• facebook
  • twitter
Thursday, 18 December, 2025

ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশকে ধ্বংসের চেষ্টা

(পাঠকের নিজস্ব মতামত)

প্রতীকী চিত্র

উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে হিংসার দরুন চারজনের মূল্যবান প্রাণ অকালে বিসর্জন হওয়া যতই নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক হোক না কেন; সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এই বৈচিত্র্যময় ভূমির যে নিদারুণ অবস্থা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই ন্যক্কারজনক ঘটনাই তো সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাশিত ও ভবিতব্য ছিল!

‘হরর শো’-এর মেগা-সিরিজের প্রথম পর্বটি গত শতাব্দীর আশির দশকের অন্তিম বছরগুলি থেকে ১৯৯২-৯৩ পর্যন্ত চলেছিল যখন রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করার লক্ষ্যে শ্রীরামচন্দ্রের পবিত্র নাম বর্বরতম পন্হায় দূষিত করা হয়েছিল। দাঙ্গা-উদ্রেককারী রথের উপর চড়ে, এক বিশেষ সম্প্রদায়ের উদ্দেশে গরল উদগীরণ ও হিন্দুত্ববাদী পেশীর বর্বর আস্ফালন— শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ অবস্থান করা মসজিদটির স্থানে মন্দির নির্মাণ করিতেই হইবে! এবং তারই ফলস্বরূপ আসে স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত অন্ধকারতম ক্ষণ, যেদিন পেশী শক্তির দানবীয় প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রাচীন মসজিদটিকে মাটিতে আক্ষরিক অর্থেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়! আইন আদালত সংবিধান সভ্যতাকে উপহাস করে অন্ধকার আদিম যুগের ‘মাইট ইজ রাইট’-এর কি নগ্ন প্রদর্শনী! তারই প্রতিক্রিয়াতে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক অনল (বিশেষ করে ১৯৯২-৯৩-এর মুম্বই নগরীতে) এই বহুধর্মীয় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশকে ধ্বংস করে দিল!

Advertisement

এই ধর্মনিরপেক্ষ বৈচিত্র্যময় গণতান্ত্রিক দেশের ঐতিহ্য ও সাংবিধানিক স্পিরিটকে হত্যা করে ওইরূপ উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ‘পুরস্কার’ও সেই বিশেষ দুই সাংসদের দলটি (১৯৮৪-৮৯) খুব শীঘ্রই পেয়ে যায়— মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে কেন্দ্রীয় শাসকের আসনে উপনীত হয় (সে ১৩ দিনের জন্য হলেও)! সুতরাং অতি স্পষ্টভাবে এই রূঢ় সত্যটা প্রমাণিত হয়েছে যে বহুধর্মীয় এই দেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও বিষাক্ত ইসলামবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক তাস নির্বাচনী ক্ষেত্রে দারুণ কার্যসিদ্ধি করে! তথাকথিত উদার ভারতবর্ষের জনগণ ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করা এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে শীতল মস্তিষ্কে কাজে লাগিয়ে ১৯৮০-র দশকের একদা প্রান্তিক দলটি আজ দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। তারপর দেশের সর্বোচ্চ এক প্রতিষ্ঠান থেকে উপস্থিত হল সেই ‘নৈতিক’ অনুমোদন যার সৌজন্যে আমরা ‘মূর্খ’জনরা ‘আলোকপ্রাপ্ত’ হলাম এই মর্মে যে শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ এক মসজিদের প্রকাশ্য দিবালোকে অবস্থান করার বাস্তবতাটি ছিল ‘মিথ্যা’; ‘অন্তিম সত্য’ হল সংখ্যাগরিষ্ঠদের (বর্বর ধ্বংসযজ্ঞের খলনায়ক গুণ্ডা ও ভক্ত সহ) কাল্পনিক ‘বিশ্বাস’! হ্যাঁ উক্ত মসজিদের নিচে মহাকাব্যের কোন চরিত্র ‘জন্মগ্রহণ’ করেছিলেন কিনা, বা সত্যিই কোনও মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছিল কিনা, তার প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও!

Advertisement

এরপর ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান যুক্তি সত্যের বিধ্বস্ত দুর্গের উপর আর এক কঠিন আঘাত নেমে আসে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ তারিখের ‘মহাকর্ম’টা সংশ্লিষ্ট সাম্প্রদায়িক শিবির ও তাদের পেটোয়া ধর্মান্ধ গুণ্ডাবাহিনী না হয় আইনের সমস্ত রীতিনীতি ধূলিসাৎ করে সংঘটিত করেছিল; কিন্তু ২২ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে তো ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ গ্রহণ করা খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রই তুমুল ঢক্কানিনাদ সহ মসজিদ ধ্বংস করা ভূমিতে নতুন মন্দিরের উদ্বোধন করে সেই সাম্প্রদায়িকতা ও পেশীর বর্বর আস্ফালনকে নৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি প্রদান করল! সুতরাং বিগত ৩৫-৩৬ বছর যাবৎ একের পর এক কর্মকাণ্ড যখন সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ সেকুলার ভারতবর্ষকে বেসরকারিভাবে এক ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বা ‘রাম রাজ্যে’ রূপান্তরিত করার সাক্ষ্য বহন করে, তখন এটাই তো স্বাভাবিক যে এর বিষফল রাষ্ট্রীয়/সামাজিক জীবনের সমস্ত দিককে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে— জ্ঞানব্যাপী, কৃষ্ণ জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে নতুন করে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং ঘৃণার উদ্রেক যার প্রমাণ বহন করে। দারিদ্র্য ক্ষুধা অনাহার নিরক্ষরতা বেকারত্ব শিসু শ্রম তথা নারী পাচারের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে ‘জাতীয়তাবাদী’ কার্পেটের তলায় ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে সমাজ রাষ্ট্র আদালতের তাই আজ ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ কর্ম হল কোন্ মসজিদের তলায় কোন্ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ‘লুক্কায়িত’ আছে তা খুঁজে বের করা!

The Places of Worship (Special Provision) Act, 1991 (mandating status quo on religious structures as they were on August 15, 1947, except for the Ayodhya site) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কেবল এটা নিশ্চিত করতে যাতে ‘রামজন্মভূমি’র মতো সম্পূর্ণ কাল্পনিক দাবি পুনরায় উত্থাপন করে আর সাম্প্রদায়িক ইন্ধন ও উপদ্রবের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। তা সত্ত্বেও, কয়েক বছর আগে যখন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি একটি জলাশয়ের মধ্যে এক অকার্যকর ঝর্ণামুখ-কে ঘিরে বিতর্ক আরম্ভ করে (তার মধ্যে ‘হিন্দু দেবতার’ রূপ কল্পনা করে), তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি আশ্চর্যজনকভাবে জ্ঞানব্যাপী মসজিদের ভেতর তদন্তের সবুজ সংকেত দিয়ে দিল! তাই এটাই তো স্বাভাবিক যে নতুন বল ফিরে পেয়ে নব উদ্যমে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলি এবার দাবি করবে (কোনও প্রমাণ ছাড়াই) যে সম্ভলের মুঘর আমলের শাহী জামা মসজিদ ১৫২৯ সালে ‘বাবরের প্ররোচনা’ তৈরি করা হয়েছিল ‘হরিহর মন্দির’ ধ্বংসকরে! ঠিকই, হিন্দুদের নিছক ‘বিশ্বাস’ যদি এই দেশে ইসলামী উপাসনালয়ের ঘোর অস্তিত্বের চেয়ে অধিক প্রধান্য পায়, যদি মসজিদ ধ্বংস করা পেশী আস্ফালনকারীদের ‘স্বপ্ন’কে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র বিপুল ধুমধাম সহকারে বাস্তবায়িত করে, যদি The Places of Worship (Special Provision) Act, 1991-এর স্পিরিট বাস্তবে রূপান্তরিত না করা হয়; তাহলে কেনই বা আমরা সম্ভলে হিংসা এবং হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করব না!

কাজল চট্টোপাধ্যায়, সোদপুর

Advertisement