• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

যে কথা বলা হয়নি

সেই আমাদের এক পুরোনো ভারতবর্ষ ছিল। কৃষিপ্রধান, গ্রামীণ অর্থনীতি-ভিত্তিক। যৌথ পরিবার ছিল, মানুষে-মানুষে বিশ্বাস ছিল, ভালোবাসা ছিল। উন্নয়নের প্রলোভন দেখিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি সামাজিক অস্থিরতা, ঘৃণা আর ভেদাভেদ। লিখছেন কথাকার রাজেশ কুমার

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

সেই এক আশ্চর্য সময়ে এসেছিলে তুমি। পাহাড়ের গায়ে মেঘের ছায়ার মতো স্নিগ্ধ দুটো চোখ মেলে। মাথার ওপরে তখন ঘোরলাগা আকাশ। পাকা গমের মতো আলো ফুটে বেরোচ্ছে কোথা থেকে যেন এক ঈশ্বরীয় আশীর্বাদে। শরতের শুরুতে প্রতিমা গড়ছেন এক বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী। বাঁশের ভারায় ঝোলানো লন্ঠনের আলোয় একটু একটু করে যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে কোনও এক অপার সম্ভাবনা, বহু প্রতীক্ষার পর যা ভরিয়ে তুলবে মাঠ, ঘাট, সোনার তরী, গৃহস্থের উঠোনে বাঁধা ধানের মরাই। প্রাণের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত কিছু। শরতের নীল আকাশের নিচে স্বচ্ছ জলাশয়ে ঘাড় উঁচু করে খেলে বেড়াবে মরাল-মরালী। থেকে থেকে তীক্ষ্ণ আমুদে চিৎকারে ভরিয়ে তুলবে আকাশ বাতাস। খুশিতে ভরিয়ে দেবে চারদিক।

মগ্ন সেই মৃৎশিল্পী তুলির টানে এঁকে দিচ্ছেন দুটো গভীর চোখ। আশ্বাস আর আশ্রয়ের যেন মেলবন্ধন। সেই কবেকার কিশোরী তুমি তাকিয়ে আছো অপার বিষ্ময়ে। জগতের সীমারেখা এসে দাঁড়িয়েছে যেন তোমার সম্মুখে মৃৎশিল্পীর সম্মোহনী জাদুতে। তুমি ভুলে গেছ তোমার স্মৃতি, সত্তা, গতজন্মের যত আকাঙ্ক্ষা। ভুলে গেছ গাছে বাঁধা সেই সব ঢিলেদের কথা যা ঝুলিয়েছিলে খেলার ছলে সেই কোনকালে কীসের যেন চাহিদায়, কাদের যেন আরোগ্যমুক্তির প্রার্থনায়। যেন অপেক্ষা করে আছ নদীর ধারে ফুটে ওঠা কাশফুলের। ভোরের শিশির আর তাজা শিউলির। সেই সব সম্মোহনের মাঝে মগ্নতার কাছে সামান্য বিরতি নিয়ে সেই বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী স্নেহভরে হঠাৎ-ই ছুঁয়ে দিলেন তোমার দু’গাল। হাতের নিপুণ টানে সৃষ্টি করলেন নয়নাভিরাম দুই হ্রদ। গভীর অথচ শান্ত। যেন বহু যুগের জমা হওয়া পবিত্র জল। সেই কোনকালে কোন অনির্দিষ্ট সময় সাক্ষী রেখে তুমি হয়ে উঠলে আমার প্রথম প্রেমিকা। প্রেমের প্রথম অনুভূতি। সম্মতি জানালে দু’গালে টোল ফেলা লাজুক হাসিতে। বৃদ্ধ সেই মৃৎশিল্পীর নাম, ঠিকানা আমি রাখিনি। রাখিনি তার ধর্ম পরিচয়। জাতিগত তথ্য প্রমাণ, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য। এমনকি নাগরিকত্বের প্রমাণপত্রও। তবুও তোমার নিটোল গালের ওই দুই নয়নাভিরাম হ্রদ আজ এতদিন পরেও বারেবারে টেনে আনে তারই আবছায়া। এই প্রেমহীন সময়ে, সত্যি মিথ্যে মিশে যাওয়া বিকেলে কেন জানি বারবার মনে করায় তার কথা। কে যেন আদেশ করে, চোখ বুজে বসো এইখানে। ফিরে যাও অতীতে। ভালো করে ভেবে দেখো, কী ছিল তার পরিচয়! কোন জাদুবিদ্যায় তিনি এঁকেছিলেন ওই দুই নয়নাভিরাম হ্রদ! যেন বলে, তছনছ করে দাও, ভিত খুঁড়ে বের করে আনো। কী ছিল সত্য। কী ছিল সেই জীবন জুড়ানো সৃষ্টির নেপথ্য, শান্ত হয়ে একমনে বসে থাকার গোপন সূত্র।

Advertisement

আমি ভাবি, কী হবে জেনে! চলে তো গেছে এতগুলো বছর। সেই কোন কাল থেকে, কত যুগের ওপার থেকে মানুষের পরিচয় শুধু মানুষে। শিল্পীর পরিচয় তার কালজয়ী সৃষ্টিতে। তুমি পাশে এসে বসো অদৃশ্য সেই ছায়ার মতো। হাত রাখো বুকে। বলো, ওসব কথা ছাড়ো। আলতামিরার গুহাচিত্রের কথা ভাবো। কেউ কি রেখেছে মনে কোন ছবি এঁকে গেছে ঠিক কোন মানুষে। পুরুষে না নারীতে! উচ্চতায় বেশিতে নাকি কমে!

Advertisement

এসব তত্ত্বকথা আমি বুঝি না। উপপাদ্যের স্বীকার, সাধ্যের মতোই জটিল ধাঁধা লাগে। মনে হয় একটি সুষম ত্রিভুজের তিনটি বাহু সমান, এটা প্রমাণের জন্য এত আয়োজনের আজও কী প্রয়োজন! যুগ যুগ ধরে, যা ধরা পড়ে মানুষের অনুভবে, সঞ্চারিত হয়ে আসে সেই অতীতকাল থেকে, তা বর্ণনার জন্য শুধু শুধু কোনও প্যারাডাইম খাড়া করে কী-ই বা হবে! এই পোড়ার দেশে কবেই-বা এঁটো হয়েছে বিড়ি! ঠোঁট থেকে ঠোঁটে ঘুরেছে পথের ধারে আড্ডাখানায়, মাঠের ধারের আলপথে, কল-কারখানার শ্রমবিরতিতে। পিঠে-পিঠ লাগিয়ে বসেছে দাড়ি, গোঁফ নির্বিশেষে। তাবিজ, কবজ আর যোগচিহ্নের সমন্বয়ে। মিশিয়েছে ঘামের সঙ্গে ঘাম। বাড়িয়েছে উৎপাদন, শস্যক্ষেত্রে হাল টেনে, রাক্ষুসে চিমনির ধোঁয়া ওঠা পেটে নিরলস কয়লা জুগিয়ে। অর্ধাহারে মিটিয়েছে নিজেদের খিদে।

তুমি বলো, ভেবো না। এসবই বৃথা আস্ফালন। ক্ষমতার কারি-কুরি। শহর থেকে গ্রামকে আলাদা করা, পাড়া থেকে পাড়াকে, মানুষ থেকে মানুষকে। ওরা বোঝে না ইস্পাত দৃঢ় হয় লোহা এবং কার্বনের গুণে। ওরা জানে না ভিতের নীচে যে ইতিহাস জমা হয়ে আছে, ঘুমিয়ে আছে অবলীলায় তা আসলে মিশ্রণের। আমাদের মেনে নেওয়ার, সহনশীলতার। যুগ যুগ ধরে ভিন্ন মতকে আত্মস্থ করার। ওরা বোঝেনি ‘ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’ কথার অর্থ। ওরা অনুধাবন করে উঠতে পারেনি ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান/ বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’। সুন্দর ধরা দেয়নি ওদের চোখে। ওরা দেখেনি ফুলদানির নানা ফুল। প্রজাপতির নানা রঙ।
তুমি যখন এসব কথা বলো, এক অমোঘ প্রত্যাশায় আমি তাকিয়ে থাকি তোমার দুই গালের দিকে। কখন সামান্য হেসে উঠবে তুমি। তোমার দুই গালে ফুটে উঠবে আবার সেই চির যৌবনা নয়নাভিরাম দুই হ্রদের ছাপ। যে হ্রদের জলে গভীর তাকালে আমি দেখতে পাই আজও সেই পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ, ঝকঝকে রোদ। সেই আকাশের নীচে ছোট্ট একটা গ্রাম। কী যেন এক আলোয় পরিস্ফুট। দূরের এবং কাছের সব দৃশ্যই মনে হয় একই সমতলে অবস্থিত। ঢেউ খেলে যাওয়া ধানের ক্ষেত, সামনের ভাগে রাঙচিতের বেড়া। বেড়ার পেছনে তরিতরকারির গাছপালা। মাথার ওপর হাইটেনশন লাইন, শোঁ-শোঁ আওয়াজ। দূরে শামুকের গতিতে চলে যাওয়া লাল রঙের মালগাড়ি, উৎসাহী বালক-বালিকার তাকিয়ে থাকা।

মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা, দেশ মানে আমরা যখন বুঝতাম বিঘের পর বিঘে সবুজ শস্যক্ষেত্র, আলপথের ধারে ধারে সেচের জলের বয়ে যাওয়া। তারই ঠিক পাশে, অনতি দূরত্বে মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাওয়ায় কৃষকের ঘরবাড়ি। ক্যাঁচকোঁচ শব্দে, সুর-তাল মেনে মেঠো পথ ধরে গরুরগাড়ির চলাচল। গাড়োয়ানের উদাত্ত গান। অলস সন্ধের এক ঝিম ধরা মাদকতা। ঝিঁঝির ডাক, লন্ঠনের আলো, চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডা। সরলতা আর আতিথেয়তা। কৃষিক্ষেত্র থেকে অর্থনীতির সিংহভাগ যোগান। অভাবে আর অনটনে জড়িয়ে থাকা এক সঙ্ঘবদ্ধ পরিবার যেন একচালার ঠাকুর। ছিল গ্রাম্যতা, ছিল কুসংস্কার, অশিক্ষা। তবুও বিশ্বাস ছিল ‘সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। আশা ছিল, ভরসা ছিল। এক বৃদ্ধ বটগাছতলায় আলো-আঁধারির জাফরি ছিল। রোদ ছিল, ছাওয়া ছিল। সুখ- দুঃখ। পাশাপাশি সহাবস্থান ছিল।

মনে পড়ে সেইসব অনাবৃষ্টির দিন, আকাশের দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে থাকা। রেডিও চালিয়ে খবর শোনা, আবহাওয়া দফতর, কৃষকবন্ধুর আসর, মৌসুমী বায়ুর আসা যাওয়া, সারের দাম, ভর্তুকি। তারপর কখন যেন সব উৎকন্ঠা ভুলিয়ে মহম্মদ রফি, মুকেশ, হেমন্ত কুমারদের উদাত্ত কন্ঠের ভেসে আসা। ‘শুন যা দিল কি দাস্তান’। মনে পড়ে সেইসব পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, কৃষিক্ষেত্রে জোর দেওয়া। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় গড়ে তোলা বৃহৎ ও ভারি শিল্প। খাদ্যশস্যের অপর্যাপ্ত উৎপাদন। তীব্র দুর্ভিক্ষ, খাদ্য আন্দোলন। খাদ্যশস্য আমদানির বিষয়ে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা। সেখান থেকে ধীরে ধীরে স্বনির্ভরতা অর্জন। সবুজ বিপ্লব, অর্থকরী ফসলের ধারণা এবং আরও অন্যান্য। ঠিক যেন এক নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসার মাসের শেষে সামান্য সুখ-সঞ্চয়ের আশায়। দুটো পয়সা অতিরিক্ত রোজগারের প্রচেষ্টায়। অর্থনীতিতে তখন কমিউনিস্ট রাশিয়ার প্রভাব। ছোট ছোট আদর্শ, ছোট ছোট মূল্যবোধ বেঁধে রেখেছে মানুষকে। জুড়ে রেখেছে একের সঙ্গে অন্যকে। এদেশ তখনও গান্ধীর, বুদ্ধের। অহিংসাই পরম ধর্ম। সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনে তখনও উঠে আসেনি চার্বাক দর্শন। ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো। তখনও গান্ধীর পাশে গড়ে ওঠেনি গডসের মূর্তি। এদেশ তখনও মেনে নিতে শেখেনি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন মতের স্বেচ্ছাচারী অবদমন। সামান্য রক্তপাতও বিচলিত করেছে দেশাত্মাকে। জগতের সামনে নিজেদের করেছে স্বেচ্ছায় লজ্জাবনত। সমাজ জীবনে চোরাগোপ্তা আক্রমণ, হিংসা, বিবাদ ছিল না— এ কথা বলা যায় না। এদেশের ইতিহাস তো জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণেরই ইতিহাস। রাজা-রানি কিম্বা শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস তো নয়। তবুও খবরের কাগজে, আদালত চত্বরে স্বীকৃতি পায়নি ‘অনার কিলিং’, ‘লাভ জেহাদ’-এর মতো শব্দগুচ্ছ। চেষ্টা চলেনি পিতৃতান্ত্রিক, সামন্ততান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে এক সামাজিক কাঠামোগত রূপ দেওয়ার। তাকে মহিমান্বিত করার।

তুমি বলো এই অবেলায় এত বেশি ভেবো না। চিরকাল কি একই যায়! দিনকালও তো বদলায়। পাঠান, মোগলের সাম্রাজ্য গেছে। যে ব্রিটিশের রাজত্বে সূর্যাস্ত হত না তারাও গেছে। পৃথিবীর বুকে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ। ঠান্ডাযুদ্ধের অবসান হয়েছে। পতন হয়েছে সোভিয়েত রাশিয়ার। উত্থান হয়েছে ক্যাপিটালিস্টদের। সাম্রাজ্যবাদ, ছদ্ম সাম্রাজ্যবাদের এইসব যে উত্থান পতন এসবই তো পৃথবীকে ভাঙে গড়ে।

ডি-কনস্ট্রাক্ট করে। পুরোনো মূল্যবোধ পালটে যায়, একই সত্য ধরা দেয় হীরকদ্যুতির মতো একাধিক দৃষ্টিকোণে। তুমি যাকে সংরক্ষণ বলো, সমঅধিকারের স্বীকৃতি দান বলো, সে সবই তো আজকের তোষণ, ভোট রাজনীতির অভিযোগ। সমাজ পাল্টায়, মানুষ পাল্টায়। আর সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় প্রত্যেককে। এও এক ধরনের ‘সারভাইভাল ফর ফিটেস্ট থিওরি’। অনড় অবস্থানে বাঁচা যায় না খুব বেশিদিন। প্রয়োজনে পাল্টাতে হয় অবস্থানও, যদি তা আবশ্যিক হয় অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। সময়ের কাছে অভাব, অভিযোগ চলে না। সে বড় নিষ্ঠুর।

আমি বলি, এও তো এক ধরনের মেনে নেওয়া। ভেতরে ভেতরে আত্মসমর্পণ করা। আমার বিশ্বাস, আমার সংস্কৃতি অন্যের স্বার্থে পালটে নেওয়া। অন্যের সুবিধার্থে আমার খাদ্যাভ্যাস ত্যাগ করা, মাতৃভাষা অস্বীকার করা। স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে নিজের আনুগত্যের প্রমাণ দেওয়া। আর এভাবেই ধীরে ধীরে নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। পরিণত হয়ে ওঠা এক ধরনের ছিন্নমূল মানুষে, যারা নিজেরই বাসভূমিতে বেঁচে থাকবে বাকি জীবন পরবাসী হয়ে। অসহায় তাকিয়ে থাকবে তাদের যা কিছু সম্পদ, যা কিছু ঐতিহ্য একে একে বিসর্জন যাওয়ার দিকে। তাকিয়ে থাকবে এক অব্যর্থ যন্ত্রণায়। মূক, বধির দৃষ্টিতে। পড়ে থাকবে অবহেলায় ফুরিয়ে যাওয়া এক চোরাগলির মতো। রাজপথ থেকে বিচ্ছিন্ন, গ্লো-সাইনের পিছলে যাওয়া আলোর পরিবৃত্ত থেকে দূরে। আর সেই আলোহীনতা, অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কিছু অসহিষ্ণু মানুষ আসবে যথেচ্ছাচার, অমিতাচার করতে। সমঅধিকার, সমমর্যাদা থাকা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে কোণঠাসা করতে। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি যেনতেন প্রকারে চাপিয়ে দিতে।

তুমি বলো এও তো সনাতন ভারতবর্ষেরই এক চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। নীরবে দুঃখ, যন্ত্রণা ভোগ করে যাওয়া। ত্যাগ স্বীকার করা। নিজের দুঃখ, কষ্টের কথা উচ্চকিত স্বরে না বলা। পশ্চিমিদের মতো ‘আমাকে দেখুন, আমার দুঃখ দেখুন, আমার সুখ দেখুন’ বলে অতি চিৎকার না করা। এই নিঃশব্দ যাপনই তো ভারতবর্ষের মানুষকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে পৃথিবীর কাছে। হিমালয়সম এক দুর্ভেদ্য শ্রদ্ধা, কৌতূহলে মুড়ে রেখেছিল এতগুলো বছর। এই ভারতীয় সমাজ-দর্শন জানতেই তো বছরের পর বছর পশ্চিমি সংস্কৃতির মানুষেরা এসেছে। শান্ত হয়ে বসেছে যেন হিমালয়ের সামনে। খুঁজেছে পারিবারিক এবং আধ্যাত্মিক শান্তি। শ্রদ্ধাবনত হয়েছে ভারতীয়ত্বের ধারণার কাছে। যে সমাজ, যে দর্শনের মধ্যে মানুষ বেড়ে ওঠে একদিন সকালে ঘুম ভেঙে সেসব আমূল বদলে গেলে এক ধরনের বিপন্নতা বাসা বাঁধে তার ভেতর। পরম্পরা, সংস্কার, যা সে পালন করে আসছিল জন্মাবধি হঠাৎ-ই যেন এক প্রিয়জনের মৃতদেহের মতো ভারি হয়ে ওঠে তার কাঁধে। বাসভূমির পবিত্র আত্মার যা কিছু বিশ্বাস, সে সবই যেন অপভ্রংশ হতে থাকে নব চেতনার উন্মুক্ত জোয়ারে। প্রয়োজন শুধু এই কঠিন সময়ে মনের ভেতর আলোর শিখাটুকু প্রদীপের মতো দু-হাত দিয়ে আগলে রাখা। অন্ধকার যত ঘন হবে প্রদীপের শিখাটুকুই হয়ে উঠবে পথ দেখার অবলম্বন। সামান্য সেই আলোটুকুই ছড়াবে হৃদয়ের উষ্ণতা। নিজের কাছে নিজেকে রাখবে পবিত্র।

তুমি যখন প্রদীপের শিখার কথা বলো, কী যেন এক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তোমার মুখ। যেন সেই লন্ঠনের আলো, যেন সেই দেবীমূর্তির আবাহন। মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দিনের কথা। সেই বিস্ময়কর মৃৎশিল্পীর তোমার দুই গাল ছুঁয়ে দেওয়ার কথা। সেই পবিত্র স্পর্শ, যা থাকে মাতৃভূমির মাটিতে, আলো-বাতাসে। সেই পবিত্র অনুভূতি, যা থাকে লালনের গানে, ধূপের গন্ধে। মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা। অঘ্রানে ফসল ওঠা, ঘরে ঘরে নতুন গুড় আর নবান্নর আহ্লাদ। তখনও জমির ওপর এক অমোঘ টান মানুষের। মায়ের মতো শ্রদ্ধা, তা সে উর্বরা হোক কিম্বা বন্ধ্যা। তখনও উন্নয়নের যূপকাষ্ঠ চেপে বসেনি সাধারণ কৃষক পরিবারে, যুবসমাজের মধ্যে। তখনও হতাশা গ্রাস করেনি তাদের। হাল, লাঙল ছেড়ে তারা দলে দলে তুলে নেয়নি রাজমিস্ত্রীর কড়াই, খুরপি। অতিরিক্ত রোজগারের আশায় পাড়ি জমায়নি ভিনরাজ্যে। দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠ, নীল আকাশ ছেড়ে নিজেদের বন্দি করেনি অস্বাস্থ্যকর ঢালাই যন্ত্রের পেটের ভেতর। সবুজ ঘাসের মোলায়েম আঁচল ছাড়িয়ে, গিয়ে পড়েনি ক্রমবর্ধমান নির্মাণ শিল্পের ক্ষমাহীন, আগ্রাসী রুক্ষতায়। তখন সূর্যাস্ত বিছিয়ে দিত এক নির্ভেজাল আড্ডার জগৎ।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে এক আটপৌরে জীবন। তখনও গিগ ওয়ার্ক, মুনলাইটিংয়ের মত আভিধানিক শব্দবন্ধের আগমন ঘটেনি এ দেশের অর্থনীতিতে। তখনও সন্ধের পর দ্বিতীয় কোনও কাজের সন্ধানে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়নি যুবসমাজকে। তখনও পরিষেবা ক্ষেত্র এগিয়ে যায়নি এদেশের কৃষিক্ষেত্রকে পিছনে ফেলে। মাটির গন্ধ, মায়া, মমতা, সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন কোনও অদৃশ্য শক্তি ছোঁ মেরে উঠিয়ে নেয়নি শিকারি পাখির মতো। এক অনন্ত আকাশের স্বপ্ন দেখিয়ে বন্দি করেনি অন্তর্জালের ছোট ছোট চোরকুঠুরিতে। তারপর খাদ্য-পানীয়ে ধীরে ধীরে মিশিয়ে দেয়নি ট্রোলিং, হেটার্স, রোস্টিং, সাইবার বুলিংকে। তখনও গ্রাম-ঘরে ফসল উঠলে দুয়ারে দুয়ারে দেখা মিলত বহুরূপী, সন্ন্যাসী, ফকির, ঠাকুরের। গৃহস্থ চাল, আলু দানের মধ্যে খুঁজে পেত কল্যাণ। একই মানুষ সরল বিশ্বাসে মাথা ঠেকাত পীরবাবার মাজহারে, মন্দিরের দালানে কিম্বা যিশু খ্রিস্টের পদতলে। শান্তি প্রার্থনা করত সর্বশক্তিমানের কাছে।

তুমি বলো, সময় একটা বড় বাধা। মানুষ হোক বা সমাজ পৌষ্টিকতন্ত্রের মতোই ক্রমশ গমন করে সরল থেকে জটিলের পথে। ধীরে ধীরে বদলে দেয় সব সমীকরণ। এই পথে শুধু যাওয়া আছে। ফেরা নেই। ঘৃণা আসলে এক রক্তবীজের বংশ। ট্রয় নগরীর দ্বারে রেখে যাওয়া সেই ওডিসিয়াসের কাঠের ঘোড়া। একবারই মাত্র হেঁটে যায় যা। ধ্বংস করে সব রাজপথ। বিশ্বাস, ভালোবাসা। নগরীর সব সৌন্দর্য কেড়ে নেয় চিরতরে। ঠেলে দেয় স্মৃতির পাতায়।

আমি ভাবি তোমার কথা। এই যে অবেলায় এত কথা বলি তোমার সঙ্গে, যখন তখন ডাক পাঠাই অকারণ, এই তুমিও তো আসলে স্মৃতিই আমার কাছে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া, ছড়িয়ে যাওয়া গোপন ডায়েরির কিছু পাতা। সেই কবে, কোনকালে অতীত হয়ে গেছ। গালের ওই দু’খানা শান্ত, গভীর হ্রদ জমা রেখে অনুমতি নিয়ে গেছ আমার কাছে। তবুও বারে বারে তোমাকেই ডাকি। এই নিঃসঙ্গতায়, এই সিদ্ধান্তহীনতায় ফিরে আসি তোমাতেই। এলোমেলো হয়ে যাওয়া, ছড়িয়ে যাওয়া ডায়েরির সেইসব পাতা কুড়িয়ে আনার চেষ্টা করি। তোমার কাছেই জমা রাখি মনের সব কথা। এই অস্থিরতা তুমি ছাড়া আর কে-ই বা উপলব্ধি করবে! কে-ই বা বুঝবে ধীরে ধীরে প্রান্তিক হয়ে ওঠার যন্ত্রণা। কে-ই বা বুঝবে সমবর্তিত এই সমাজে সমদূরত্বে বাঁচতে চাওয়ার প্রতিবন্ধকতা।

জানি এইসব প্রয়াসও হয়ত মুছে দেওয়া হবে একদিন। বদলে দেওয়া হবে রাষ্ট্রশাসনের রীতিনীতি। ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। নতুনভাবে লেখা হবে যাবতীয় সংজ্ঞা, যা কিছু দরকার বৈধ নিষ্ক্রমণপত্র রূপে। হয়তো চালানো হবে চিরুনি তল্লাশি। নিয়ে যাওয়া হবে ডায়েরির অবশিষ্ট পাতা, ওই দুই নয়নাভিরাম হ্রদ, তোমাকে বলা এইসব কথা। হয়তো কেড়ে নেওয়া হবে সেই আশ্চর্য সময়ের সব স্মৃতি। আমাদের কৈশোর, বইয়ে পড়া সব শিক্ষা। হয়তো সেসবের দেখা পাবো না আর কখনও। হয়তো একদিন তোমারও আর আসা হবে না এভাবে, সবকিছু ফেলে ছুটে ছুটে। তবুও আমার ভেতর এক পুরোনো ভারতবর্ষের মতো রয়ে যাবে তুমি। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা। রয়ে যাবে পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনার মতো এক অদৃশ্য আত্মিক বন্ধনে।

Advertisement