২০২৬ এখনও অনেক দূরে। এই বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোট। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দূর সে তো দূর নয়। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি এবং সিপিএমের তৎপরতা দেখে মনে হয়, ভোট শিয়রে। তাই এই ভোটের প্রস্তুতিতে কোনও দলই পিছিয়ে নেই এখন থেকেই। তৃণমূলের কাছে ছাব্বিশের ভোট অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ভোটে জিতে দল চতুর্থবারের জন্য ক্ষমতার অলিন্দে থাকবে এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চারবার মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসবেন। তাই ভোট বলে কথা! আবার সব দলের নেতানেত্রীরা মানুষের কাছে যাবেন— জোর হাত করে তাঁদের ভোট চাইবেন। ক্ষমতায় এলে তাঁদের জন্য কী কী কাজ করবেন, তার প্রতিশ্রুতি দেবেন। তাই এখন থেকেই সব দলই মাঠে নেমে পড়েছে। কী কৌশল অবলম্বন করতে হবে এই নির্বাচনে তার ছক কষছে। সুতরাং ছাব্বিশের ভোটের চিন্তা থেকে দূরে থাকা যাবে না। সিপিএম এবং বাম দলগুলির কাছেও এই নির্বাচন একটি বিরাট পরীক্ষা। শূন্য থেকে ওঠা যায় কিনা, তার পরীক্ষা।
এই যেমন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই বলে রেখেছেন, ২০২৬ নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে চতুর্থবার ক্ষমতায় বসবে। কিন্তু তার জন্য এখনই তৈরি হতে হবে। তিনি ২৭ ফেব্রিুয়ারি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলীয় সভা ডাকলেন। ভোটার তালিকায় কারচুপির অভিযানে প্রচার এবং সেই ‘জালিয়াতি‘ মোকাবিলায় সাংগঠনিক সক্রিয়তা বাড়াতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নিতে চলেছে শাসক দল। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলীয় নেতা-কর্মীদের এখন থেকেই ভোটের প্রস্তুতির কাজে নেমে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই সভায় উপস্থিত থাকবেন দলের সাংসদ, বিধায়ক, জেলা পরিষদের সভাপতি, সহ-সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষ, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সহ সভাপতি, পুরপ্রধান এবং উপ পুরপ্রধান এবং দলের নেতাদের প্রস্তাবিত এই বৈঠকে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাছাই করে ডাকা হবে দলের রাজ্য, জেলা ও ব্লক স্তরের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকদের। আশা করা যায়, মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে এই ভোটে লড়তে হবে তার একটা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে দেবেন।
আগামী বছরের এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং রাজ্যের বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মধ্যে তরজা শুরু হয়ে গেছে। বিজেপি এর আগের বিধানসভা নির্বাচনেও ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখে শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে মানুষের মধ্যে গিয়ে প্রচারে নেমেছিল। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। তার পাল্টা প্রচারে তৃণমূল কীভাবে এগোবে তার দিশা মুখ্যমন্ত্রী ইন্ডোরের বৈঠকে বলে দেবেন। মমতা বলেছেন, সরকার তার নিজস্ব কোষাগারের টাকায় ১০০ দিনের কাজ এবং আবাস প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছে। সে কথা মানুষকে বুঝিয়ে বলার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার কথাও তুলে ধরতে হবে। কেন্দ্রীয় রাজ্য সরকারের প্রাপ্য টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে বার বার বলা সত্ত্বেও কেন্দ্র রাজ্যের প্রাপ্য টাকা দেয়নি। ফলে রাজ্য সরকার একটা আর্থিক চাপের মধ্যে পড়ে রয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিপন্থী। মমতা তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের বলবেন, তাঁরা যেন সরকারের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের কথা এবং তাতে মানুষের কীভাবে উপকৃত হচ্ছেন, তা প্রচারে তুলে ধরতে। বিরোধীদের অপপ্রচার রুখতে তাঁরা যেন বিশেষভাবে সক্রিয় হন। বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ছাড়া রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কোনও সমালোচনা চলে না।
অপরদিকে কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বও আগামী বছরের পশ্চিমবঙ্গের এখন থেকেই প্রস্তুতির কাজ শুরু করতে রাজ্য বিজেপির নেতা ও কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্য বিজেপির নেতাদের বলেছেন, এই নির্বাচন নিয়ে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে। এই বছরের শেষ দিকে বিহারের ভোট। তা নিয়েও ছক কষথে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা পাওয়ার আশায় দিন গুনছে এই দল। কিন্তু প্রতি নির্বাচনেও দলের ফলে নিরাশ করছে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বকে। তার কারণও আছে, যা ভাবিচে তুলেছে প্রধানমন্ত্রী এবং ভোটের স্ট্র্যাটিজি নির্ধারণকারীকেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য বিজেপির পক্ষে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়া খুব কঠিন। কারণ রাজ্য বিজেপিকে টেনে তুলতে দক্ষ নেতার অভাব। রাজ্য বিজেপির স্থায়ী কোনও সভাপতি নেই। যিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি আবার দলের সাংসদ। সুতরাং রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে যে সক্রিয়তার প্রয়োজন, তা তাঁর নেই। তাছাড়া দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও প্রবল। সুতরাং গত বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখেছিল, কিন্তু সে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। ২০২৬ নির্বাচনে বিজেপি সর্বশক্তি নিয়ে ভেটের মাঠে নামলেও, শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠা অত্যন্তকঠিন। তবুও বিজেপির শীর্ষ নেতারা প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যের আগামী বছরের এই নির্বাচনে প্রচারে আসবেন।
অপর বিরোধী দল সিপিএমও বসে নেই। লোকসভা ও বিধানসভায় আসনের খাতায় দল শূন্য। নেতাদের ভাবনাও বিচ্ছিন্ন। সিপিএমের যে রাজ্য সম্মেলন হয়ে গেল তাতে নেতারা আত্মসমালোচনা করেছেন। কী করে মানুষের সমর্থন পাওয়া যায় তার জন্য তাঁরা আগামী বিধানসভায় উঠেপড়ে লাগবেন। এবার সম্ভবত সিপিএম এবং তাদের সহযোগী বাম দলগুলি এক হয়ে ভোটের ময়দানে নামবে। আরও বেশি করে যুব সম্প্রদায়কে দলে অন্তর্ভুক্তি যাতে করা যায় তার চেষ্টা চালাতে হবে বলে নেতাদের অভিমত। নির্বাচনে ব্যর্থতার কথাও আলোচনায় স্থান পায়। দলের প্রাধান্য রাজ্যের যেসব অঞ্চলে আছে, সেখানে সাংগঠনিক শক্তি কী করে বাড়ানো যায়, তার উপায় আলোচনায় আসে। অপরদিকে কংগ্রেস রাজ্যে দিন দিন দুর্বল হলেও, কী করে শক্তি বাড়ানো যায়, তার চেষ্টায় আছে দল। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য কংগ্রেস কোন পথে চলবে, তা ঠিক করে দেবে।