ক্যালকাটা পারফর্মিং আর্টসের আয়োজনে চৌধুরী হাউস মিউজিক ফেস্টিভ্যালের এবার ছিল দশম বর্ষ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির চৌধুরী বাড়িতে বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত এই শাস্ত্রীয় সংগীতের ফেস্টিভাল যেন প্রতিবছরের মতো শাস্ত্রীয় সংগীত পিপাসুদের কাছে একটা বড় আকর্ষণ। তবে এইবার শিডিউল খানিকটা এগিয়ে জানুয়ারি দশ থেকে বারো তারিখ ছিল এই অনুষ্ঠান। একটা জিনিস বলতে হবে… শহরে একই সাথে অনেকগুলো সংগীত অনুষ্ঠান চলার কারণে হোক অথবা শিল্পী নির্বাচনের কারণেই হোক … মারকাটারি ভিড়ের অনুপস্থিতি এবারে চোখ এড়ালো না ! প্রতিদিন বেলা দুটো থেকে শুরু হয়ে চলে অনুষ্ঠান চলল বেশ রাত অবধি।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় সৌরভব্রত চক্রবর্তীর সুরবহারে । রাগ ভীমপলাশী ধ্রুপদী স্টাইলে (রুদ্রবীণা স্টাইলে) পরিবেশন করেন। আলাপ-জোড়-ঝালা এবং চৌতালে গত; পরে পরজ-বসন্তে আওচার ও ধামারে গত পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন দেবপ্রতিম দাস । এরপর ছিল জনাব ফারুক লতিফ খাঁ-এর একক সারেঙ্গীবাদন। চয়নে ছিল রাগ শুদ্ধ-সারং; আলাপ-জোড়-ঝালা পর্বের পর তিন লয়ে গতকারি (ত্রিতাল, একতাল ও ত্রিতাল)। ছিল পরে শোনালেন পিলু । তবলায় সহযোগ দেন জনাব বিলাল খাঁ সালোনভি। এরপর ছিল কন্ঠসঙ্গীত শিল্পী শোভা চৌধুরীর খেয়াল পরিবেশনা পর্ব । শুরুতে গাইলেন রাগ ধানি; দুটি বন্দিশ আর তারপর ছিল রাগ মারোয়া পরিবেশনা। তবলায় ছিলেন অশোক দত্ত, হারমোনিয়ামে রতন ভট্টাচার্য। সাত্যকি দত্ত সরোদ বাজালেন। রাগ পুরিয়া- কল্যাণে আলাপ জোড়ের পর গত পরিবেশন করেন। শুভ্রাংশু চক্রবর্তী ছিলেন তবলায় । সান্ধ্যকালীন পর্বে এরপর ছিল ভুবনেশ কোমকলির কন্ঠসংগীত (পন্ডিত কুমার গান্ধর্বের পৌত্র)। রাগ শুদ্ধ কল্যাণ গাইলেন বড়ো খেয়াল। দুই লয়ের দুটি বন্দিশ লাগে অত্যন্ত উপভোগ্য এবং আনন্দদায়ক । এই পরিবেশনায় সহযোগ দেন আশীষ সেনগুপ্ত (তবলা)। এই সন্ধ্যার শেষ হয় সৌমাল্য চক্রবর্তীর সেতারে রাগ বাগেশ্রী পরিবেশন মাধ্যমে। আলাপ -জোড়, এরপর বিলম্বিত ও দ্রুত (ত্রিতালে) গত বাজিয়ে শোনান । তবলায় ছিলেন কুমুদ রঞ্জন সাঁতরা।
দ্বিতীয় দিন অপরাহ্ণে অনুষ্ঠান শুরু হয় কত্থক নৃত্য মাধ্যমে; পরিবেশন করলেন সুপ্রভা মুখার্জি । পরিবেশন ছিল কৃষ্ণস্তুতি, ত্রিতাল এবং শেষে অভিনয় পর্ব। এরপরে শুরু হয় গান – বাজনার অনুষ্ঠান। কলকাতার সংগীত মহলে পরিচিত কন্ঠশিল্পী সুপ্রিয় দত্ত পরিবেশন করেন রাগ ভীমপলাশী। তিনটি বন্দিশে পরিবেশনাকে সাজান । উৎসাহব্যঞ্জক উপস্থাপনা। সহযোগ দেন অসিত জানা (তবলা) ও প্রদীপ পালিত (হারমোনিয়াম)। তবলা এককে এরপর ছিলেন কৌশিক সেন। তাকে হারমোনিয়ামে নগমা দেন সুব্রত ভট্টাচার্য। পিতা – পুত্রী প্রবীণ শিওলিকর ও চৈতালি শিওলিকরের দ্বৈত বেহালা পরিবেশন । পুরিয়া-ধানেশ্রীতে বিলম্বিত (একতাল) ও দ্রুত (ত্রিতাল); পরে দেশ ঠুংরি দিয়ে সমাপন ঘটান। তবলায় ছিলেন সৌমেন সরকার। আগ্রা ঘরের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী ভারতী প্রতাপ ছিলেন এই সন্ধ্যার অপর আকর্ষণ। তার চয়নে ছিল জয়জয়ন্তী। নোম-তোম আলাপের পর বিলম্বিত (একতাল) ও দ্রুত ত্রিতাল বন্দিশ (ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের রচনা)। শেষ করলেন পঞ্চম হিন্দোলি রাগে (তাল দীপচন্ডী)। বিভাস সাংহাই (তবলা) ও হিরন্ময় মিত্র ছিলেন হারমোনিয়ামে। সেনিয়া- মাইহার ঘরের বিশিষ্ট সরোদিয়া পন্ডিত বসন্ত কাবরা ছিলেন দ্বিতীয় সন্ধ্যার শেষ শিল্পী। শোনালেন রাগ চন্দ্রনন্দন । বিলম্বিত ও দ্রুত গতে বাজনা উপহার দেন। পরে ছিল মিশ্র মান্ড এবং একটি রাগমালা। উপভোগ্য এই পর্বে তবলায় ছিলেন পন্ডিত পরিমল চক্রবর্তী।
তৃতীয় দিনের উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবেশনার মধ্যে গৌতম কালের কণ্ঠসঙ্গীত এবং লোকেশ আনন্দের সানাই বাজনার কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। দুজনেই মেওয়াতি ঘরানার শিল্পী (গুরু পন্ডিত যশরাজ)। গৌতম কালে শোনান রাগ পুরিয়া; বিলম্বিত (একতাল), মধ্যলয় (ঝাঁপতাল) ও দ্রুত (ত্রিতাল)। আর পরে স্তোত্র “গোবিন্দ দামোদর মাধবেতি” শোনালেন । তবলায় ছিলেন আশিস সেনগুপ্ত, হারমোনিয়ামে কমলাক্ষ মুখোপাধ্যায়। সানাইতে লোকেশ বাজালেন রাগ পটদীপ। আওচার, তারপরে ছিল দুখানি গত। ভালো লাগে তার রাগের বিস্তার পর্ব। তবলায় ছিলেন শিলিগুড়ি থেকে আসা সুবীর অধিকারী। সেতারে দেবজ্যোতি গুপ্ত মধুবন্তী রাগটিকে চয়ন করেছিলেন; পরে পাহাড়ি ধুন শোনান। তবলায় হাল ধরেছিলেন রূপক ভট্টাচার্য। কণ্ঠশিল্পী রোজি দত্ত গাইলেন রাগ যোগকৌষে খেয়াল। আলাপ এবং পরে দুখানি বন্দিশ। সহযোগী শিল্পীরা ছিলেন কৌশিক সেন (তবলা) ও কমলাক্ষ মুখার্জি (হারমোনিয়াম)। এই বছরের মত ফেস্টিভ্যালের সমাপন ঘটে বিশিষ্ট বাঁশি শিল্পী অজয় প্রসন্ন ও রাগ বাগেশ্বরী পরিবেশনে। প্রথমে আলাপ ও জোড়, এবং তারপর রূপক তাল ও দ্রুত ত্রিতালে গত পরিবেশন। তবলায় সহযোগ দেন কুমুদরঞ্জন সাঁতরা।