চিকিৎসক সনৎকুমার ঘোষের পুত্র নচিকেতা ঘোষ, বাবার ইচ্ছেয় ডাক্তারি পাশ করেছিলেন ঠিকই— কিন্তু তাঁর মন পড়ে ছিল সুরের রাজ্যে। সনৎবাবুর শ্যামবাজারের ভিটেয় যাতায়াত ছিল শাস্ত্রীয় সংগীতের বহু স্বনামধন্য শিল্পীর। সেই মজলিশ থেকেই রস আহরণের শুরু। ছোট থেকেই সংগীতে নচিকেতা তালিম নিয়েছিলেন উস্তাদ দবির খান এবং সংগীতাচার্য অনাথ বসুর কাছ থেকে। সেই তালিমই তাঁকে কালক্রমে প্রবাদপ্রতিম সুরকার করে তুলল।
বাবা হিসেবে কীরকম ছিলেন নচিকেতা ঘোষ?
গানের সময় বিরক্ত করা যেত না বাবাকে। খুবই রাগী মানুষ ছিলেন। মা, ছোটবেলায় আমাকে স্নান খাওয়া করিয়ে, বাবার সঙ্গে পাঠাতেন শ্যামবাজারের বাড়ি। সেখানে দারুণ অভিজ্ঞতা হতো। কখনও গৌরীকাকা (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) গান লিখছেন, বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসেছেন গান তুলতে, মান্না দে কিংবা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আমি বাবার পাশে বসে গান শুনতে শুনতে কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন তবলচিকে দিয়ে বাবা আমায় বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।
বম্বেতে থাকাকালীন বাবা নিজেই স্কুলে দিয়ে আসতেন। হি ওয়াজ আ ভেরি ডেডিকেটেড ফাদার। কলকাতায় ফিরে আসার পর, বাবার সঙ্গে বাজাতে শুরু করলাম। রিদম সেন্সটা ওই সময়ই তৈরি হল। গ্রামাফোন কোম্পানি থেকে যখন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-র এলপি বেরোল, রেকর্ডিংয়ে আমি ছিলাম। নতুন সুর বাবা টেপ করতেন না। আমাকে আর আমার দুই বোনকে শিখিয়ে দিতেন মনে রাখার জন্য। আমি গোবিন্দ বসুর কাছে দশ বছর তবলা শিখেছি, প্রায় দশ বছর গিটার শিখেছি খোকন মুখার্জির কাছে,পরে পিয়ানো শিখেছি ট্রিনিটি কলেজ অফ লন্ডন থেকে। মিউজিশিয়ান থেকে রিদিম অ্যারেঞ্জার হয়েছি,বাবা চলে যাওয়ার পরে সুরকারও হয়েছি। কিন্তু মিউজিক শেখার হাতেখড়ি বাবার কাছেই।
নচিকেতা ঘোষের সুর তৈরির সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু ঘটনার কথা বলুন না।
সুচিত্রা সেন ও উৎপল দত্ত অভিনীত ‘ফরিয়াদ’ ছবির দুটো অসাধারণ ঘটনা আছে। মিসেস সেন বললেন, আমি একটু গানগুলো শুনতে চাই। তো বাবা কথা দিলেন তিনি যাবেন। ওই ছবিতে একটি গান ছিল, ‘নাচ আছে গান আছে রূপের তুফান আছে/ যা কিছু কিনতে চাও কেনো না, শুধু চোখের জল তুমি চেও না’। গানটার শেষে একটা হাসি আছে, হাসতে হাসতে কান্না আছে। সুচিত্রা সেন বললেন, ‘ওই হাসির জায়গাটা আমিই হাসব, আমারই গলা থাকবে।’ বাবা রাজি হলেন, রেকর্ড করলেন হাসিটা। কিন্তু ওঁর চেষ্টা থাকতে শিল্পীদের মধ্যে থেকে তাঁদের বেস্টটা বের করে আনার।
ফলে বম্বেতে গিয়ে গানটা গাওয়ানোর সময় আশাজিকে বললেন, ‘গানটা তুমিই করবে কিন্তু হাসির জায়গাটা মিসেস সেন করে দিয়েছেন। তুমি শোনো টেপটা। এর থেকে ভালো কি পারবে তুমি!’ আশাজি শুনে বললেন, ‘ম্যায় এক হস কে দুঙ্গি। শুনকে দেখিয়ে আগর উয়ো পসন্দ আতা হ্যায়।’ আশাজি অতুলনীয় করলেন গানের শেষের সেই হাসি এবং কান্নার অভিনয়টা। বাবা ইচ্ছে করেই সুচিত্রা সেনের গলাটা শুনিয়েছিলেন, যাতে তাঁর থেকে ভালো আশাজি করতে পারেন। সেই টেপ মিসেস সেনকে শোনানো হলে তিনি বললেন, ‘এর চেয়ে পারফেক্ট আর কিছু হতে পারে না। আমি লিপ দেব এই হাসিতে।’
নচিকেতা ঘোষ মিউজিক তৈরিতে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করতেন বলে শোনা যায়। তেমন কোনও দৃষ্টান্ত কি দেবেন?
ওই ‘ফরিয়াদ’ এর জন্যই বাবা, প্রোডিউসার ডা. দেবনাথ রায়কে বলেছিলেন, টাইটেল মিউজিকে ম্যাকাও পাখির গলা টিপে ধরলে যে-আওয়াজ বেরোয়, সেটা আমার চাই। ক্যাপিটাল নার্সিং হোমের মালিক দেবনাথবাবু বললেন, ‘এ কীকরে সম্ভব!’ বাবা বললেন ‘হবে, চলুন।’
এরপর ওঁরা গেলেন নিউ মার্কেটে। সেখানে তখন বিদেশি পাখি বিক্রি হতো। ম্যাকাও বের করে ট্রেনারের সাহায্যে তার আওয়াজ শোনা হল। পছন্দ হল। কিন্তু পাখিটা এক ফুটের এদিকে তার ল্যাজ ছয় ফুট। সেই পাখি স্টুডিয়োতে আনা হবে কীকরে! বাবা বললেন, ‘কুছ পরোয়া নেই, নার্সিং হোমের একটা অ্যাম্বুলেন্স দিন, পাখি তাতেই যাবে।’
টেকনিশিয়ানস স্টুডিয়োতে গিয়ে পাখি আর ডাকে না। লাল বল, লাল রুমাল দেখিয়েও তার ডাক বের করতে পারল না ট্রেনার। এদিকে শিফটের খরচ বাড়ছে, প্রডিউসার বিরক্ত। বাবা কিন্তু হার মানলেন না। দেবনাথবাবুকে বাইরে বসতে বলে, শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে, অবশেষে করলেন সেই রেকর্ডিং। তখন তো ইকো মেশিন ছিল না। একটা ফাঁকা ঘরে পাখিকে ঢুকিয়ে ইকো এফেক্ট তৈরি করলেন রেকর্ডিস্ট সত্যেন চ্যাটার্জি। সেটাই ছবিতে ব্যবহার হল।
শিল্পীদের সঙ্গে নচিবাবুর যে-অন্তরঙ্গতা ছিল, সে বিষয়ে কিছু বলুন।
‘বন্ধু’ ছবির গান ‘মউ বনে আজ মউ জমেছে’ আর ‘মালতী ভ্রমরে’ গান দুটো বাবার কাছে শিখতে এসেছেন হেমন্তবাবু। তিনি শুনে বললেন, ‘আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ গান মৌ বনে আজ।’ কিন্তু মালতী ভ্রমরের বিষয়ে বললেন, ‘নচিবাবু আমি এটা কী করে গাইব, এ তো মানবের (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়) গান!’
বাবা বললেন, ‘এই গান আপনি গান, এটা হিট তো করবেই, এমনকী ছবি রিলিজ করবে যখন, দেখবেন এই গানের লাইন নিয়েই ছবিটার পাবলিসিটি হবে।’ ঠিক সেটাই হল।
আরেকটা ঘটনা হল, নির্মলা মিশ্রর গান পর পর দু’বছর হিট করেনি বলে, এইচএমভির এমডি নির্মলাকে বলেছিলেন— ‘এই বছর হিট না করলে, আর পুজোয় তোমার গান হবে না।’ বাবার কাছে এসে কান্নাকাটি করলেন নির্মলা। বললেন, ‘আমায় বাঁচান এটা আমার সারা বছরের রোজগার।’ বাবা রেকর্ডিং ম্যানেজারকে বললেন, ‘আমি নির্মালার জন্য গান তৈরি করব অ্যাট মাই ওন রিস্ক এবং আমার রয়্যালটির এগেনস্টে এই গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি।’ সে বছর পুজোয় গান রিলিজ হওয়ার পর নির্মলা পিসি জানতে এলেন, ‘বিক্রি কেমন?’ বাবা বললেন, ‘বাড়ি গিয়ে বসে থাকুন আপনি। এবছর পুজোয় গান করেছে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জি, আরতি মুখার্জি, কিশোর কুমার, আরডি বর্মন। সবার চেয়ে বেশি বিক্রি আপনার।’ জানেন কোন গান? ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’।
সেই সময়ের বেশির ভাগ হিট গানের মুখড়া কিন্তু বাবারই লিখে দেওয়া। ‘যদি কাগজে লেখ নাম’-এর প্রথম চার লাইন বাবার লেখা। এরকম অসংখ্য গান আছে। সেটা সম্পর্কের খাতিরেই করতেন। বাবা আইকন মনে করতেন, শচীন দেব বর্মন, অনুপম ঘটক এবং রবীন চট্টোপাধ্যায়কে। খুব পছন্দ করতেন, সলিল চৌধুরী, আরডি বর্মন, মদন মোহন আর শংকর জয়কিশনকে। এঁরাও খুব ভালোবাসতেন বাবার গান। আসলে বাবার স্বকীয়তাই তাঁকে সবার থেকে আলাদা করেছে।