• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

চতুরঙ্গ

সংস্কৃত, গ্রীক, বাঙলা আর্য ভাষা; আরবী, হীব্রু সেমিতি ভাষা। ফার্সী, উর্দু, কাশ্মীরী, সিন্ধ্রী ও আর্য ভাষা, কিন্তু এদের উপর সেমিতি আরবী ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছে প্রচুর।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

পরবর্তী যুগে এই ফার্সী সাহিত্যই উত্তর ভারতে ব্যাপকরূপে প্রভাব বিস্তার করলো। ভারতীয় মক্তব-মাদ্রাসায় যদিও প্রচুর পরিমাণে আরবী ভাষা পড়ানো হয়েছিল তবু কার্যত দেখা গেল ভারতীয় আর্যগণ ইরানী আর্য সাহিত্য অর্থাৎ ফার্সীর সৌন্দর্যে অভিভূত হলেন বেশী। উর্দু সাহিত্যের মূল সুর তাই ফার্সীর সঙ্গে বাঁধা—আরবীদের সঙ্গে নয়। হিন্দী গদ্যের উপরও বাইরের প্রভাব পড়েছে সেটা ফার্সী— আরবী নয়।

Advertisement

একদা ইরানে যে রকম আর্য ইরানী ভাষা ও সেমিতি আরবী ভাষার সংঘর্ষে নবীন ফার্সী জন্ম গ্রহণ করেছিল, ভারতবর্ষে সেই সংঘর্ষের ফলে সিন্ধী, উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু আরবীর এই সংঘর্ষ ফার্সীর মাধ্যমে ঘটেছিল বলে কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, ভারতবর্ষীয় এ তিন ভাষা ফার্সীর মত নব নব সৃষ্টি দিয়ে ঐশ্বর্যশালী সাহিত্যসৃষ্টি করতে পারলো না। উর্দুতে কবি ইকবালই এ তত্ত্ব সম্যক্ হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন এ নূতন সৃষ্টির চেষ্টা করে উর্দুকে ফার্সীর অনুকরণ থেকে কিঞ্চিৎ নিষ্কৃতি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

Advertisement

একমাত্র আরবী-ফার্সী শব্দের বেলা অনায়াসে বলা যেতে পারে যে, এই দুই ভাষা থেকে ব্যাপকভাবে আর নূতন শব্দ বাঙলাতে ঢুকবে না। পশ্চিম বাঙলাতে আরবী-ফার্সীর চর্চা যাবো যাবো করছে, পূব বাঙলায়ও এ সব ভাষার প্রতি তরুণ সম্প্রদায়ের কৌতূহল অতিশয় ক্ষীণ ব’লে তার আয়ু দীর্ঘ হবে ব’লে মনে হয় না এবং শেষ কথা, আরব-ইরানে অদূর ভবিষ্যতে যে হঠাৎ কোনো অভূতপূর্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা আরম্ভ হয়ে বাঙলাকে প্রভাবান্বিত করবে তার সম্ভাবনাও নেই।

কিন্তু যে সব আরবী-ফার্সী শব্দ বাঙলাতে ঢুকে গিয়েছে তার অনেকগুলো যে আমাদের ভাষাতে আরো বহুকাল ধরে চালু থাকবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, এবং দ্বিতীয়তঃ কোনো কোনো লেখক নূতন বিদেশী শব্দের সন্ধান বর্জন ক’রে পুরনো বাঙলার—’চণ্ডী’ থেকে আরম্ভ ক’রে ‘হুতোম’ পর্যন্ত— অচলিত আরবী-ফার্সী শব্দ তুলে নিয়ে সেগুলো কাজে লাগাবার চেষ্টা করছেন।

কিছুদিন পূর্বেও এই এক্সপেরিমেন্ট করা অতিশয় কঠিন ছিল, কিন্তু অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে বাধ্য হয়ে পুরনো বাঙলা পড়তে হয়— তারা এই সব শব্দের অনেকগুলো অনায়াসে বুঝতে পারবে ব’লে অচালিত অনেক আরবী-ফার্সী শব্দ নূতন মেয়াদ পাবে।

এই পরিস্থিতির সামনে জীবন্মৃত এ সব শব্দের একটা নূতন খতেন নিলে ভালো হয়।

সংস্কৃত, গ্রীক, বাঙলা আর্য ভাষা; আরবী, হীব্রু সেমিতি ভাষা। ফার্সী, উর্দু, কাশ্মীরী, সিন্ধ্রী ও আর্য ভাষা, কিন্তু এদের উপর সেমিতি আরবী ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছে প্রচুর। উত্তর ভারতের অন্যান্য ভাষাদের মধ্যে বাঙলা এবং গুজরাতিই আরবী ভাষার কাছে ঋণী, কিন্তু এই ঋণের ফলে বাঙলার মূল সুর বদলায়নি। গুজরাতির বেলাও তাই।

হীব্রু এবং আরবী সাহিত্যের ঐশ্বর্য সর্বজনবিদিত। ঠিক সেই রকম প্রাচীন আর্য ভাষা ফার্সী তার ভগ্নী সংস্কৃতের ন্যায় খৃষ্টের জন্মের পূর্বেই সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিল। আরবরা যখন ইরান জয় করে তখন তারা ইরানীদের তুলনায় সভ্যতা সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ। কিন্তু তারা সঙ্গে আনলো যে ধর্ম, সেটি জরথুস্ত্রী ধর্মের চেয়ে প্রগতিশীল, সর্বজনীন এবং দুঃখীর বেদনা উপশমকারী। ফলে তাবৎ ইরান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো এবং আপন ভাষা ও সাহিত্য বর্জন করে আরবীকে রাষ্ট্রভাষা ও সংস্কৃতির বাহনরূপে স্বীকার করে নিল। আরবী ভাষা ও সাহিত্যে তাই ইরানীদের দান অতুলনীয়।

চারশত বৎসর পরে কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হল। ইরানীদের আপন ভাষা তখন মাহমুদ বাদশার উৎসাহে নবজন্ম লাভ ক’রে নব নব সাহিত্য-সৃষ্টির পথে এগিয়ে চললো।

(ক্রমশ)

Advertisement