একুশের মঞ্চে ব্যালট যুদ্ধের ঘোষণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

ইভিএম নয়, ব্যালট চাই- ২০১৯ সালের একুশে জুলাই-এর বার্তা ছিল এটাই।

Written by SNS Kolkata | July 22, 2019 1:49 pm

একুশের জুলাই-এর মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। (Photo: Kuntal Chakrabarty/IANS)

ইভিএম নয়, ব্যালট চাই- ২০১৯ সালের একুশে জুলাই-এর বার্তা ছিল এটাই। রবিবার একুশের জুলাই-এর মঞ্চ থেকে সেই ব্যালট যুদ্ধের প্রস্তুতিকেই বুথস্তরে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন মমতা । নেতাদের গিয়ে ব্লকে ব্লকে জনসংযােগ করা, বিজেপির জনবিরােধী কার্যকলাপকে জনসমক্ষে আনার জন্য অভিযান চালাতে চাইছেন।

এবারের লােকসভা নির্বাচনকে হিস্ট্রি নয় একটা মিস্ট্রি হিসেবেই দেখছেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর প্রশ্ন, আমেরিকা, জাপান, জার্মান, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্সের মতাে দেশগুলিতে যদি ব্যালটে ভােট হয়, তাহলে ভারতে কেন শুধু ইভিএম-এ ভােট হবে।

এবারের নির্বাচনের আগে থেকেই যে সংখ্যায় বিজেপি জিতবে বলেছিল কীভাবে সেই সংখ্যাতেই জিতে গেল? সেটা সত্যিই রহস্য। ইভিএম প্রতারণা করে, নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি লােকসভা নির্বাচনে জিতেছে বলে মনে করেন মমতা তাই এবার রাজ্যে পুরসভা পঞ্চায়েতে ব্যালটেই ভােট করতে চান মুখ্যমন্ত্রী।

লােকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে আঠেরােটি আসন পাওয়ার পর থেকেই ইভিএম-এর বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়েছেন নেত্রী। এদিন বিজেপিকে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, মােটে তাে আঠেরােটা আসন পেয়েছে। তাতেই এত তড়পানি! আমাদের পার্টি অফিস দখল করে নিচ্ছে। তাও আবার কয়েকটা আসনে তিন চারটে আসনে মাত্র এক হাজার ভােটের ব্যবধানে জিতেছে। আবার ভােট হলে টোটালটাই উল্টে যাবে। মমতা বলেন, ২০১৯ সালেও আমরা ২৬ টা আসনে জিতেছিলাম। কিন্তু কারাে ওপর অত্যাচার চালাইনি।

আরএসএস গুণ্ডারা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে তাণ্ডব চালাচ্ছে। তবে বিজেপিকে রুখতে আইন হাতে তুলে না নেওয়ার জন্যই তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী। এদিন তিনি কংগ্রেস সিপিএমকে বার্তা দিয়ে বলেন, ওরা যে ডালে বসে থাকে সেই ডাল না কেটে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করুক। আমাদের সমর্থন করতে হবে না। তবে যেসব ভালাে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট নেতারা আসতে চাইছেন তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে লড়াই করার নির্দেশ দলীয় নেতাদের দিয়েছেন মমতা। একই সঙ্গে যেসব নেতারা বিজেপিতে চলে গিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে যে কেস তুলে নেওয়া হবে না, সেকথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

এদিন তিনি দলের পুরনাে, বুথস্তরের কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারাই দলের সম্পদ। যারা প্রতারণা করেছেন, টাকা নিয়ে ভােট করেছেন, তাদের চিহ্নিত করুন। মােট কথা, আগামী নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যস্তরে একটা যুদ্ধের প্রস্তুতিরই সূচনা করলেন মমতা, একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে।

রাজ্য জুড়ে কাটমানি নিয়ে যখন তৃণমূলকে জন-আন্দোলনের শিকার করা হচ্ছে, তখন পাল্টা ব্ল্যাকমানি অস্ত্রে বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমন শানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একুশের মঞ্চ থেকে তিনি বিজেপিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, ব্ল্যাকমানি ফিরিয়ে দাও। উজ্জ্বালা প্রকল্পের নামে বিজেপি নেতাদের কাটমানি খাওয়ার যে অভিযােগ তাদেরই দলীয় সমর্থকদের পক্ষ থেকে উঠেছে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে জবাবদিহি চাইলেন মমতা। হিসেব দিতে বললেন নােটবন্দির নামে উদ্ধার হওয়া ব্ল্যাকমানির। নির্বাচনের সময় বিজেপি’র হিসেব বহির্ভূত খরচের। বিদেশ থেকে আনা ফান্ডের। একুশের মঞ্চ থেকেই মমতা ঘােষণা করলেন আগামী ২৬ এবং ২৭ জুলাই রাজ্য জুড়ে ব্ল্যাকমানি ফিরিয়ে আনার দাবিতে ব্লক স্তরে আন্দোলন করা হবে।

তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের টাকা যাতে প্রত্যেকের কাছে সুষ্ঠুভাবে পৌছয়, সেই মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি কাটমানি ফেরতের কথা বলেছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থপূরণ করতে বিজেপি লােকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাটমানি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছে। বিজেপিকে এদিন কটাক্ষ করে ‘বড় চোর’ বলেন মমতা। বললেন, ডাকাতদের সর্দার, তারাই আবার বলছে কাটমানি ফেরত দাও। এছাড়া বিজেপির ফাইভ স্টার ধাঁচের পার্টি অফিস বানানাে, সম্পত্তি বাড়ানাের প্রসঙ্গ তােলেন।

মমতা এদিন টাকা দিয়ে দলের লােক ভাঙানাে বা ঘােড়া কেনাবেচা নিয়েও বিজেপির সমালােচনা করেন। বলেন, কোথাও গ্রামের মানুষকে গিয়ে বলা হচ্ছে ২০ লক্ষ টাকা দেব। কোনও এক বিধায়ককে দু’কোটি টাকা এবং পেট্রোল পাম্প দেওয়ার টোপও দেওয়া হয়েছে দলে টানার জন্য।

মুখ্যমন্ত্রী সাফাই, টাকা দিয়ে রাজনীতি হয় না। রাস্তায় নেমে রাজনীতি করতে হয়। টাকা আসে চলে যায়, কিন্তু রাজনৈতিক দল রয়ে যায় জনতার উদ্দেশে বার্তা দিয়ে এদিন মমতা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, যদি কেউ দু’কোটি টাকা দিতে চায়, বিজেপিতে যাবেন না তাে? পেট্রোল পাম্প দিতে চাইলে যাবেন না তাে? জনতার সম্মিলিত ধ্বনি ওঠে, না… না…। মমতা বলেন, মনে রাখবেন ওই টাকা আপনাদের থাকবে না। বিজেপিতে যােগ দেওয়ার পরই কেড়ে নেবে।

মমতা বলেন, শুধু দল ভাঙানােই নয়, তৃণমূল নেতাদের পেছনে জোর করে ইডি, সিবিআই লাগানাে হচ্ছে। তৃণমূল নেতাদের নাম জড়িয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। শতাব্দী রায়, প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণাকে ডেকে পাঠিয়েছে ইডি। বলছে আরও ডাকা হবে। কাউকে বলছে বিজেপির নেতার সঙ্গে যােগাযােগ রাখ, তাহলে গ্রেফতার করা হবে না। নাহলে তাপস পাল, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতাে অবস্থা হবে। এইসব উদাহরণ দিয়ে বিজেপি প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে বলে অভিযােগ করেন মমতা। সেই কারণেই সংসদে রাতারাতি বিল আনা হচ্ছে, বিরােধী সাংসদদের কাউকে দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে উত্তরপ্রদেশে সােনভদ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। এইসব ঘটনাকে গণতন্ত্রের বুলডােজিং হিসেবেই দেখছেন মমতা।

মমতার আরও অভিযােগ, একুশের মিছিলে আসার জন্য ট্রেন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গুড়াপ, আরামবাগ, পটাশপুর এইসব এলাকায় মিছিলে আসা মানুষদের বাস থেকে টেনে নামানাে হয়েছে। বাস ভাঙচুর করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। মমতা এদিন পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, আগামীদিনে আপনারা এই রাজ্যে মিটিং করবনে না? তখন যদি তৃণমূল এর পাল্টা কিছু করে, আপনারা সামলাতে পারবেন তাে?

এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি করে বিরােধী নেত্রীর ভূমিকায় দেখা যায়। পঞ্চাশ মিনিটের বক্তৃতার বেশিরভাগটাই জুড়ে ছিল বিজেপি’কে আক্রমণ। দেওচা পাঁচামি এবং বানতলায় চর্মনগরীতে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের কথা ছাড়া আগামীদিনের উন্নয়ন কর্মসূচির কথা তেমন শােনা যায়নি মমতার মুখে।

সব মিলিয়ে একুশের মঞ্চে শহিদ দিবসের শােক এখন প্রায় উপলক্ষ্যই। রাজনৈতিক আগুন ছেটানাের লক্ষ্যস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে একুশের মঞ্চ। তাই হয়তাে শ্রাবণের ধারার বদলে এদিন ছিল তেজ ছেটানাে প্রখর রােদুর। রাজনৈতিক ভােলবদল ঋতুর এই পালাবদলের কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।