• facebook
  • twitter
Wednesday, 12 February, 2025

শতবর্ষের সুরকার : নচিকেতা ঘোষ

খুবই আশ্চর্য লাগে, যে এই কিংবদন্তী সুরস্রষ্ঠাকে কোনোরকম পুরস্কার বা সম্মান দেওয়ার কথা কারোর মনে হয়নি, তা সে তাঁর সময়েই হোক, বা পরেই হোক।

সুরকারেরা অনেক চেষ্টা করেও যেটা তৈরি করতে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যেতেন, সেটাই খুব স্বচ্ছন্দে সাবলীলভাবে করে দেখানোর ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল এই মানুষটির। গানের নাটকীয়তা অনুযায়ী তাতে অনন্য সব দৃশ্যপট রচনা করতে পারতেন। রাগরাগিনী, পাশ্চাত্যধর্মী, প্রাদেশিক বিভিন্ন সুর নিয়ে এমনই অনবদ্য সব সুরসৃষ্টি করে গেছেন, যা এই মানুষটিকে আজও চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। মানুষটির আত্মবিশ্বাস যেমন ছিল, তেমন খুঁতখুঁতানিও ছিল যথেষ্ট।

এমনও ঘটেছে, নিজের করা সুর পছন্দ হয়নি বলে একই গানের চারটে পৃথক পৃথক সুর করেছেন। নিজে এত ভালো গান গাইতে পারলেও পরবর্তীকালে স্বকণ্ঠে গান রেকর্ড না করে শুধুই সুরস্রষ্ঠা হয়ে ওঠেন। যা সুর করেছেন, সবই হিট। একই ব্যক্তির এত রকম বিচিত্রধর্মী কাজ – যে আপাতভাবে চিন্তাই করা যায় না।

‘শেষ দেখা সেই রাতে’,’মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’,’এমন একটি ঝিনুক’, ’বন্য বন্য এ অরণ্য ভালো’, ‘ওই লাল গোলাপটা’ কিংবা ‘চলো রীণা’,’বনে নয় মনে মোর পাখি আজ’- একেকটা সুর একেকটা থেকে আলাদা। কথার ভাবের আবেগে ভেসে না গিয়ে কোন ধরনের ‘টাচ’ দিলে গানটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, সে ব্যাপারে তিনি কোথাও যেন সবাইকে ছাপিয়ে যেতে পারতেন। সবসময় গানের মুডটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষ হিসেবে নিজেও ছিলেন অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, মেজাজী, অথচ অন্যদিকে দিলখোলা, মজার এবং যথেষ্ট আন্তরিক। কোন গান কার গলায় বেশি ভালো ফুটবে-সে ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। বিখ্যাত নামের থেকেও শিল্পী কেমন গাইলেন- সেইটাই তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে উঠতো। এ ব্যাপারে ঝুঁকি নিয়েছেন, অনেকক্ষেত্রেই সফলও হয়েছেন। বাঙালি পেয়েছে কালজয়ী কিছু বাংলা গান। যাঁর কথা বলছি, সেই মানুষটির নাম নচিকেতা ঘোষ।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় থেকে সনৎ সিংহ, পিন্টু ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, ললিতা ধর চৌধুরী, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় – এঁরা তো আছেনই- লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, এমনকি মহম্মদ রফিও নচিকেতা ঘোষের সুরে গান গেয়েছেন -বিখ্যাত সব গান। উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎকেও নিজের সুরে গান গাইয়েছেন।

জন্ম ১৯২৫ সালের ২৮ শে জানুয়ারি উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। দিনটা ছিল সরস্বতী পুজো। বাবা স্বনামধন্য ডাক্তার সনৎকুমার ঘোষ একসময় ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের নিজের চিকিৎসক হিসাবেও কাজ করেছেন। বিখ্যাত বাবার ইচ্ছে ছিল, যে বড়ো ছেলে ডাক্তার হোক। বাবার ইচ্ছেমতো নচিকেতা ঘোষ আরজিকর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করলেও সুর নিয়ে ছুরি কাচি চালানোতেই দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন।

বাবার মতোই মেধাবী ছিলেন নচিকেতা ঘোষ। চাইলেই ডাক্তারী পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে পারতেন। কিন্তু গান তৈরির সাধনায় সঙ্গীত পরিচালকের অনিশ্চিত জীবনকেই নিজের ইচ্ছেয় বেছে নিয়েছিলেন।

ভালোবাসা আর দায়িত্ব কোনোদিন ওঁর জীবনে একে অপরের কাছে অন্তরায় হয়নি। নচিকেতা ঘোষ নিজেও সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। প্রথম জীবনে গায়ক হিসাবে কয়েকটা গান(কঁহা সে আও দিনগয়ে বীত, যব প্রেম দিওয়ানে প্রেম -এই দুটো গীত ছাড়াও ‘পথ আরও কত দূর’, ‘নতুন রূপকথা’, ‘প্রিয়ার বাড়ি দক্ষিণে’, ‘আজ তুমি ভুলে গেছো’ ইত্যাদি পাঁচটি রেকর্ড মিলিয়ে মোট ১০ টি মতো গানের সন্ধান পাওয়া গেছে) রেকর্ড করলেও পরবর্তীকালে ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে সুরসৃষ্টিতেই সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন।

ছোটোবেলা থেকেই ওঁর শ্যামবাজারের বাড়িতে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞদের আসর বসতো। আসতেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, সুবল দাশগুপ্ত, কানা সাতকড়ি, কমল দাশগুপ্ত প্রমুখেরা। সেখানে তবলা সঙ্গত করতে গিয়েই গানের প্রতি ভালবাসার শুরু। আচার্য অনাথ বসু, উস্তাদ দ্রাবিড় খানের কাছে ছোটোবেলা থেকেই সঙ্গীত শিক্ষাগ্রহণ করেন।

মাত্র তেইশ বছর বয়স থেকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করা শুরু। জয়দেব সিনেমায় সুরসৃষ্টি করে প্রথম সাফল্য পান। একে একে পথের শেষে, নবজন্ম, পৃথিবী আমারে চায়, বন্ধু, চাওয়া-পাওয়া থেকে মৌচাক, নগর দর্পনে, স্ত্রী, সন্ন্যাসী রাজা, ধন্যি মেয়ে, অসাধারণ -প্রভৃতি বিভিন্ন সিনেমায় অসাধারণ সব সুরসৃষ্টি করে গেছেন। চল্লিশের দশকের শেষ থেকে গানে সুর তৈরি শুরু। মাঝে ষাটের দশকের শুরুর দিকে আট দশ বছর বোম্বে থাকলেও পরে আবার কলকাতায় চলে আসেন, এবং নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আরও নতুন ডাইমেনশনের গান তৈরি করেন। ১৯৬৯ সালে ‘শেষ থেকে শুরু’ সিনেমায় কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘বল হরি হরি বোল’(কিশোরকুমার ওই একটি গানই নচিবাবুর সুরে গেয়েছিলেন)। এছাড়া ‘চিরদিনের’ ‘বিলম্বিত লয়’,’নিশিপদ্ম’, ‘ফরিয়াদ’ -এসব সিনেমার গান তো চিরকালীন।

বাংলা গান নিয়ে আজও ওঁর অবদান যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়৷ প্রায় প্রত্যেক শিল্পীর কণ্ঠে সেরা বাংলা গানের মধ্যে নচিকেতা ঘোষের সুরে কোনো না কোনো গান আছেই। এমন হয়েছে একই বছরে বিভিন্ন ধরনের শিল্পীকে দিয়ে বিভিন্ন রকমের গানে সুর দিয়ে সবগুলোই হিট করিয়েছেন।

‘পাখির কূজন শুনে’,‘মানুষ খুন হলে পরে’,’কান্দো কেনে মন রে’, ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে’, ‘ওরে মন মাঝি তোর’,’মৌ বনে আজ মৌ’, ‘পুতুল নেবে গো’,’শরীরখানা গড়ো’,’খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার’,’নীড় ছোটো ক্ষতি নেই’,’এবার মলে সুতো হব’,’নদীর যেমন ঝর্ণা আছে’-ইত্যাদি অসংখ্য চিত্রগীতিতে ওঁর অমর সুরসৃষ্টি আজও সঙ্গীতপিপাসু বাঙালিকে শান্তি দেয়।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর ছিলেন ওঁর পছন্দের কণ্ঠ। যে কোনো ধরনের ট্রাডিশন ভাঙা এই সুরস্রষ্ঠা লতাজিকে দিয়ে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েছেন, ‘নবজন্ম’ সিনেমায় উত্তমকুমারকে দিয়ে প্লেব্যাক করিয়েছেন, তেমনি উত্তমকণ্ঠে একমাত্র গানের রেকর্ড ‘এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে’, কিংবা বিশ্বজিৎকে দিয়ে ‘তোমার চোখের কাজলে’ -গানগুলোর সুরকার স্বয়ং নচিকেতা ঘোষ। মান্না দে নচিকেতা ঘোষের সুরে প্রথম যে গান গেয়েছিলেন তা ছিল হিন্দি সিনেমা ‘ছোটা সা সাওয়াল’-র টাইটেল সং। ভালো গানের জন্য উনি সবকিছু করতে পারতেন।

‘নিশিপদ্ম’ সিনেমার টাইটেল সং-এর জন্য চিত্রপরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গান লিখিয়ে তাতে উনি নিজে সুর দিয়ে সেই গান শ্যামল মিত্রকে দিয়ে গাইয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় শ্যামল মিত্রর তখন পা ভাঙা। ওই অবস্থায় এম্বুলেন্সে করে স্টুডিওতে এসে উনি গান রেকর্ড করেন, এবং গানটি কালজয়ী হয়( গানটি ছিল- রাজার পঙ্খী উইড়া গেলে)।

এমনও হয়েছে, বোম্বে প্রবাসী গীতিকার মুকুল রায়কে দিয়ে শুধু হেমন্তের জন্যই গান তৈরি করিয়েছেন। আবারও মহম্মদ রফি নচিবাবুর সুরে মুগ্ধ হয়ে বিনা পারিশ্রমিকেই ‘ইন্দ্রাণী’ সিনেমায় গান গেয়ে ফেলেন। সিনেমার গান ছাড়াও বাংলা আধুনিক গানে এমনকি ছোটোদের জন্য করা রাক্ষস-খোক্ষস, ঠাকুরমার ঝুলির গানগুলো আজও যথেষ্ট মনোগ্রাহী। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া সিনেমাতেও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন।

মানুষ হিসেবে নিজে খুব সংসারী ছিলেন। গান তৈরীর পাশাপাশি সন্তানদের দেখাশোনাটাও খুব মন দিয়ে করতেন। ওঁর রান্নার হাতও ছিল খুব ভালো। নিজে যেমন খেতে ভালোবাসতেন ও তেমনি অতিথি আপ্যায়ন করে খাওয়াতেও পছন্দ করতেন। ওঁর গান তৈরি নিয়ে বিভিন্ন মজাদার গল্প শোনা যায়। ভালো গানের জন্য এইরকম হন্যে হয়ে চেষ্টা করা বোধহয় তিনি বলেই পারতেন। রোজ সকালে উঠে গানের রেওয়াজের ব্যাপারেও ওঁর কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ছিল।

নিজের খেয়ালে থাকতেই ভালোবাসতেন। স্ত্রী শিবানী দত্ত এবং এক পুত্র, দুই মেয়েকে নিয়ে ছিল ওঁর সুখের সংসার। কিন্তু দুর্ভাগ্য এটাই যে, অসাধারণ মাপের এই সুরস্রষ্ঠা সময়ের বড্ড আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। হার্ট অ্যাটাকে মাত্র একান্ন বছরে কলকাতাতেই তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৬ সালের ১২ অক্টোবর। কন্যা শ্রাবণী মণ্ডল, সম্পূর্ণা মজুমদার, এবং পুত্র বিশিষ্ট সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ আজও পরম শ্রদ্ধায় কালজয়ী সুরস্রষ্ঠা পিতার স্মৃতি তর্পণ করে চলেছেন।

খুবই আশ্চর্য লাগে, যে এই কিংবদন্তী সুরস্রষ্ঠাকে কোনোরকম পুরস্কার বা সম্মান দেওয়ার কথা কারোর মনে হয়নি, তা সে তাঁর সময়েই হোক, বা পরেই হোক।

এ বছর নচিকেতা ঘোষের জন্মের শতবর্ষ। বাংলা গান নিয়ে নতুনভাবে ভাবার এই সময়ে অমর সুরকার নচিকেতা ঘোষ ও তাঁর সুরসৃষ্টি নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। আজকাল নচিকেতা ঘোষের সুরারোপিত প্রচুর সব গান এখনকার শিল্পীরা বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে পরিবেশন করেন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের শ্রোতারা নচিকেতা ঘোষকে কতটা চেনে-জানে সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। সেইসব বিখ্যাত গানগুলো গাইলেও সুরকারের নামটি বিস্মৃতই রয়ে যায়। মানুষের আজ সময় নেই যে বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠান, আলোচনার দ্বারা ওঁর মতো এইরকম মানুষগুলোকে একটু শ্রদ্ধা জানাবে। শ্রদ্ধা করার জন্যও যে মনটা দরকার।