নির্মল ধর
অস্কার পুরস্কারে ভারত একটা রেকর্ড করল বটে, পুরস্কার ঘরে আসবে কিনা, সেই প্রশ্ন সরিয়ে এখন স্বীকার করতেই হচ্ছে— খোদ অস্কারের ইতিহাসেও এমন ঘটনা ঘটেনি। একই দেশের দুই পরিচালকের দু’টি ছবি অস্কারে সেরা বিদেশি ছবির জন্য লড়াইয়ে। আমরা জানি— ভারতীয় সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করছে নীরজ ঘাওয়ানের ‘হোমবাউন্ড’। এই কলকাতা শহরে বসেই অস্কার নির্বাচক কমিটি ঘোষণা করে গেছেন দু-সপ্তাহ আগেই।
Advertisement
এবার খবর এলো প্রশান্ত মহাসাগরে পাপুয়া নিউ-গিনি দ্বীপপুঞ্জের বন্দর রাজধানী মোরসবি থেকে। ওই দেশের পর্যটন শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বেলদন নর্মান নামাহ, জাতীয় সংস্কৃতি কমিশনের এক্সিকিউটিভ আধিকারিক এবং অস্কার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান ড. ডন নীলস জানিয়েছেন, ‘এই প্রথম পাপুয়া নিউ-গিনি অস্কার পুরস্কারে অংশ নিচ্ছে। ছবির নাম— ‘পাপা বুকা’। পরিচালক ভারতীয় ডা. বিজু দামোদরণ। আনন্দের বিষয় আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিরও এটা সুবর্ণজয়ন্তী বছর।
Advertisement
তাই নিজেদের টক-পিসিন ভাষায় তোলা এই ছবি আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছেছে।’ ছবিটি প্রযোজনা করেছে ‘নাফা’ সংস্থার ব্যানারে নোলেনা তউলা উনাম। এবং ভারতীয় আংশিক প্রযোজক হিসেবে রয়েছেন অক্ষয় পারিজা এবং পারুল আগরওয়াল। ছবির পরিচালক ডা. বিজু (এই নামেই বেশি পরিচিত) মালায়ালম সিনেমায় খুবই পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম। তিন-তিনবার জাতীয় পুরস্কার জিতেছে তাঁর ছবি। ইন্ডিয়ান প্যানোরামা তো বটেই, সাংহাই, জাকার্তা, জাঞ্জিবার, ব্রিসবেন ফিল্ম উৎসবে তাঁর ‘বার্ডস উইথ লার্জ উইঙ্গস’, ‘সাউন্ড অফ সাইলেন্স’, ‘দ্য ট্রিজ আন্ডার দ্য সান’ ছবিগুলো প্রশংসিত ও পুরস্কৃত। এই কলকাতার উৎসবেও ডা. বিজু পরিচিত মুখ।
ডা. বিজু দামোরণ গত বছরই তেহরানের ফজর ফিল্ম উৎসবে এই প্রতিবেদককে আভাস দিয়েছিলেন এই ছবির। শুধু বলেছিলেন, ‘কলকাতার ঋতাভরী চক্রবর্তীকে চেনো! অভিনেত্রী কেমন!’ বলেছিলাম—‘কাজ খুব কম করে এবং ভালোই করে।’ বিজু পাল্টা জানিয়েছিলেন— ‘ওঁকে নিয়ে একটা প্রজেক্ট ভাবছি!’ কথোপকথন ওখানেই শেষ।
ক’দিন আগে প্রায় আচমকাই পাপুয়া নিউ-গিনির অস্কার প্রতিযোগিতায় পাঠানো ছবি ডা. বিজুর ‘পাপা বুকা’ দেখার সুযোগ হল। এই ছবির কাহিনীর সঙ্গে ভারতের এক ঐতিহাসিক যোগাযোগও রয়েছে। কী সেই যোগ? ছবির প্রধান দু’টি চরিত্র ভারতীয় ইতিহাসবিদ — রোমিলা চ্যাটার্জি (ঋতাভরী) এবং আনন্দ কুনহিরমন (প্রকাশ বারে)। একজন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ, অন্যজন কেরালার দলিত। দু’জনেই পাপুয়া নিউ-গিনি গেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনা এবং অস্ট্রেলিয়া সেনার সঙ্গে প্রায় চল্লিশ হাজার ভারতীয় সেনাও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তাঁদের অনেকেরই হদিশ নেই। সেই হদিশ হারানো সৈনিকের মধ্যে রোমিলার দাদুও নাকি ছিলেন এমন একটা আভাস দিয়ে এই দুই ইতিহাসবিদের নিউ-গিনি অভিযান।
তথ্য বলছে চল্লিশ হাজার ভারতীয় সৈনিকের মধ্যে অন্তত তিরিশ হাজার সুভাষচন্দ্র বসুর আইএনএ-তে যোগ দিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে রোমিলার দাদুও ছিলেন— এমনই একটা বিশ্বাস! ওখানে গিয়ে পরিচয় হয় ‘পাপা বুকা’ নামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে— তিনিও অংশ নিয়েছিলেন যুদ্ধে আইএনএ-র হয়ে। এই অশীতিপর বৃদ্ধই রোমিলা ও আনন্দকে গভীর ও প্রত্যন্ত জঙ্গল পেরিয়ে নিয়ে চলে উপজাতির গ্রামে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাড়ি খারাপ হওয়ায় কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছতে পারে না। এবং ‘পাপা বুকা’ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই দীর্ঘ যাত্রাপথেই পাপা বুকার মুখ থেকে শোনা যায়, আধুনিক সভ্যতার বাইরে থাকা পাপুয়া নিউ-গিনির আদিবাসীরা এখনও তাঁদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখছে! ছবির প্রাণবিন্দু পাপা বুকার মুখনিঃসৃত কাহিনী।
পরিচালক ডা. বিজু অত্যন্ত মরমি ভঙ্গিতে রোমিলা— আনন্দের বন্ধুত্বের পাশাপাশি অতীতের ইতিহাসকে ক্যামেরায় ধরেছেন। ওই দ্বীপ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে উঠে এসেছে নাচ-গান এবং প্রকৃতি-নির্ভরতার ঘটনাও। বিজুর আগের একাধিক ছবিতে দর্শক তাঁর প্রকৃতি প্রেমের পরিচয় পেয়েছিল। ‘পাপা বুকা’ ব্যতিক্রম নয়। ছবির সঙ্গীত ও আবহ’র দায়িত্বে রয়েছেন তিনবারের গ্রামি জয়ী শিল্পী রিকি কেজ। ছবিতে ওই দেশের নিজস্ব ভাষা ছাড়াও ব্যবহার হয়েছে বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজিও। ছবির সমাপ্তিটি বড় করুণ এবং হৃদয়গ্রাহী। দুই ইতিহাসবিদের পথপ্রদর্শক পাপা বুকা’র মৃতদেহকে তাঁরা ছেড়ে আসতে পারে না। আবার তাঁরা ফিরে যায় বৃদ্ধের গ্রামে, অতীত যোদ্ধাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে সমাধিস্থ করার দায়িত্ব নেয় দু’জন। সাধারণ মানুষ ইতিহাসকে ভুলে গেলেও ওঁরা ভুলতে চায় না, পারেও না। এখানেই বিজুর এই ছবি হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক।
কলকাতার ঋতাভরী চক্রবর্তী সবসময়েই অন্য ধরনের চরিত্র পছন্দ করেন। গ্ল্যামারাস নায়িকা সাজার চাইতে ছবির চরিত্র ও বক্তব্যে কিছু গঠনভূমিকা থাকলে তাঁর সেটাই পছন্দ। প্রায় একমাস ওই দ্বীপ দেশে থেকে ঋতাভরী অভিনয় করেছেন। রোমিলার চরিত্রে তিনি প্রাণ সঞ্চার করেছেন বলতেই পারি। তুলনায় তাঁর সহশিল্পী প্রকাশ বারে একটু আড়ষ্টই। তবে এই ছবির প্রাণভোমরা পাপুয়া নিউ-গিনির মাটির মানুষ বর্ষীয়ান সিনে বোবোরো অর্থাৎ পাপা বুকা চরিত্রের শিল্পী। খুবই স্বাভাবিক সহজ অভিনয়! অভিনয়ই বা বলি কেন, তিনি সত্যিই যেন এক হারিয়ে যাওয়া যোদ্ধার ভূমিকায়।
পাপুয়া নিউ-গিনির এই ছবি অস্কার জুরিমণ্ডলীর নজর কাড়তে পারবে কিনা—সেটা যেমন কোটি ডলারের প্রশ্ন, তেমনই এই ছবি প্রায় অবহেলিত পূর্ব বিশ্বের এক ছোট্ট দ্বীপ দেশের অ-জানা ইতিহাসকে আন্তর্জাতিক জগতের সামনে নিয়ে আসবে—এটাই বড় প্রাপ্তি! নীরজ ঘাওয়ানের ‘হোম বাউন্ড’-এর সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনা নয়, বরং অস্কারে দু’জন ভারতীয় পরিচালকের ছবি একই বিভাগে রয়েছে, এটাই বড় আনন্দ সংবাদ।
Advertisement



