রবিবার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সমাবেশ করেছে সিপিএম। মূলত শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং বস্তি— চারটি গণসংগঠনের ডাকে এই সমাবেশ করা হয়েছে। এপ্রিলের প্রখর রোদ থেকে রেহাই পেতে এদিন বেলা ৩টেয় ব্রিগেডের সভা শুরু হয়। মোট ছয়জন বক্তা ব্রিগেড সভার মধ্যমণি ছিলেন। প্রধান বক্তা দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। এছাড়াও অন্যান্য বক্তাদের তালিকায় ছিলেন কৃষকসভার নেতা অমল হালদার, ক্ষেতমজুর সংগঠনের নেতা নিরাপদ সর্দার, বন্যা টুডু, বস্তি উন্নয়ন সমিতির নেতা সুখরঞ্জন দে এবং সিটু নেতা অনাদি সাহু। এদিন ব্রিগেড মঞ্চ থেকে তাঁরা প্রত্যেকেই রাজ্যের মেহনতি মানুষের অধিকারের দাবিতে আওয়াজ তোলেন। বাম নেতাদের ভাষণে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বার্তা।
দলের রাজ্য সম্পাদক সেলিম বলেন, ‘বাঁচতে গেলে হিন্দু মুসলিম একসঙ্গে লড়তে হবে। লড়াইকে আমরা ভয় পাই না। কিন্তু সেই লড়াই মন্দির, মসজিদকে ঘিরে নয়। আমরা মুর্শিদাবাদকে বাংলাদেশের মতো সংখ্যালঘু নিধনের জায়গা হতে দিতে পারি না। আমাদের লড়াই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের জন্য, সম্প্রীতির জন্য লড়াই।’
এদিকে দলের অন্যতম মহিলা নেত্রী বন্যা টুডু এই সমাবেশের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সিপিএম-এর এই ব্রিগেড থেকে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেছেন। আঞ্চলিক টানে তাঁর ভাষণ বাম কর্মী-সমর্থকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। বন্যা তাঁর বক্তব্যের মাঝে ২০২৬ সালে রাজ্য সরকারের উইকেট ফেলে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন। এ ছাড়া দলের অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে অমল, অনাদি, সুখরঞ্জনরাও সমাজের নিচুতলার মানুষের কথা বলে কেন্দ্র এবং রাজ্যকে সমান্তরালভাবে আক্রমণ শানিয়েছেন।
এদিন ব্রিগেড সমাবেশ থেকে সিপিএম নেতা অনাদি সাহু তৃণমূল এবং বিজেপিকে একযোগে আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষ আজ বিপন্ন। চাবাগান, চটকল, কয়লাখনি, ইস্পাত কারখানার মানুষ আক্রান্ত। দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী সরকার ১৪ বছর ধরে রাজ্যে লুটের রাজত্ব চালাচ্ছে। ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে। ৩২ হাজারের চাকরি ঝুলে আছে। ছাত্র-যুবরা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। রাজ্যের অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে এই সরকারের নীতির কারণে। গরিবের রোজগার বাড়ছে না। স্থায়ী কাজে অস্থায়ী শ্রমিক নিযুক্ত হচ্ছেন। শ্রম আইন ভঙ্গ হচ্ছে বার বার। সর্বত্র অস্থায়ী শ্রমিক, কম মজুরিতে কাজ করতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন। কেন্দ্র শ্রম কর লাগু করতে চলেছে। নরেন্দ্র মোদীকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, আগুন নিয়ে খেলবেন না।’
আবার অন্য এক সিপিএম নেতা সুখরঞ্জন দে তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘বস্তিবাসীরা আগামী দিনে শহরে থাকতে পারবেন কি না, অনিশ্চিত। বস্তি উচ্ছেদ নয়, বরং বস্তিবাসীদের নিরাপদ স্বত্ব, পাট্টা দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। বস্তিবাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। আমরা এই লড়াইয়ের শেষ দেখে ছাড়তে চাই। প্রান্তিক মানুষদের সংগঠিত করে আমরা জেলায় জেলায় আন্দোলন গড়ে তুলছি। বস্তিবাসীদের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসাথীতে স্বজনপোষণ করা হচ্ছে। বিপিএল-কে এপিএল করে দেওয়া হচ্ছে। আবাসের টাকা দিচ্ছে না। অন্য রাজ্যগুলিতে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। আমাদেরও বিনামূল্যে গোটা রাজ্যে বিদ্যুৎ দিতে হবে। অন্য রাজ্য পারলে তোমরা কেন দেবে না?’
অন্যদিকে সন্দেশখালির বিতর্কিত সিপিএম নেতা নিরাপদ সর্দার বলেন, ‘এই সময়ে সবচেয়ে বেশি বেকারের জন্ম। কল-কারখানায় কাজ করতেন যাঁরা, তাঁদের জীবন অনিশ্চিত। পড়াশোনা করে ছাত্রযুবরা পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য হচ্ছেন। পার্লামেন্টে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনা হয় না। বিধানসভায় হয় না। মন্ত্রী, সাংসদদের বেতন বৃদ্ধির আলোচনা হয়। কাজের নিরাপত্তার জন্য আলোচনা হয় না কোথাও। ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। মোদী টাকা দিচ্ছেন না। আমরা বলছি, ১০০ নয়, ২০০ দিনের কাজ দিন। আইন আনুন। তিন মাসের বেশি ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করা যায় না। মোদী তা-ই করছেন। এ সব নিয়ে আলোচনা হয়? কর্মশ্রীতে কোনও কাজের সুযোগ নেই। এগুলো লোক দেখানো।’
এদিন ব্রিগেড সমাবেশে আর এক সিপিএম নেতা অমল হালদারও তাঁর বক্তৃতায় রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকে একযোগে আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, ‘কৃষকরা আজ বিপন্ন। তাঁদের গোপনে জমি বন্ধক দিতে হচ্ছে। তাঁরা ঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ ফসলের দাম পাচ্ছেন না। সারের দাম, বীজের দাম বেড়ে যাচ্ছে। রাজ্য ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে যাচ্ছে। লড়াই ছাড়া কোনও পথ নেই। অতীতেও বাঁচানোর জন্য লাল ঝান্ডা ছুটে এসেছিল। রাজ্যে কৃষির অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ২৬ হাজার চাকরি চলে গেল। চালের দাম চড়চড় করে বাড়ছে। ভাত খেতে পাব আমরা আগামী দিনে? চালও তো আমদানি করতে হবে বাইরে থেকে! জমি কমছে। উৎপাদন কমছে। সরকারের কোনও পরিকল্পনাই নেই। এরপর দুর্ভিক্ষের মতো চিত্র দেখা যাবে। নয়া কৃষিনীতির নাম করে বিপজ্জনক সংস্করণ তৈরি করছেন।’
এদিন দলের উঠতি মহিলা নেত্রী বন্যা টুডু তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাম কর্মী সমর্থকদের মন জয় করে নেন। বন্যা বলেন, ‘ক্ষেতমজুর, খেটে খাওয়া মানুষদের লড়াই। শহরের মানুষ আমাদের কথা জানে না। আমরা শেষ দেখে ছাড়ব। লড়াইয়ের পথ থেকে সরব না। আমাদের সরকার ১০০ দিনের কাজ চালু করার কথা বলেছিল। সবাই বলে, ব্রিগেডে এত লোক, কিন্তু ভোটবাক্স খালি। মানুষের রুটিরুজি আর ভোটবাক্স আলাদা। ১০০ দিনের কাজ আমরা ২০০ দিন করতে চাই। টাকা দাও, না হলে কাজ দাও। আপনাদের জন্যই লড়াই করছি। আমরা পিছিয়ে যাইনি। তাই মা-বোনেরা ব্রিগেডে এসেছে। আমাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এত চুরি করেছে, এত চুরি করেছে, কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। আগামী দিনে আমাদের অনেক কাজ। ব্রিগেড থেকে চলে গেলে হবে না। লক্ষ্মীদের সম্মান থাকে না, তাদের আর ভান্ডার কী? মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, টাকা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওঁরা বলছেন, খেলা হবে। খেলা আমরাও করব। ২৬-এ আমরাও দেখিয়ে দেব। আমরা উইকেট ফেলব।’
সবশেষে ব্রিগেড মঞ্চ থেকে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকে আক্রমণ শানান সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি তাঁর বক্তব্যে মুর্শিদাবাদ প্রসঙ্গ বিশেষভাবে তুলে ধরেন। সেলিম বলেন,‘দুর্নীতিবাজদের চোদ্দ তলা থেকে মাটিতে টেনে নামানোর শপথ নিতে হবে আমাদের। গরিব মানুষের লড়াই স্যুট-বুট পরে লাট-বেলাট লড়তে পারবে না। গরিবকেই লড়তে হবে। বাঁচতে গেলে হিন্দু মুসলিম একসঙ্গে লড়তে হবে। লড়াইকে আমরা ভয় পাই না। কিন্তু সেই লড়াই মন্দির, মসজিদকে ঘিরে নয়। ধর্মের নামে বেসাতি যারা করে, বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমরা মুর্শিদাবাদকে বাংলাদেশের মতো সংখ্যালঘু নিধনের জায়গা হতে দিতে পারি না। লড়ে যাওয়ার শপথ নিতে হবে তাই। আমাদের লড়াই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ, মা-বোনের ইজ্জত রক্ষার জন্য, সম্প্রীতির জন্য লড়াই। তৃণমূল-বিজেপির হাতে বাংলার সর্বনাশ হতে দেব না। সব ধর্মের অধিকার রক্ষা করে সরকার চালাতে হবে। এখন তো সরকারই বলছে মন্দির-মসজিদ চালাবে। আরে ট্রেনটা তো ভাল করে চালাক আগে। কেন্দ্র ট্রেন বেচে দিচ্ছে। রাজ্য ট্রাম বেঁচে দিচ্ছে। আসলে তৃণমূল ও বিজেপির স্ক্রিপ্ট এক।’
সেলিম আরও বলেন, ‘ওয়াকফের সংশোধন নিয়ে গোটা দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে, শুধু বিজেপি আর তৃণমূলের পাঁচ-ছ’জন সাংসদ ছাড়া। কোথাও তো অশান্তি হচ্ছে না। এখানে হল কেন? মুর্শিদাবাদে যাঁরা খুন হলেন, তাঁদের সমস্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা চাই বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক। কারা ষড়যন্ত্র করল, নেপথ্যে কারা ছিল, সব বেরিয়ে আসবে। বহিরাগতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। তারা ভিতরে ঢুকলেন কী ভাবে? জ্যোতি বসু বলেছিলেন, সরকার চাইলে দাঙ্গা হয়। দাঙ্গাবাজদের আটকাতে পারছে না পুলিশ-প্রশাসন। আমরা দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে লড়ে যাব। আমি বলব, হিন্দু আর মুসলমান লড়াই কোরো না। লড়তে হয় বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়ো। আমরা লড়াইকে ভয় পায় না। ২৬-এর লড়াইয়ের শুরু এখান থেকেই হোক। রাজ্যকে বাচাতে হলে বামপথ বাছতে হবে। গ্রামে গ্রামে এই লড়াই ছড়িয়ে দিতে হবে। রাজ্যজুড়ে ব্রিগেড তৈরি করতে হবে। ’
এদিন ব্রিগেড মঞ্চে বন্যা টুডু’র ‘উইকেট’ ফেলে দেওয়া মন্তব্য প্রসঙ্গে রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘লড়াইয়ের ময়দান থেকে উঠে এসেছে বন্যা। আমাদের নেতানেত্রী টালিগঞ্জ বা বলিউড থেকে উঠে আসে না। শ্রমিক, কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছেন। ক্রিকেটের ভাষায় ও বলেছে, উইকেট ফেলে দেব। তার জন্য ফুটবলের ভাষায়– নেমে খেলতে হবে। যাতে দুর্নীতিবাজদের চোদ্দ তলা থেকে মাটিতে টেনে নামাতে পারি।’
সেলিম তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, ‘যাঁরা দূরবীন দিয়ে লাল ঝান্ডা দেখতে পাচ্ছিল না, তাদের বুকে কাঁপন ধরাবে এই ব্রিগেড। কাজের জায়গা ছোট হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রে, রাজ্যে কোথাও নিয়োগ হচ্ছে না। যেখানে নিয়োগ হচ্ছে, সেখানে দুর্নীতির পাহাড়। নিয়োগে দুর্নীতি, সুপ্রিম কোর্ট মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে। ২৬ হাজার মানুষের চাকরি খেয়েছে। শিল্প হয়নি। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার কাজের জায়গা ছোট করে দিচ্ছে। আমাদের দাবি, সাম্প্রদায়িক হিংসা যে ছড়াবে, পুলিশকে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। না হলে আমরা রাজ্যের সব থানায় এফআইআর করব। লাল ঝান্ডা, চিট ফান্ডের টাকায় কেনা হয়নি। কারও দয়ায় আমরা বেচে নেই। এত রোদে কী ভাবে লাখ লাখ মানুষ বসবেন, অনেকে চিন্তা করছিলেন। কিন্তু আমাদের প্রতি প্রকৃতিও সহায়। তপ্ত রোদ ওঠেনি। আমি মুর্শিদাবাদের শামসেরগঞ্জে গিয়েছিলাম, সুতিতে গিয়েছিলাম। কোথাও পুলিশের গুলিতে, কোথাও হামলাকারীদের আক্রমণে মানুষ মারা গিয়েছেন। আমি সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে তাঁদের কাছে গিয়েছিলাম। হিংসা দেখলে ডান্ডাগুলোকে মোটা করতে হবে। দেশ বাঁচাতে হলে আবার লাল ঝান্ডাকে মজবুত করতে হবে। যারা ঘরছাড়া করছে, তাদের রাজ্য ছাড়া করব।’