তর এখনও নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি। অভিযোগ ভোটের কয়েক মাস আগে ভোটার তালিকায় অবিশ্বাস্যভাবে বিপুল নাম সংযোজিত হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে এই কাজ হওয়ার কথা নয়। অভিযোগ উঠেছে ভোটার তালিকায় কারচুপি করে হরিয়ানাতেও ক্ষমতা দখল করেছে বিজেপি। অথচ সেখানেও বিজেপি নিশ্চিত ছিল যে তারা হারবে।
Advertisement
এদিকে এক বছর জোট নিয়ে নির্বিঘ্ন যাত্রার পর বিহারে ভোটের আগে জোট শরিকদের প্রবল চাপে রয়েছে বিজেপি। কয়েকদিন আগেই বিহারে এনডিএ জোটের শরিক রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চার সুপ্রিমো উপেন্দ্র কুশওয়া নির্বাচন কমিশনের স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন নিয়ে সুর চড়িয়েছেন। এবার বিদ্রোহের আভাস দিলেন লোকদলের চিরাগ পাশোয়ানও। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, চিরাগ প্রথম থেকেই নীতীশ কুমারের বিরোধী। জোটের বাধ্যবাধকতায় তিনি নিজেকে অনেক নিয়ন্ত্রিত করে রাখলেও বিহার ভোটের আগে ফের স্বরূপ ধারণ করেছেন। সুংযুক্ত জনতা দলের কেসি ত্যাগী অবশ্য জানিয়েছেন, বিহারে সমস্ত আসনেই এনডিএ জোটের সব দলই প্রার্থী দেবে। তবে সংযুক্ত জনতা দল নিজেদের ভাগের আসন কমাবে না। রাজনৈতিক মহলের অনুমান, ভোটের আগে এমন নানা জল্পনা ছড়ালেও আদতে কিছুই হবে না। উপেন্দ্র কুশওয়া, চিরাগ পাশোয়ানরা প্রেসার পলিটিক্স করছেন। আসলে এটা বিজেপিকে চাপে রেখে বশি আসন আদায়ের একটি স্ট্যাট্রেজি।
Advertisement
ভোটার তালিকার বিশেষ মূল্যায়ন করে নির্ভুল তালিকা নির্বাচন কমিশনের তৈরি করা গণতন্ত্রের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মূল্যায়নের আড়ালে যদি থাকে শাসক দলের ভোটে জেতার স্বার্থ তাহলে তা কোনও অবস্থাতেই মানা যায় না। পদ্ধতি যেমনই হোক, ভোটার তালিকা হবে নির্ভুল। অর্থাৎ সেখানে কোনও ভুয়ো ভোটার থাকবে না এবং একজন নাগরিকের নামও তালিকার বাইরে থাকবে না। কিন্তু বিহারে যে প্রক্রিয়ায় তালিকা সংশোধন হচ্ছে তাতে আনুমানিক তিন কোটি নাম তালিকা থেকে বাদ চলে যেতে পারে। কারণ, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য যে সব নথি চাওয়া হয়েছে তা জোগাড় করা ভারতের বাস্তব পরিস্থিতিতে গরিব, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অসচেতন, নিরীহ মানুষের কাছে ভীষণ কঠিন। ক্ষেত্র বিশেষে অসম্ভবও। তাছাড়া কোনও স্বাধীন গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম দেশের নাগরিকদের বারবার তাঁদের পরিচিতির প্রমাণ দিতে বাধ্য করা যায় না।
মনে রাখতে হবে, দেশ বা রাষ্ট্রের উৎপত্তি মানুষের জন্য। রাষ্ট্রর জন্য মানুষ নয়। মানুষকে পদে পদে বিপদে ফেলে, ভীত সন্ত্রস্ত করে কার্যত রাষ্ট্রের চোখ রাঙানির মুখে দাঁড় করিয়ে রাখা কোনও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না। এটাই স্বৈরশাসনের প্রবণতা। মৃত, অস্তিত্বহীন ভোটারের নাম অবশ্যই বাদ যাবে। সব নথি জমা দিয়ে নতুন ভোটারও হবে। কিন্তু একজন ভোটার হওয়ার পর তাঁকে বার বার প্রমাণ দাখিলের জন্য তাড়িয়ে বেড়ানোর মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। বরং তাতে শাসক দল সম্পর্কে সন্দেহ বাড়ে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে। শাসক দল ক্ষমতা ক্ষয়ের আশঙ্কায় আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে। তাই স্বৈরাচারী মানসিকতাও প্রবল হয়ে উঠছে।
Advertisement



