হারিয়ে গেল গাজনের সেই গান

Written by SNS April 14, 2024 4:22 pm

প্রতি বছর চৈত্র মাসে শিবভক্তরা লোহার বাণ, বঁড়শি নিজেদের শরীরে বিদ্ধ করত৷ ১৮৩৪ সালে আইন করে এই প্রথা বন্ধ করে দেয় সরকার৷ তবে চৈত্রের শেষ বিকেলে সঙ ও বহুরূপী সেজে শহর পরিক্রমা করত এই ভক্তের দল৷ সঙ্গে গাইত বিভিন্ন রসের ছড়াগান৷ সেই গান নিয়ে লিখেছেন ধ্রুবজ্যোতি মণ্ডল

‘শুনো গো নগরবাসী বছরে বারেক আসি
হাসি হাসি পুরাতনে দিতে গো বিদায়৷
রজনী প্রভাত হলে চৈত্র যাবে চলে,
নববর্ষ হর্ষে আসি বসিবে ধরায়’৷

এ হল গাজনের গান৷ আজ থেকে শতবর্ষ আগে চৈত্রের শেষ বিকেলে চড়ক পূজার পাশাপাশি জেলেপাড়া এবং তার আশপাশের অঞ্চল থেকে সঙ বেরোতো বেশ জাঁকজমক করেই৷ তারাই বহুরূপী সেজে শহর পরিক্রমা করতো, গাইতো এমন সব রসের ছড়াগান৷ বসতো মেলাও৷ এইভাবে হতো বর্ষশেষের উদ্যাপন৷ বলতে গেলে চড়ক ও গাজন বঙ্গজীবনে এমনভাবে মিশে ছিল যে, দু’টি অনুষ্ঠানকে আলাদা করা মুশকিল৷ সেই কলকাতা আজ অতীত৷ এখন পয়লা বৈশাখের আগে অন্য ছবি৷ ‘ভোলে বাবা পার করেগা, ত্রিশূলধারী পার করেগা’, বলতে বলতে শিবভক্তদের বাঁকে করে গঙ্গাজল নিয়ে গিয়ে তারকেশ্বর বা অন্যত্র বাবার মাথায় জল ঢালার হিডি়ক৷ এখানেও আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ভক্তদের মুহুর্মুহু গর্জন ভেসে আসে, কিন্ত্ত কলকাতার রাস্তায় গাজনের সেই ব্যঙ্গকৌতূকে ভরা মিঠেকড়া গান আর শোনা
যায় না৷

তখনকার দিনে চড়ক উৎসব দুর্গাপুজোর মতোই বড় উৎসব ছিল৷ খোদ ইংরেজ কর্তাব্যক্তিরা এতে অংশগ্রহণ করতেন৷ হুতোম প্যাঁচার নকশা-র হুতোম অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ মশাই সেকালের কলকাতার চড়কের যে বিবরণ দিয়ে গেছেন, তা সত্যি মজার৷ তাঁর লেখার এক জায়গায় চড়ক সম্বন্ধে বলেছেন, ‘কলিকাতা শহরের চারিদিকে ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্ছে৷ চড়কীর পিঠ সড়সড় কচ্চে৷ কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে৷ সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নূপুর, মাথায় জরির টুপি, কোমরে চন্দ্রহার, সিপাই পেডে় ঢাকাই শাডি় মালকোচা করে পরা৷ তারকেশ্বরের ছোবানো গামছা হাতে, বিল্বপত্র বাঁধা সুতো গলায় যত ছুতোর, গয়লা ও কাঁসারীর আনন্দের সীমা নাই— আমাদের বাবুদের বাডি় গাজন৷’ আসলে তখনকার কালে বাবু সংস্কৃতিটা এমনই ছিল৷ বাবুনির্ভর৷ বাবুই সব৷ বাবুর আনন্দ তো আমারও আনন্দ৷

এই গাজন নিয়ে অনেক গল্প আছে৷ শোনা যায়, গাজন উৎসব নাকি শিব-পার্বতীর বিবাহ উৎসব৷ সন্ন্যাসীরা সব বরযাত্রী৷ সন্ন্যাসীদের গর্জন থেকেই নাকি ‘গাজন’ কথার উদ্ভব৷ বঙ্গে আর একটি কাহিনী প্রচলিত আছে৷ বাণ রাজা শিব তপস্যা করেছিলেন৷ সেই কারণে শিবভক্তরা প্রতি বছর চৈত্র মাসে শিব ঠাকুরের আরাধনা করে লোহার বাণ, বঁড়শি নিজেদের শরীরে বিদ্ধ করত৷ তাদের দেহ রক্তাক্ত হতো৷ অনেকে মারাও যেত৷ তাই সরকার ১৮৬৪ সালে আইন করে ওই প্রথা বন্ধ করে দেয়৷ কিন্ত্ত তাহলেও ইতিহাসের পাতায় সেই চিত্র আজও জাগ্রত৷ তার দৌলতে চৈত্র শেষে আজও অনুভূত হয়

সেই আক্ষেপ,
‘‘আগে এই চৈত্র শেষে
আমাদের এই বঙ্গদেশে,
সন্ন্যাস মেনে শিবোদ্দেশে,
সবাই পার্বণ কত্তো চড়কে৷
তখন জ্যান্ত ছিল দেশের লোক,
শরীরে শক্তি মনে রোক,
খেতে পেত যা’ হোক তা’ হোক,
হয়নি সব গাঁ উজোর ম্যালেরিয়া মড়কে৷’’
গাজন নিয়ে এই যেসব ছড়া তখনকার দিনে বাজার মাতিয়ে রাখত তা কিন্ত্ত নিছক মজা নয়, সমাজ সচেতনার টনিকও বটে৷ আবার পরবর্তীকালে সেইসব আনন্দঘন দিনগুলি না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকেও অনেক ছড়া রচিত হয়েছে৷ যাই হোক, যে জেলেপাড়া নিয়ে আমরা এত নস্টালজিক সেই স্থান এখন নিতান্তই একটা পাড়া মাত্র৷ তবে উত্তর এবং মধ্য কলকাতার অক্রুর দত্ত লেন, রমানাথ কবিরাজ লেন সংলগ্ন এই স্থান একদিন সত্যিই প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছিল৷ ইতিহাস বলে, তখন এখানে সব মৎসজীবীরা থাকতেন৷ সম্ভবত বাংলার ১৩২০ সালে চৈত্র সংক্রান্তিতে এই তল্লাটে প্রথম সঙ সেজে শোভাযাত্রা শুরু হয়৷ এখানেই প্রথম৷ এরপর তা ছডি়য়ে পরে খিদিরপুর, কাঁসারি পাড়া, তালতলা, বেনেপুকর, হাওড়ার শিবপুর, খুরুট, শ্রীরামপুর, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে৷ তবে জেলেপাড়ার সঙ নিয়েই সাধারণ মানুষের মধ্যে মাতামাতি ছিলো বেশি৷ হয়তো এই ছড়া গানের শোভাযাত্রায় সমাজের অনাচার আর দুর্নীতির উপর কষাঘাত করার প্রবণতা বেশি ছিল বলে৷ তখনকার দিনে রূপচাঁদ পক্ষী, রসরাজ অমৃতলাল বসু, দাদাঠাকুর, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, সজনীকান্ত দাস, হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, কবিশেখর কালিদাস রায় প্রমুখ স্বনামধন্যরা জেলেপাড়ার সঙের জন্য গান লিখতেন৷ ১৯১৭ সালে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চুরি হয়ে গেল তখন এইসব বিদগ্ধ নাগরিকরাই লিখেছিলেন,
‘বিদ্যার মন্দিরে সিঁদ কেটেছে কোন চোরে
সখীরা নেকী নাকি পড়লো ফাঁকি
কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে
বিদ্যা সর্ববিদ্যা অধিকারী
দেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী,
বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে৷’
রসিকেরা বুঝতে পেরেছিলেন, এ গানের আড়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী থেকে শুরু করে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সকলকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে৷ এইজন্যই জেলেপাড়ার এত সুখ্যাতি৷ সঙের মিছিল সাধারণত বার করত জেলে, কাঁসারি, মুচি, শ্রমজীবী মানুষের দল৷ কোথাও কোথাও সকালে শুরু হয়ে সন্ধ্যায় শেষ হত শোভাযাত্রা৷ সে শোভাযাত্রায় থাকত মিলিটারি ব্যান্ডের বাজনা৷ দ্রাবিড় ব্রাহ্মণের দল, ধোবার কাপড় কাচা, ঘানিতে সর্ষের ঘুরপাক, মোসাহেব-সর্বস্ব বাবুদের নানা ভড়ং, কৃষ্ণ আর গোয়ালিনীদের প্রেম, ভণ্ড সাধু ভক্তদের কাঁধে চেপে মন্ত্র জপে আর ইতিউতি চায় প্রভৃতি সামাজিক প্রথার রীতিনীতি নিয়ে ব্যঙ্গ করা হতো সঙের গানে৷ কখনো নব্য আইনে বিয়ের প্রথা নিয়ে শ্লেষ এসব লেগেই থাকত৷ কখনো গণ্যমান্যরা সভ্যতা-ভদ্রতা নিয়ে বারংবার সচেতনার জ্ঞান দিলে তারও প্রতু্যত্তরে আওয়াজ উঠত সঙের মিছিল থেকে৷ কখনো অতি সাধারণ বাডি়র ছেলেদের অহেতুক বাবুগিরি নিয়ে সঙের দল সোচ্চার হয়ে বলত,
‘‘বলিহারি দুনিয়াদারি বাবুগিরি কি মজার,
ঘটলো লেঠা কেবা কেটা বাপের ব্যাটা চেনা ভার৷
বাপ কারো নগদা মুটে, মা বেটি বেচে ঘুঁটে,
ছেলে তাদের ‘রিষ্টু’ এঁটে দেয় গো বাহার৷’’
আবার তথাকথিত ইঙ্গবঙ্গ যুবকদের ভাবগতিক নিয়েও তখনকার দিনে সঙের দল গান গাইতো,
‘এখন ছেলেরা এক নতুন টাইপ
চোদ্দ না পেরতে পাকা রাইপ,
মুখে আগুন ঢুকিয়ে পাইপ,
একমাত্র লাইফ ধারণ ওয়াইফ-এর
চরণ করতে ধ্যান,
এরা নতুন অর্থ করেন গীতার,
ভুল ধরেন পিতার
নৈলে কি তার ট্রায়াল বিনা ইন হয়৷’
অষ্টাদশ শতকের এই চড়কে সন্ন্যাসী এবং সঙের মিছিলের একটা ছবি এঁকেছেন বিদেশি চিত্রকর স্যার চার্লস ডগলাস৷ ১৯২৬ সালে মিউনিসিপ্যাল গেজেটে তা ছাপা হয়৷ জানা যায়, যাত্রার আসরেও সঙের নাচগানের ব্যবস্থা থাকত৷
সঙের দলে ছড়া লিখতেন দাদাঠাকুর অর্থাৎ নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত৷ হার্ড ব্রাদার্স আর কুক কোম্পানির মহিষে টানা ট্রাক গাডি়তে চাঁদোয়া আর ঝালর ঝুলিয়ে এদের সঙ বেরোতো৷ সঙের দল খালি পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচতে নাচতে এগিয়ে যেত রৌদ্রতপ্ত পথে৷ একবার কালীঘাট সংলগ্ন এলাকায় লম্পট ও নেশাখোরদের উপদ্রব বাড়তে দেখে জেলেপাড়ার সঙ তীব্র কষাঘাত করে তাদের গানে জানালো,
‘দেবতারা সব নিদ্রাগত
নৈলে মানুষের কি সাহস এত
Garden party চলছে কত
কালীঘাটের পীঠস্থানে৷’
কাঁসারি পাড়ার সঙের উৎসাহদাতা ছিলেন প্রখ্যাত ধনী তারকনাথ প্রামাণিক আর হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক কৃষ্ণদাস পাল৷ সেখানে কাটরা গাডি়তে সঙ ঘুরতো৷ বাডি়র বারান্দায়, জানলায় আবালবৃদ্ধবনিতা সঙের শোভাযাত্রা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো৷ গৃহস্থ ঘরে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য তৈরি হতো শরবৎ আর পান তামাকের ব্যবস্থা৷ ১৩৩৬ সালে অমৃতলাল বসু যে বছর মারা যান সেবছর শোভাযাত্রায় সঙের দল মনের দুঃখে গেয়েছিল,
‘এ বছর কপাল পোড়া
ভেঙে গেল রসের ঘড়া,
তাই তো এবার সঙের ছড়া
হয়নি তেমন মিঠেকড়া৷’
বঙ্গজীবনে এই ব্যঙ্গাত্মক গান এমনই এক চেহারা নিয়েছিল যে শেষপর্যন্ত ইংরেজ সরকারও এটাকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলো৷
‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার যত বিদেশি তস্কর,
সজাগ হয়েছে দেশবাসী, মজুর চাষী লস্কর,
আমরা হয়েছি এক, কেরানি উকিল মাষ্টার,
আমরা তোমাদের লুটতে দেব না আর৷’
কিংবা
‘বছরের শেষে গাও ভাই হেসে হেসে,
স্বরাজের গান, হয়ে এক প্রাণ,
গোলামী আর সহে না…৷’
অথবা
‘হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান,
সবার এই দেশ, সবার এই স্থান,
সবার তরে আমরা স্বরাজ চাই…৷’
আসলে হাসি মস্করা রঙ্গ রসিকতা উনিশ শতকের মানুষকে শুধু মজাই দেয়নি, নানা সামাজিক পরিস্থিতিতে এটা একটা অন্যতম হাতিয়ারও হয়ে উঠেছিল৷ সঙের মিছিলে তারা উচ্চকন্ঠে বলেও দিত সেকথা,
‘মোদের এ সঙ নয় শুধু কালি মেখে সঙ সাজা,
নয়কো শুধু হালকা হাসি, নয়কো শুধু মজা৷
সংসারেতে সাজার ওপর সাজেন যিনি যে যা,
তারি ছবি দেখাই সবে সহজ ভাষায় সোজা৷
সমাজনীতি, ধর্মনীতি, শিক্ষানীতি আদি,
বলতে গিয়ে কারো প্রাণে ব্যথা দি যদি৷
ক্ষমা করবেন, সবার কাছে এই মোদের মিনতি
সত্যের ভাষণ সত্যের গানই মোদের সঙ-এর নীতি৷’

অবশ্য সেকালে বছরভর অনেক অনুষ্ঠানেই সঙ বেরতো৷ তার মধ্যে ছড়াগানে ‘গাজন’ই ছিল শ্রেষ্ঠ৷ এখন তার আর অবশিষ্ট নেই৷ চড়ক পুজো আছে৷ কিন্ত্ত তার সেই ভয়াবহ আচার অনুষ্ঠান আর দেখা যায় না৷ গ্রাম বাংলায় কোথাও কোথাও আজও চড়কের ঝাঁপ হয়৷ শিব মন্দিরে পুজো দিয়ে সন্ন্যাসীর দল উঁচু বাঁশের মাচায় উঠে সেখান থেকে ঝাঁপ দেন বটে কিন্ত্ত সুরক্ষার কারণে নিচে জাল খাটিয়ে রাখা হয়৷ সন্ন্যাসীরা তাতে পডে়ন৷ এই হল আধুনিক চড়ক আর তাকে ঘিরে মেলা৷ ঢাক ঢোল, কাঁসরঘন্টা, হইহুল্লোড়, কেনাবেচায় আনন্দে মেতে ওঠেন মানুষজন৷
আনন্দ ফুরোয় না, কারণ পরের দিন নববর্ষ৷ সেও এক ছুটির দিন, মজার দিন৷ আনন্দের দিন৷