• facebook
  • twitter
Tuesday, 23 December, 2025

অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশ, এবার কি ভোট বানচাল ?

দুষ্কৃতীদের কঠোর হাতে দমন করার ডাকও দিয়েছেন আলমগীর। একই সঙ্গে সংবাদপত্রের অফিসে হামলার নিন্দা করেছেন তিনি।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তর থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ— বাঙালি বার বার শিখেছে, ক্ষমতার রাজনীতিতে সে শুধুই একটি ভৌগোলিক সুবিধা। ১৯৪৭-এর দেশভাগ ছিল ধর্মের নামে মানবতার সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। সেই আগুনে শুধু জমি ভাগ হয়নি— ভেঙে গিয়েছিল ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবার, স্মৃতি। এক দিনের মধ্যে প্রতিবেশী হয়ে গেল শত্রু, আত্মীয় হয়ে গেল উদ্বাস্তু। ধর্মের নামে যে বিভাজন করা হয়েছিল, তার ক্ষত আজও শুকায়নি। সেই বিভাজনের ভস্মের ওপরে দাঁড়িয়েই জন্ম নেয় এক বিকৃত রাজনীতি— যেখানে মানুষ নয়, পরিচয়ইপ্রধান; মানবিকতা নয়, ধর্মীয় ট্যাগই চূড়ান্ত সত্য।

Advertisement

এর পরে আসে ১৯৭১। একাত্তর ছিল আগুনের মধ্য দিয়ে এক জাতির পুনর্জন্ম। এটি শুধু যুদ্ধ নয়, ছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষাধিক নির্যাতিত নারীর অসম্মান, লাখো বাস্তুচ্যুত মানুষের কান্নার ওপরে দাঁড়িয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। সেই সময়ে বাঙালি শিখেছিল— ধর্ম নয়, ভাষা ও সংস্কৃতিই তার পরিচয়। শিখেছিল— স্বাধীনতা কোনও দান নয়, এটি রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অধিকার।

Advertisement

কিন্তু ইতিহাস নির্মম। ১৯৭৫-এ এসে সেই স্বাধীনতার বুকে গুলি লাগল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হল শুধু এক জন মানুষ হিসেবে নয়— মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করার জন্য। সে দিন থেকেই বাংলাদেশে আগুন আর নীতিতে নয়, ষড়যন্ত্রে জ্বলতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধীরে ধীরে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে, রাজাকারদের পুনর্বাসন ঘটে, সামরিক ছাউনির ভেতর থেকে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।

২০০১ সালে সেই আগুন আবার ধর্মীয় রূপ নেয়। সংখ্যালঘু নিধন, নারী নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের উপরে পরিকল্পিত হামলা— সবই ঘটেছিল রাষ্ট্রের নীরবতায়। বাঙালি তখনও ভেবেছিল, এটা হয়তো সাময়িক, ক্ষমতার পালাবদলের অন্ধকার সময়। কিন্তু ২০২৪ প্রমাণ করল, এটি সাময়িক ছিল না। এটি ছিল প্রস্তুতি। ২০২৪ সালের অগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ দেখল এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। ঘৃণার প্রজন্ম ও ইতিহাস মুছে ফেলার পরিকল্পিত অভিযান। একে কেউ বলল ‘রিসেট’, কেউ বলল ‘নতুন বাংলাদেশ’— কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল পাকিস্তানে ফেরার মনস্তাত্ত্বিক অভিযান।

৫ অগস্ট ২০২৪-এর পর বাংলাদেশ এমন এক সামাজিক রূপ দেখল, যা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়— এটি ছিল নৈতিক পতন। এই প্রজন্মের একটি বড় অংশের চোখে যে ঘৃণা দেখা গেল, তা কোনও স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ নয়, দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত মগজধোলাইয়ের ফল।পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি, সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বয়ান, ধর্মীয় উগ্রতার স্বাভাবিকীকরণ— এই সব মিলেই তৈরি করা হয়েছে একপ্রজন্ম, যারা আগুনে হাত পুড়লেও প্রশ্ন করে না।আজ পৃথিবী দেখছে, ‘মব’ কী ভাবে দানবে পরিণত হওয়া ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর মুখ। রাষ্ট্র তার নৈতিক বৈধতা শুধু হারায়নি, বরং আইনগত বৈধতা দিয়ে এই সকল জেহাদি বর্বর হত্যা ও নিপীড়নের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইনকিলাব মঞ্চের হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে হিংসা শুরু হল, তা দেখিয়ে দিল, মব এখন রাষ্ট্রীয় বৈধতা পাচ্ছে। রাষ্ট্র আর নাগরিকের নিরাপত্তার গ্যারান্টার নয়, রাষ্ট্র এখন নীরব দর্শক— কখনও বা নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সহযোগী। এক জন মানুষ হিসেবে বলতে চাই, কোনও মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু কাম্য নয়। সে আমার চিরশত্রু হলেও।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার, যারা জুলাই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তারাও রক্ষা পেল না। ইতিহাস বলে, উগ্রপন্থা কাউকে বন্ধু ভাবে না। আজ যারা হাততালি দেয়, কাল তারাই আক্রমণের লক্ষ্য হয়। ভারতবিরোধী স্লোগান তুলে হাই কমিশনে হামলা, ভারতবর্ষকে আক্রমণ করে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে, গণমাধ্যমে আগুন, সংখ্যালঘু হত্যা— এ সবই আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতির সরাসরি লঙ্ঘন। অথচ রাষ্ট্র নির্বিকার, প্রশাসন নির্বাক।‘বিবিসি বাংলা’-র প্রতিবেদন অনুসারে, দমকল আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ভিতরে আটকে পড়া সাংবাদিকদের উদ্ধার করা হয়। আটকে পড়া সাংবাদিকদের একাংশ পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন। অন্য দিকে, খুলনায় এক সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করেছে উত্তেজিত জনতা। ময়মনসিংহে এক যুবককে পিটিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর এক যুবককেও পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে কট্টর ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে। রাজশাহীতেও মুজিবের অপর একটি বাড়ি এবং আওয়ামী লীগের দফতর ভাঙচুর করা হয়েছে। বাংলাদেশের বহু জায়গাতেই বিক্ষোভকারীদের মুখে ছিল শেখ হাসিনা এবং ভারত-বিরোধী স্লোগান। চট্টগ্রামে ভারতীয় উপদূতাবাস লক্ষ্য করে ঢিল-পাটকেল ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে। রাত থেকে উপদূতাবাসের সামনে অবস্থানে বসেন ছাত্র-যুবদের একাংশ। পাকিস্তান জমানায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের দফতরে হামলা হয় গভীর রাতে। অভিযোগ, কট্টরপন্থী স্লোগান দিতে দিতে সংগঠিত ভাবে মিছিল করে গিয়ে সেখানে হামলা চালানো হয়। চলে তাণ্ডব ও লুটপাট। পুড়িয়ে দেওয়া হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি-বই। ভেঙে ফেলা হয়েছে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রও। বিক্ষোভকারীরা ছিঁড়ে দেন ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সঞ্জীদা খাতুনের ছবিও। রেহাই পায়নি লালন এমনকি কবি নজরুল ইসলামের ছবিও! ছায়ানটের নববর্ষ উৎসব ইউনেস্কো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। কিন্তু গত বছরের ৫ অগস্টের পালাবদলের পর থেকেই কয়েকটি কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বাংলা নববর্ষ উৎসব উদ্‌যাপনের বিরোধিতা করেছে প্রকাশ্যে। শুক্রবার সকাল থেকে শাহবাগ-সহ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালান পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং আনসার বাহিনীর সদস্যেরা। কিন্তু তাতে ফল হয়নি। ৩২ ধানমন্ডিতে নতুন করে হামলা ও ভারী হাতুড়ি, শাবল নিয়ে মুজিবের বাড়ির দেওয়াল ভাঙা হয়।আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন এবং জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট হওয়ার কথা। তার আগেই উন্মত্ত জনতার বিক্ষোভে উত্তাল সে দেশের নানা এলাকা। এই পরিস্থিতিতে নির্বিঘ্নে ভোট হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনী আধিকারিক এবং প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনও। এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলা না-হলেও কমিশনের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ‘কালের কণ্ঠ’ এমনটাই জানিয়েছে। নির্বাচনের কাজের সঙ্গে যুক্ত রিটার্নিং অফিসার এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের দফতরের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। নির্বাচন কমিশনের অন্য আধিকারিকদেরও নিরাপত্তা জোরদার করতে বলা হয়েছে। কমিশনকে নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চলা দুই সম্ভাব্য প্রার্থী।

ঘটনাচক্রে, হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগের দিনই নির্বাচনী নির্ঘন্ট ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। ১২ ডিসেম্বর থেকেই মনোনয়ন জমা দেওয়া শুরু হয়েছে। চলবে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি চলবে মনোনয়ন পরীক্ষার কাজ। কোনও মনোনয়ন বাতিল হলে সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত। ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি হবে সেই আপিলগুলির যথার্থতা যাচাইয়ের কাজ। চূড়ান্ত প্রার্থিতালিকা প্রকাশ এবং নির্বাচনী প্রতীক নির্ধারণ করা হবে ২১ জানুয়ারি। আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারের পালা শুরু হবে ২২ জানুয়ারি। চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। তবে এর পর নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ পরিকল্পনামাফিক হবে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

এই পরিস্থিতিতে ইউনূস আবার দেশবাসীকে ‘ধৈর্য ও সংযম’ বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন। হাদির মৃত্যুতে শোকদিবস পালন করা হবে বলেও জানান। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক এই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলেছে সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলি। খালেদা জিয়ার দল বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে লিখেছেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতীরা আবারও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি-সহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। দুষ্কৃতীদের নির্মম হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি নিহতের ঘটনা সেই অপতৎপরতারই বহিঃপ্রকাশ।”

দুষ্কৃতীদের কঠোর হাতে দমন করার ডাকও দিয়েছেন আলমগীর। একই সঙ্গে সংবাদপত্রের অফিসে হামলার নিন্দা করেছেন তিনি। অন্য দিকে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ (‘জামাত’ নামেই যা পরিচিত)-ও এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আর্জি জানিয়েছে। দলের নেতা শফিকুর রহমান সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টে লিখেছেন, “দেশটা আমাদের সকলেরই অস্তিত্বের অংশ। আশা করি সকলেই সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেব।” শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সমাজমাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকে ভাঙচুরের ভিডিয়ো সংবলিত সংবাদ প্রতিবেদন পোস্ট করা হয়েছে। সংবাদপত্রের অফিসে হামলার নিন্দা করে হাসিনার দল লিখেছে, “এই লুট আর হাঙ্গামার রাজত্ব কায়েম করেছে ইউনূস সরকার, এনসিপি (জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-যুবদের একাংশের দল) আর জঙ্গিগোষ্ঠী।” অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত যে আলোর কথা লিখেছিলেন কবি,তাঁর বই ছবি পুড়িয়ে দেওয়া এই মব দানব এখন শুধুই অন্ধকার চেনে,আলোর সন্ধান এখন দুর অস্ত।

Advertisement