আগামী শিক্ষাবর্ষেই কি উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যক্রমে বদল আসবে? সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার মত সংশোধিত পাঠ্য প্রণয়ন করবে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ?
সম্প্রতি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের তরফে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে। এপ্রসঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য শিক্ষকদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন যে, তাঁদের প্রস্তাবিত পাঠ্যসূচি পর্যালোচনার জন্য সিলেবাস কমিটির কাছে গুরুত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। এখানেই আশার আলো দেখছেন শিক্ষকরা। তাঁরা মনে করছেন আগামী বছর সিলেবাসের কিছু বদল এবং সংযোজন করা হতে পারে।
এ বিষয়ে শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিংকর অধিকারী জানিয়েছেন, সংসদ সভাপতি চিরঞ্জীববাবুর কাছে সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার মতো এবং পড়ুয়াদের মনোগ্রাহী নতুন সিলেবাস প্রবর্তনের আবেদন জানিয়েছিলাম। এমনকী, কিছু বিকল্প প্রস্তাবও লিখিতভাবে দিয়েছিলাম। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চিরঞ্জীববাবু জানিয়েছেন, তাঁদের প্রস্তাবিত পাঠ্যসূচি পর্যালোচনার জন্য সিলেবাস কমিটির কাছে গুরুত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষকতা করি, সেসব স্কুলের বেশিরভাগ পড়ুয়ারাই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। তাই পাঠ্যসূচিকে শুধুমাত্র কলকাতা কেন্দ্রিক না-করে, সারা রাজ্যের কথা ভেবে প্রণয়ণ করা উচিত বলেই মনে করি। যাতে পড়ুয়াদের কাছে বিষয়গুলো মজাদার হয়।’
উল্লেখ্য, চলতি বছরে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে সেমিস্টার সিস্টেম চালু হয়েছে। তাতে ৬ মাস অন্তর-অন্তর উচ্চমাধ্যমিকের মতোই পরীক্ষা দিতে হচ্ছে পড়ুয়াদের। ২০২৫ সালে যারা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবেন, তাঁরা সেমিস্টার ব্যবস্থার প্রথম ব্যাচ। অতএব কোর্স শেষ করতে হাতে খুব অল্প সময় পাচ্ছেন তাঁরা। ওদিকে পড়ার চাপও অনেক বেড়েছে। ইতিমধ্যেই উচ্চমাধ্যমিকের জন্য নতুন সিলেবাস চালু হয়েছে। এখানেই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকদের বক্তব্য, সিলেবাসে যে সমস্ত বিষয় আনা হয়েছে, সেগুলো অল্প সময়ের মধ্যে শেষ করা কঠিন। তাই শিক্ষকরা চাইছেন, সংসদের প্রণয়ন করা নতুন সিলেবাস সংশোধন করা হোক। কারণ, শিক্ষক সংগঠনগুলো অভিযোগ তুলেছেন, ইংরেজি-বাংলা-ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের যেভাবে অবৈজ্ঞানিক এবং অবাস্তব সিলেবাস করা হয়েছে, তা বদলে সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার মতো পাঠ্যসূচি আনা হোক। পাশাপাশি শিক্ষকদের তরফে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, স্বল্প পরিসরে এমন গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি দিতে হবে, যাতে সাহিত্যের প্রতি ভালোলাগা, প্রাসঙ্গিকতা, মূল্যবোধ, গভীর ভাবনা ছাড়াও যুগোপযোগী বিষয় থাকে।
আসুন তাহলে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, কোন কোন বিষয়ে বদলের কথা বলেছেন শিক্ষকেরা।
সংসদের কাছে পাঠানো আবেদন পত্রে শিক্ষকরা জানিয়েছেন, সংসদের বিবেচনার জন্য উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়ের সিলেবাস সম্পর্কে শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে একগুচ্ছ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রথমেই উচ্চমাধ্যমিকের ইংরেজি ভাষার পাঠ্যসূচি বদলের কথা বলা হয়েছে।
সেখানে তিনটে পাঠের উল্লেখ করা হয়েছে—‘অমরনাথ’, ‘স্বামী অ্যান্ড মাদার ওয়ারশিপ’ এবং ‘দ্যা গার্ডেন পার্টি’। এই তিনটি পাঠ্যক্রম রসহীন বলেই মনে করছেন শিক্ষকরা। এছাড়াও তাঁদের বক্তব্য, ‘নোবেল লেকচার’ বাই মাদার টেরেজা ভীষণ একঘেঁয়ে।
ওদিকে ‘অফ স্টাডিজ’ পড়ুয়াদের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন বলেই মনে করছেন তাঁরা। এছাড়াও কবিতাগুলোর মধ্যে ‘স্টিল আই রাইজ দ্যা সেকেন্ড কামিং’ নিয়েও আপত্তি রয়েছে শিক্ষকদের।
অপরদিকে বাংলা বিষয় নিয়েও কিছু বদল চাইছেন তাঁরা। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বক্তব্য, বাংলার ক্ষেত্রে সিলেবাস বিস্তৃত অথচ নম্বর কম। এছাড়াও পড়ানোর জন্য বরাদ্দ সময় আরও কম। সাহিত্য পড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, রসগ্রাহী আলোচনা, গোত্র নির্ণয়, লেখক পরিচিতি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক—সেজন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। ওদিকে ‘পুঁই মাচা’ ভালো গল্প কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা মাঝারি। তার বদলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডাইনি’ খুব ভালো একটি বিকল্প হতে পারে।
আবার ছুটি’ ও ‘নুন’ ততটা প্রাসঙ্গিক নয়। তার বদলে রবি ঠাকুরের ‘গুপ্তধন’, ‘জীবিত ও মৃত’ কিংবা ‘স্ত্রীর পত্র’ পাঠ্য হতে পারে। পাশাপাশি তাঁদের পরামর্শ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস আরও সংক্ষিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। অন্য দিকে শিক্ষকদের দাবি, প্রবন্ধের ক্ষেত্রে ‘মানস মানচিত্র’ শব্দবন্ধ বিভ্রান্তিকর। ‘আদরিনী’ অপ্রাসঙ্গিক।
ওদিকে ‘নানা রঙের দিন’ মূল্যহীন আর অপ্রাসঙ্গিক নাটক। তার বদলে উৎপল দত্তের ‘নীলকণ্ঠ’ আজও প্রাসঙ্গিক। রূপক সাংকেতিক নাটক ‘ডাকঘর’ না-দিয়ে, সিলেবাসে ‘মুক্তধারা’ দিলে ভালো হতো। ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ অনুপযোগী। বিবেকানন্দের এই প্রবন্ধ ত্রুটিযুক্ত।
দ্বাদশ শ্রেণিতে ‘তারা’ নাটকটি বাদ দেওয়া উচিত। গল্পের মধ্যে দেওয়া যেতে পারে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডাইনি’, রাজশেখর বসুর ‘বিরিঞ্চি বাবা’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ইরফান আলি দু’নম্বর’ এবং রমাপদ চৌধুরীর ‘ভারতবর্ষ’।
শিক্ষকদের আরও বক্তব্য যে, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্পের বঙ্গানুবাদ আক্ষরিক অর্থেই নিকৃষ্ট হয়েছে। সেকারণে সাহিত্যরস ক্ষুন্ন হয়েছে। এক্ষেত্রে রসানুবাদ প্রয়োজন বলে মনে করছেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, ম্যাজিক রিয়ালিজম (আলোচ্য গল্পের গোত্র) একাদশের পাঠ্য হওয়ার যোগ্য নয় বলেই জানিয়েছেন শিক্ষকেরা।
ওদিকে একাদশ শ্রেণির ইতিহাসের সিলেবাস বদলের বিষয়ে শিক্ষকদের পরামর্শ, মধ্যযুগ পর্যন্ত একাদশে পড়ানো হোক। আর আধুনিক যুগ দ্বাদশে নিয়ে যাওয়া হোক। কারণ, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার মতো বাস্তবসম্মত সিলেবাস করা দরকার।
তাঁরা মনে করছেন, একাদশ-দ্বাদশে এত বিশদে পড়ানোর দরকার নেই। যাঁরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অনার্স পড়বেন, তাঁদের শুধু কাজে লাগবে।
এছাড়াও ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের পাঠ্য বিষয় প্রচুর কিন্তু নম্বর অত্যন্ত কম। সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা মনে করছেন, এতে জ্ঞান, বোধ, প্রয়োগ, দক্ষতামূলক, অতি সংক্ষিপ্ত, সংক্ষিপ্ত, সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক এবং ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন করা অসম্ভব।
সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা মনে করছেন যে, সিলেবাস তৈরি করার সময় সংকলন, পাঠ্যসূচি, প্রশ্নের নম্বর, পাঠ্যর উপযোগিতা, ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর শ্রেণি, মানসিক বয়স, শিক্ষণ সামর্থ্য এবং উচ্চ শিক্ষার ইচ্ছা ইত্যাদি বিষয়ে সংসদের ভাবার প্রয়োজন ছিল।