গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন অফ কালচার আয়োজিত ‘বিবেকানন্দ মিউজিক ফেস্টিভ্যাল’ অনুষ্ঠিত হল ‘বিবেকানন্দ হল’-এ (১২ই জানুয়ারী)। বরাবরের মতই সঙ্গীতোৎসবটি বিভক্ত ছিল তিন পর্বে – প্রভাতী, দ্বিপ্রাহরিক ও সান্ধ্য। প্রভাতী অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে বিবেকানন্দের সঙ্গীতপ্রীতি ও মানবঅন্তরে তার প্রভাব এবং সঙ্গীতের আধ্যাত্মিক শক্তি নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন স্বামী সুপর্ণনন্দ মহারাজ। এবারের অনুষ্ঠান সম্পর্কে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, এই প্রথম মঞ্চ সাজানো হয়েছিল সেকালের কোলকাতার প্রেক্ষাপটে সে সময়ের বাড়ীর বৈশিষ্ট্যময় নকশার গবাক্ষযুক্ত দেওয়াল ও নানান ঝাড়বাতির রোশনাইতে – যা সৃষ্টি করে স্মৃতিমেদুরতা। প্রভাতী অনুষ্ঠানের শুরু সিকর ঘরানার সারেঙ্গিবাদক সুলতান খানের পুত্র সাবির সুলতান খানের মনোগ্রাহী সারেঙ্গীবাদনে। রাগ টোড়ীতে আলাপ, ত্রিতাল বিলম্বিত ও দ্রুতে যথার্থ ও বৈচিত্র্যময় স্বরসঙ্গতির মাধুর্যময় বিন্যাস, শব্দক্ষেপণের সৌন্দর্য ও নিয়ন্ত্রণ, নমনীয় বাদন শৈলীতে গায়কী অঙ্গে বোলবাণী ও শব্দ উৎপাদনের সুকৌশল, তানকারির স্বচ্ছতা তাঁর পরিবেশনকে দিয়েছে স্বতন্ত্রতা। তবলায় পরিমল চক্রবর্তীর সংযত সহযোগিতায় ও ‘বাজ’-এর নৈপুণ্যে বোল-টুকড়াগুলি অনুষ্ঠানকে দিয়েছে অন্য মাত্রা।
এদিনের বিশেষ আকর্ষণ বেনারস ঘরানার বর্তমান চূড়ামণি সাজন মিশ্র। তিনি জৌনপুরী (বিলম্বিত একতাল, মধ্যলয় ত্রিতাল, দ্রুত ত্রিতাল), তরানা ও ভজন নিবেদন করলেন তাঁর পুত্র সারাংশকে নিয়ে। জৌনপুরীর কারুণ্যময় লালিত্য ও পৌরুষের আবরণে ঘরানার বৈশিষ্ট্যে গায়নকৌশলের সৌকর্যময় উৎকৃষ্টতা, বন্দীশের কহন্-কৌশল, শব্দপ্রক্ষেপণের অসাধারণত্ব, সরগমের অনন্যতা ইত্যাদি সাজনজীর দরাজ কণ্ঠের গায়কীতে উদ্ভাসিত। সারাংশ নিঃসন্দেহে বর্তমান প্রজন্মের প্রতিভা। তাঁর স্বরসঙ্গতি বলার সৌন্দর্য ও সরগম-তান প্রশংসনীয়। চমৎকার একটি তরানা পরিবেশনের পর শেষে প্রচলিত ভজন (চল মন্ বৃন্দাবন) ছিল মনোগ্রাহী। সহযোগী তবলা শিল্পী বিশ্বখ্যাত স্বপন চৌধুরীর কথা নতুন করে বলা বাতুলতা। আগাগোড়া সংযত এই শিল্পী সময়মত দেখিয়েছেন তাঁর অনবদ্য ‘বাজ’-এর কিছু ঝলক। হারমোনিয়মে অভিজ্ঞ, প্রবীণ জ্যোতি গোহ ছিলেন যথাযোগ্য সহযোগী।
এটাওয়া ঘরানার প্রখ্যাত সেতার শিল্পী নিশাত খানের প্রথম পরিবেশন বিলাসখানি টোড়ী – আলাপ, জোড়, ঝালা। আলাপ ও জোড়ে শিল্পী শোনালেন গায়কী অঙ্গে খেয়াল ও ধ্রুপদ মিশ্রিত স্বরবিন্যাস। সঠিক স্বরসঙ্গতির লালিত্যময় আলাপ, তন্ত্রীতে মীড়-মোচড়ের কৌশল ও স্ট্রোকের অলংকরণের সৌকুমার্যে রাগটির রূপ ভৈরবীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিখুঁতভাবে বিকশিত। স্বতঃস্ফূর্ত, অতি পরিষ্কার তানকারী ও ঝালার উৎকৃষ্টতা বোঝায় শিল্পীর স্তর। পরবর্তী টোড়ী বন্দীশে (ত্রিতাল মধ্যলয়) ছিল গায়কী অঙ্গের বোলবাণী এবং ‘জমজমা’ ও ‘জরব’-এর সুন্দর ব্যবহার। দ্রুত ত্রিতালে অপর একটি বন্দীশে হয় তাঁর অনুষ্ঠানের শেষ। এখানে উল্লেখ্য শুভাজ্যাতি গুহর নমনীয় ও স্বচ্ছ স্ট্রোকে সংযত, সমঝোতাপূর্ণ তবলা সঙ্গত, এবং বোল-টুকড়া। অপরাহ্নের অনুষ্ঠানের সূচনা বেনারসের নৃত্য শিল্পীদ্বয় যমজ ভ্রাতা সৌরভ ও গৌরব মিশ্রের কথক নৃত্যে। শিববন্দনার পর ত্রিতালে বিভিন্ন বোলে নৃত্যশৈলীর প্রদর্শনের সঙ্গে পায়ের কাজে বৃষ্টি ও মেঘগর্জনের আওয়াজ ও উৎকৃষ্ট তৎকার প্রদর্শন করলেন ভ্রাতৃদ্বয়। এর পর তিন রূপের ভাও প্রদর্শন, ঘুংরুর আওয়াজে কথোপকথন ও দ্রুত পায়ের কাজ খুবই আকর্ষণীয়। বেনারসের বিখ্যাত তবলিয়া সঞ্জু সহায় ও গুরু রবি শঙ্কর মহারাজ ছিলেন সঙ্গত ও বোল-পড়ন্তে। তাদের বোল-টুকড়ার সঙ্গে নৃত্যশিল্পীদের সওয়াল-জবাব আনন্দদায়ক।
কণ্ঠসঙ্গীত ও বাঁশীর দ্বৈত পরিবেশনায় ছিলেন জয়তীর্থ মেভুণ্ডি ও প্রবীণ গোরখিণ্ডি। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুন্দর তবলা সহযোগিতায় এদের পরিবেশন মধুবন্তী – রূপক বন্দীশ, দ্রুত ত্রিতাল, তরানা, এবং বৃন্দাবনী সারং (দ্রুত ত্রিতাল) ও শেষে ভজন। জয়তীর্থের আলাপ ও বিভিন্ন অঙ্গের কাজ বাঁশীতে শোনালেন প্রবীণ। দুজনেই শোনালেন সরগম, তান্, গমক তান, দ্রুত তান এবং তরানার বিভিন্ন অঙ্গ। বৃন্দাবনী সারং বন্দীশে ছিল সওয়াল-জবাব। সমগ্র অনুষ্ঠান এবং শেষে ‘বাজে রে মুরলিয়া’ ভজনটির দ্বৈত প্রদর্শনে শিল্পীদের কাছে শ্রোতাদের আরও প্রত্যাশা ছিল। সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানের শুরু ধ্রুপদ ও রুদ্রবীণার দ্বৈত পরিবেশনে। সুবিখ্যাত রুদ্রবীণাবাদক বাহাউদ্দীন ডাগর ও ধ্রুপদগায়ক নির্মাল্য দে ডাগরবাণী শৈলীর বাদক ও গায়ক। রাগ মারোয়ার আলাপে এঁদের পরিবেশন সৃষ্টি করে এক গাম্ভীর্যময় আবহ।
ধ্রুপদের বিশেষ শৈলীর আলাপে দুই শিল্পীই দেখালেন নৈপুণ্য এবং বীণার গাম্ভীর্যময় শুদ্ধ গায়কীতে কণ্ঠের মডিউলেশনগুলি পাওয়া যায় নিখুঁতভাবে। আলাপের পর প্রথাগতভাবে দুটি বন্দীশের নিপুণ পরিবেশনে শেষ হয় শিল্পীদ্বয়ের অনুষ্ঠান। দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত বেহালা শিল্পী এল সুব্রহ্মনিয়ম ও তাঁর সুপুত্র অম্বি দক্ষিণী শৈলীর বেহালাবাদনে মুগ্ধ করলেন শ্রোতাদের। অতি দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ, দক্ষিণী ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে পারদর্শী লক্ষীনারায়ণের ছড়ের যাদুতে, অপূর্ব নিয়ন্ত্রণে, মোচড়ে নিঃসৃত সুরধারা যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনই সুতালিমপ্রাপ্ত অম্বির বাদনকৌশলের নৈপুণ্য ও মিষ্টত্ব আকশর্ণীয়। এদের পরিবেশন – বর্ণম (আভোগী/আদি তাল), রাগম-তালম-পল্লবী (নাসিকাভূষণী)। সহযোগী শিল্পীরাও ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে মহীরুহ- তবলায় তন্ময় বোস, মোরসিংয়ে সত্য সাই জি, মৃদঙ্গ বাদনে পারুপল্লী এবং ঘটমে রাধাকৃষ্ণন। সমগ্র অনুষ্ঠানে অন্যান্য সহযেোগী শিল্পীদের মধ্যে সুসহযোগিতায় ছিলেন হিরণ্ময় মিত্র (হারমোনিয়ম), সুখদ মুণ্ডে (পাখোয়াজ)। অনুষ্ঠানটি সুগ্রন্থিত করেন বিপ্লব গাঙ্গুলি ও কোরক বসু।