রাজু পারাল
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের পরিচয় কারো অজানা নয়। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মানুষের হৃদয়-রহস্যের গহন সমুদ্রে ডুব দিয়ে যে মণিমুক্তা তিনি আহরণ করেছিলেন, তা সত্যই বাঙালি ও বাংলা-সাহিত্যের পরম সম্পদ। যতদিন বাংলা থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন শরৎচন্দ্র তাঁর আপন মহিমায় বিরাজ করবেন মানুষের মনে। প্রতম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা মুহূর্ত থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সৃষ্টিশীলতার শিখরে অবস্থান করেছেন। বাঙালি সমাজের পরিবেশ এবং সাবলিল ভাষা বাঙালি পাঠককে অন্ধ শরৎভক্ত যে করে তুলেছিল তা বলাই বাহুল্য। ভারতীয় ভাষার পাঠক ছাড়াও বহু অবাঙালী কথাকার ও সমালোচক তাঁদের সৃষ্টিতে শরৎ-প্রভাব স্বীকার করেছেন। বিশের দশকের তরুণ বাঙালিদের কাছে শরৎচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য। রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, শিশিরকুমার, নজরুলের সঙ্গে শরৎচন্দ্রও সেদিন বাঙালির মানসিকতাকে প্রভাবিত করেছিলেন।
সাধারণ মানুষের উপর জমিদারদের অত্যাচার, শিক্ষার প্রসারে আন্দোলন, বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে মানুষকে সংঘবদ্ধ জাতীয় চেতনা এবং স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস, কথায় কথায় একঘরে করা—এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে, সমাজের বিচিত্র পরিবেশে জন্মে শরৎচন্দ্র বাল্যকাল থেকে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছেন।
মধ্যবিত্ত বাঙালি শরৎ-সাহিত্যে তাদের ইচ্ছাপূরণের স্বাদ যতটা অনুভব করেছে, অন্য কোথাও ততটা পায়নি। সমাজের নিচুতলার মানুষের প্রতি মমত্ববোধও শরৎ-সাহিত্যের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ব্রাহ্মণ শাসিত হিন্দু সমাজে নিচুতলার মানুষ এবং নারীর প্রতি যে নিপীড়ন বহুকাল ধরে চলে এসেছে শরৎচন্দ্রের লেখায় তার প্রতিবাদ উঠেছে একাধিকবার। তাঁর নিজের কথায়, ‘সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই … এদের বেদনাই দিল আমার মুখ খুলে। এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে নালিশ জানাতে’।
শরৎচন্দ্র সামাজিক আচারের বিরুদ্ধে ছিলেন না। যে নিষ্ঠুর আচার মানুষকে ছোট করত—মানবিকতাকে নীচে নামিয়ে দিত তিনি ছিলেন তার বিরুদ্ধে। তাঁর প্রতিবাদ সামাজিক কাঠামো এবং চিরাচরিত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে নয়, মানুষের হৃদয়হীন স্বার্থপরতা আর আত্মকেন্দ্রিক সর্বস্ব সঙ্কীর্ণ মনোভাবের বিরুদ্ধে।
শরৎচন্দ্রের সমকালীন পাঠক সমোজ মূলত গ্রামীণ কৃষিনির্ভর একান্নবর্তী পরিবার থেকে আসা, বলাবাহুল্য শরৎচন্দ্রের কাহিনির আশ্রয়ও এই পটভূমি। তৎকালীন নাগরিক সমাজ থাকলেও তাদের অর্থনৈতিক এবং মানসিক শিকড় বাঁধা ছিল গ্রাম-বাংলায়। তাই সেই সময়ের সর্বস্তরের পাঠকের কাছে শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট পরিবেশ ও পটভূমি ছিল পরিচিত। অতি সামান্য চরিত্রকেও তিনি দিয়েছিলেন অসামান্যের মর্যাদা।
বিচিত্র অভিজ্ঞতায়-সমৃদ্ধ এবং ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী শরৎচন্দ্রের সাহিত্য জীবন শুরু হয় বাল্যকালেই। নিচু ক্লাসে পড়ার সময়ই বাবার দেরাজ থেকে লুকিয়ে গল্পের বইে বের করে পড়তেন। সে সম্বন্ধে তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি—
‘‘এবার আর ‘বোধোদয়’ নয়, বাবার ভাঙা দেরাজ থেকে খুঁজে বের করলাম ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ আর বেরলো ‘ভবানী পাঠক।’ গুরুজনদের দোষ দিতে পারিনে, স্কুলের পাঠ্য তো নয়, ওগুলো বদ ছেলেদের অপাঠ্য পুস্তক। তাই পড়বার ঠাঁই করে নিতে হলো আমাকে বাড়ির গোয়ালঘরে।’’
এছাড়া শরৎচন্দ্র তাঁর পিতার অসমাপ্ত রচনাগুলিও পড়তেন। সে সব গল্প-নাটক-উপন্যাসের উপসংহার কি হতে পারে, তা নিয়ে গভীর চিন্তা করতেন, এবং ওইভাবেই তাঁর কল্পনাশক্তি উদ্দীপিত হয়েছিল। শরৎচন্দ্রের নিজের কথায়:
‘‘পিতার নিকট হইতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি। … আমার পিতার পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা—এককথায় সাহিত্যের সকল বিভাগেই তিনি হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনটাই তিনি শেষ করতে পারেননি। … ছোটবেলায় কতবার তাঁর অসমাপ্ত লেখাগুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি। এগুলি শেষ করে যাননি বলে কত দুঃখই না করেছি। অসমাপ্ত অংশগুলি কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে আমার অনেক বিনিদ্র রজনী কেটে গেছে। এই কারণেই বোধহয়, আমি সতের বৎসর বয়সে গল্প লিখতে শুরু করি।’’
শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্য সাধনা শুরু করেন নিজের গ্রাম দেবানন্দপুরে। দেবানন্দপুরে থাকার সময়েই শরৎচন্দ্র ‘কাকবাসা’, ‘ব্রহ্মদৈত্য’ ও ‘কাশীনাথ’ লিখেছিলেন। মা ভুবনমোহিনী’র মৃত্যুর পরে শরৎচন্দ্রের বাবা ভাগলপুরে চলে আসেন। এই ভাগলপুরেই শুরু হয় প্রথম পর্বের সাহিত্য জীবন। এখানে শরৎচন্দ্র একটি সাহিত্য গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। নিজে প্রধান পদে থাকলেও ওই গোষ্ঠীতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর অল্পবয়সী মামারা (উপেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ) ও বন্ধু যোগেন মজুমদার ও বিভূতিভূষণ ভট্ট। বিভূতিভূষণের বিধবা বোন নিরুপমা দেবীও ছিলেন ওই সাহিত্য গোষ্ঠীর একমাত্র মহিলা-সদস্য। যিনি পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্রের স্নেহের পাত্রী হয়ে ওঠেন। শরৎচন্দ্র তাঁকে নিজের প্রিয় শিষ্যা ও ছোট বোন বলে বার বার উল্লেখ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে কবি ও ঔপন্যাসিক রূপে নিরুপমাদেবী পরে যশস্বিনী হয়ে উঠেছিলেন শরৎচন্দ্রের আশীর্বাদেই। তাঁর ‘দিদি’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, বিধিলিপি’ প্রভৃতি বইগুলি যথেষ্ট সমাদার পায় সে সময়ে। নিরুপমা দেবীর রচনা সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের উৎসাহ ও কৌতূহল চিরকালই অক্ষুন্ন ছিল। ১৯০৮ সালে এক পত্রে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে বিভূতি ভট্টাকে নিরপমা দেবীর সাহিত্য চর্চ সম্পর্কে লেখেন: ‘না জানি বুড়ির খাতাখানি আজকাল কত মোটা হইয়াছে। একবার পড়িতে এমনি ইচ্ছা করে।’
শরৎচন্দ্র তাঁর নিজের জীবনকালে বহু দেশি ও বিদেশি সাহিত্য পাঠ করেছিলেন অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে। যার মধ্যে চার্লস ডিকেন্স, মর্গান, ওয়েস্টার মার্ক, স্পেন্সার, টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, গোর্কি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মিসেস হেনরী উড এবং মারি কোরেলীর উপন্যাসের বড় অনুরাগী ছিলেন শরৎচন্দ্র।
ভাগলপুরে থাকাকালীনই শরৎচন্দ্র লিখে ফেলেন ‘শুভদা’, ‘দেবদাস’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বড়দিদি’ ইত্যাদি গল্প উপন্যাসগুলি। যেগুলি পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
শরৎচন্দ্র যখন বর্মায় ছিলেন (১৯০৩-১৯১৬) তখন শুরু হয় তাঁর দ্বিতীয় পর্বের লেখালেখি। এই পর্বে তিনি লিখেছিলেন—‘বিরাজ বৌ’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘পরিনীতা’, ‘পণ্ডিত মশাই’ ইত্যাদি। তৃতীয় পর্বে (১৯১৬-এর পরবর্তী) শরৎচন্দ্র তখন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাকার, সে সময়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একের পর এক উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘দেনা পাওনা’, ‘পথের দাবী’, ‘শেষ প্রশ্ন’ ইত্যাদি। এইসব উপন্যাসের চরিত্র ও কাহিনি গুলোই তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার উজ্জ্বল প্রতিরূপ হয়ে ওঠে। শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যে একাধিক জনসেবী মানুষের চিত্র এঁকেছেন। রেঙ্গুনে থাকাকালীন তিনি মিস্ত্রি-পল্লীতে দরিদ্র অসহায় মিস্ত্রিদের যথেষ্ট সাহায্য করতেন। গিরীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর ‘ব্রহ্মদেশে শরৎচন্দ্র’ বইয়ে লিখেছেন:
‘‘রেঙ্গুন শহরে যতগুলি ধানের কল, কাঠের কল, ডক-ইয়ার্ড ও ঢালাইয়ের কারখানা প্রভৃতি আছে, তাহাতে ফিটার, ভাইশম্যান ও ঢালাই মিস্ত্রির সমস্ত কাজ বাঙ্গালী মিস্ত্রিদের ছিল একচেটিয়া। অনেক অশিক্ষিত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ সন্তানও এই কাজ শিখিয়া এখানে দৈনিক তিন-চার টাকা রোজকার করে। … ওই পল্লীতে শরৎচন্দ্রের মত শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান কেহই ছিল না। শরৎচন্দ্রের কোনরূপ আত্মভিমান না থাকায় তিনি মিস্ত্রিদের সহিত অবাধে মেলামেশা করিতেন, তাহাদের চাকরির দরখাস্ত লিখিয়া দিতেন, তাদের বিবাদ বিসম্বাদের সালিশ হইতেন, রোগে হোমিওপ্যাথি ঔষধ দিতেন, সেবা-শুশ্রূষা করিতেন, বিবাহাদি উৎসবে যোগদান করিতেন এবং বিপদে পরম আত্মীয়ের ন্যায় ব্যবহার করিতেন। এই সকল সৎগুনের জন্য ওখানকার স্ত্রী-পুরুষ সকলেই শরৎচন্দ্রকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি করিত এবং ‘বামুন-দাদা’ বলিয়া ডাকিত।’’
শরৎচন্দ্র মানুষকে যেমন গভীরভাবে ভালো বাসতেন, তেমনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন শিল্প, সাহিত্য ও পড়াশোনাকে। পড়াশোনার বাতিক তাঁর বরাবরই ছিল। গৃহত্যাগের পরেও তিনি সে অভ্যাস ছাড়েননি। রেঙ্গুনে থাকাকালে প্রিয় বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে এক পত্রে লিখেছিলেন, ‘পড়িয়াছি বিস্তর। প্রায় কিছুই লিখি নাই। গত দশ বৎসর ফিজিও লজি, বাইওলজি অ্যান্ড সাইকোলজি এবং কতক হিস্ট্রি পড়িয়াছি। শাস্ত্রও কতক পড়িয়াছি।’
রেঙ্গুনে থাকাকালীন শরৎচন্দ্র সেখানকার বার্নার্ড ফ্রি লাইব্রেরির সদস্য ছিলেন। ওই লাইব্রেরির অনেক ইংরাজি সমাজনীতি ও দর্শন সম্পর্কিত মোটা মোটা বই সংগ্রহ করে তিনি মনোযোগের সঙ্গে পড়তেন। শরৎচন্দ্র নিজেও প্রচুর বই কিনতেন। কথিত আছে, তিনি এক সাহেবের কাছ থেকে পুরো একটা লাইব্রেরি কিনে নিয়েছিলেন। এইভাবে তাঁর নিজের একটা গ্রন্থাগার গ’ড়ে উঠেছিল।
বাংলা বইয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রচনা তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিল। তিনি নিজে এ সম্বন্ধে বলেছেন, ‘সেই বিদেশে আমার সঙ্গে ছিল কবির খানকয়েক বই—কাব্য ও কথাসাহিত্য এবং মনের মধ্যে ছিল পরম শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। তখন ঘুরে ঘুরে ওই ক’খানা বই-ই বার বার ক’রে পড়েছি।’
রেঙ্গুনে বসবাসকালে শরৎচন্দ্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু যোগেন্দ্রনাথ সরকার তাঁর ‘ব্রহ্মপ্রবাসে শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এমন একদিন ছিল, যেদিন শরৎচন্দ্র আমাদের মতো একজন অধম কেরানি ছিলেন এবং এই রেঙ্গুনের বাঙালি সমাজে তিনি একজন গায়ক বলিয়াই শুধু পরিচিত ছিলেন।’ কথাটা আশ্চর্যরকম লাগলেও তা সত্য। যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা তথা সমগ্র ভারতের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক, তিনি সেকালে রীতিমতো সংগীত চর্চা করতেন। আসলে গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি নিয়ে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের বিপুল সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্যে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর গায়ক সত্তা ও বাদক পরিচিতি। গানের পাশাপাশি তিনি তবলা ও বাঁশিও বাজাতেন। মজঃফরপুরে থাকাকালীন রাত্রিতে ধর্মশালার ছাদে বসে গান গেয়ে সকলকে অবাক করে দেন তিনি। তাঁর সুমধুর কণ্ঠের গান শুনে পথের লোকও দাঁড়িয়ে যেত। সে সময় সুকণ্ঠ গায়ক রূপে শরৎচন্দ্রের খ্যাতি মজঃফরপুরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই গানের সুবাদই শরৎচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় মজঃফরপুরের জমিদার মহাদেব সাহুর সঙ্গে। তিনিও ছিলেন সঙ্গীত প্রিয় মানুষ। তাই অচিরেই শরৎচন্দ্র তাঁর বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।
সাহিত্যিক হিসেবে আত্ম প্রকাশের আগে গায়ক ও বাদক হিসেবে শরৎচন্দ্র যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৮৯৩ সাল থেকে ভাগলপুর বাসের সূচনা থেকেই শরৎচন্দ্র গান-বাজনা নিয়ে মেতে থাকতেন। সেখানকার স্থানীয় আদমপুর ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন একজন নিয়মিত গায়ক। পাশাপাশি তবলাবাদক ও বংশীবাদক হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম ছিল তাঁর। শরৎচন্দ্রের জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় বলেছেন, ‘শরৎবাবুর গানের দিকেই ছিল বেশি ঝোঁক। কণ্ঠস্বর ছিল ভারী মিষ্টি। একবার কোনও গান শুনলে খুব দ্রুত নিজের গলায় তা তুলে নিতে পারতেন।’
শরৎচন্দ্রের বিশেষ পছন্দের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা। রেঙ্গুন পর্বে বেঙ্গল সোশ্যাল ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়মিত গাইতেন। গিরীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন—‘তিনি অধিকাংশ সময় শেষ রাত্রিতে জাগিয়া থাকিতেন এবং অতি প্রত্যুষে আপন মনে কত কী আবৃত্তি করিতেন এবং ধীরে ধীরে মধুর কণ্ঠে গান গাহিতেন। এই আবৃত্তি গানের অধিকাংশই ছিল কবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথের রচনা হইতে।’
শরৎচন্দ্রের জীবনে একটা কলঙ্কের দিক—পতিতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও মেলামেশা। শরৎচন্দ্র যখন ভাগলপুরে থাকতেন, তখনই তাঁর জীবনের ওই দিকটার সূত্রপাত। নিজের মনের দুঃসহ বেদনা ও ব্যর্থতাকে ভুলতেই সম্ভবত শরৎচন্দ্র প্রথমে এপথে পা দিয়েছিলেন। পরে তাঁর গভীর মানবতাবোধ ও সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিও তাঁকে পতিতালয়ে নিয়ে যেত। অসহায় ও দুঃস্থা বেশ্যাদের অর্থ সাহায্য করতেন বলেই পতিতালয়ের মেয়েরা তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত।
পশুপাখি শিকার করা ছিল শরৎচন্দ্রের একটা শখ। ‘বাল্যস্মৃতিতে’ উল্লেখ করেছেন ছিপ ফেলে মাছ ধরার কথা। ব্রহ্মদেশ থেকে ফেরার পরে তাঁর শিকারের নেশা আরও বেড়ে যায়। সে সময় তিনি ভাগলপুরে গঙ্গার চরে বা হাওড়ার রূপনারায়ণের চরে অনেক সময় পাখি শিকার করতে যেতেন। আশ্চর্য ছিল তাঁর মন, যে শরৎচন্দ্র পশুপাখি, মাছ শিকার করে আনন্দ পেতেন তিনিই আবার তাঁর পোষাপাখি, কুকুর ও ছাগলের জন্য দরদ দেখাতেন। তবে দেশি কুকুরদের উপর তাঁর দুর্বলতা ছিল খুবই। তিনি নিজে একদা জীবনের অনেকটা সময় গৃহহীন, অন্নহীন হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন। তাই পথের কুকুরদের উপর তাঁর করুণা হত স্বাভাবিকভাবেই। এ প্রসঙ্গে তাঁর পোষা এক কুকুর ‘ভেলু’র কথা উঠে আসে। তিনি ‘ভেলু’ নামে একটি কুকুর পোষেন। শরৎচন্দ্র যখন শিবপুরে থাকতেন ‘ভেলু’ ছিল তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ‘ভেলু’ অসুস্থ হয়ে মারা গেলে শরৎচন্দ্র ভীষণভাবে দুঃখ পেয়েছিলেন। ভেলুর মৃতদেহ শিবপুরে সমাধিস্থ করেছিলেন।
১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ‘রবিবার’ অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশবাসীকে কাঁদিয়ে চলে গেছিলেন চির বিশ্রামের দেশে। সেদিন তাঁর মৃত্যু-সংবাদে সমগ্রজাতি শোকাভিভূত হয়ে পড়েছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতার মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলী পাঠালেন—
‘যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটি থেকে নিল যারে হরি
দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি।’
সত্যই, বাঙালীর হৃদয় আজও তিনি পূর্ণ করে রয়েছেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে বাঙালী জাতির যে ক্ষতি হয়েছিল, তা অপূর্ণই রয়ে গেছে।