নারীসুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন খোদ রাজ্য সরকারের মন্ত্রীই। পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যমন্ত্রী বিপ্লব রায়চৌধুরীর মন্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। বৃহস্পতিবার পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরে এক সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে তিনি বলেন, ‘আজকাল খবরের কাগজ পড়তেই ভয় হয়। এই বুঝি আবার কোনও মেয়ের উপর অত্যাচারের খবর। লজ্জা লাগে।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তবে কি রাজ্যেই মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ রাজ্য মন্ত্রিসভার এই সদস্য?
উল্লেখ্য, বিপ্লব রায়চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে কোনও রাজ্যের নাম উল্লেখ করেননি। ফলে তিনি পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির কথা বলছেন, না কি সামগ্রিক ভাবে দেশের চিত্র তুলে ধরেছেন— তা স্পষ্ট হয়নি। আবার তৃণমূল সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত, এমন কোনও জোরালো দাবি করতেও তাঁকে শোনা যায়নি। সেই কারণেই তাঁর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে অস্বস্তি বেড়েছে শাসকদলের অন্দরমহলে।
Advertisement
রামনগরের নন্দিনী মেলার মঞ্চ থেকে বিপ্লব বলেন, ‘খবরের কাগজ পড়লে এখন ভয় হয়। এই বুঝি আবার কোনও মেয়ের উপর অত্যাচার হল। তার জন্য আমাদের লজ্জা হয়। তবে এখন আর লজ্জা করার জায়গা নেই। লজ্জা ভেঙে ঘরের মেয়েদের আরও এগিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।’ তাঁর এই বক্তব্যকে একদিকে সামাজিক বার্তা হিসেবে দেখলেও, অন্যদিকে তা রাজনৈতিক ইঙ্গিত বহন করছে বলেই মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের।
Advertisement
এই মন্তব্যের পরই বিজেপি রাজ্যের শাসকদল ও সরকারকে আক্রমণে নেমে পড়েছে। বিরোধী দলনেতা দিব্যেন্দু অধিকারী সমাজমাধ্যমে দাবি করেন, ‘রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে খোদ মৎস্যমন্ত্রী সত্যি কথা বলে ফেলেছেন।’ বিজেপির মতে, দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে, আর শাসকদলের মন্ত্রীর মুখে সেই উদ্বেগ প্রকাশ পাওয়ায় প্রকৃত পরিস্থিতি সামনে চলে এসেছে।
বিতর্ক বাড়তেই পরে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য রাজ্য সরকার প্রচুর ব্যবস্থা করেছে। আরও চেষ্টা চলছে। সব সমাজেই কিছু বদমায়েশ লোকজন থাকে। ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকলে এই ধরনের কাণ্ড ঘটতেই পারে। কিন্তু আমরা কেউ এগুলো সহ্য করছি না। মেয়েদের আরও বেশি করে শিক্ষিত করা হচ্ছে, যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে পারে।’ একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, তাঁর বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার কড়া ভাষায় তৃণমূল সরকারকে আক্রমণ করেন। তাঁর বক্তব্য, ‘গত ১৪–১৫ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গ মেয়েদের বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী মুখ ফস্কে সত্যি কথা বলে ফেলেছেন। পরে হয়তো দলে কানমলা খেয়েছেন, তাই আবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন।’
যদিও তৃণমূল শিবির বিজেপির এই আক্রমণ মানতে নারাজ। দলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বিজেপিকে পাল্টা কটাক্ষ করে উন্নাও ধর্ষণকাণ্ডের প্রসঙ্গ টানেন। তাঁর বক্তব্য, ‘দেশে নারীদের কী ভয়ঙ্কর অবস্থা, সেটা উন্নাওয়ের ঘটনা থেকেই পরিষ্কার। ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর নির্যাতিতা ও তাঁর মাকে দিল্লি পুলিশ ধাক্কা দিয়ে তুলে দিচ্ছে। মৎস্যমন্ত্রীও আসলে সেই সামগ্রিক পরিস্থিতির কথাই বলতে চেয়েছেন।’
রামনগরের ওই অনুষ্ঠানে বিপ্লব রায়চৌধুরীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক অখিল গিরি, তৃণমূল নেতা নিতাই সার, অমিয় ভট্টাচার্য ও হাবিবুর রহমান। পরে বিপ্লব স্পষ্ট করে বলেন, ‘রাজ্যে মেয়েরা অসুরক্ষিত— এ কথা আমি বলিনি। এ রাজ্যে নারীরা শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। কিছু নিচু মানসিকতার মানুষ নারীদের অসম্মান করে। তার বিরুদ্ধেই মুখ্যমন্ত্রী কঠোর পদক্ষেপ করছেন।’
সব মিলিয়ে, নারীসুরক্ষা নিয়ে এক মন্ত্রীর মন্তব্য রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক সাফল্য নিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক তরজা উসকে দিল। শাসক ও বিরোধীর এই টানাপড়েনে মূল প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে—মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি আদৌ কতটা সন্তোষজনক?
Advertisement



