• facebook
  • twitter
Sunday, 21 December, 2025

ধূলিমলিন গ্রন্থাগার দিবসের ভাবনা

আমরা জানি গ্রন্থাগার মানে হল শিক্ষা ও জ্ঞানের আকাশে ডানা মেলার খোলা দরজা। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে যোহান গুটেনবার্গের ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়েছিল বাইবেল।

প্যারিসের একটি সুসজ্জিত লাইব্রেরি।

মহম্মদ শাহাবুদ্দিন

‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে।’ সভ্যতা তেমন করেই মানবতার পাশে এসে দাঁড়ায়, মানুষ এই পারাবারের তীরে খুঁজে পায় তারই সৃষ্ট প্রাচীন সংস্কৃতির চিহ্ন। এই অনুসন্ধানে টাইগ্রিস ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী প্রান্তরে সে খুঁজে পেয়েছে মানুষের প্রথম লেখনীর। পাঁচ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ার এই প্রান্তর ছিল শস্যশ্যামল। মানুষ এখানে আবিষ্কার করেছে সভ্যতার বিখ্যাত সব লেখন সামগ্রী। সেকালে মানুষের লেখাজোখা, সম্পত্তির হিসাব, বিভিন্ন সামাজিক চুক্তি কিংবা জীবনের শেষ ইচ্ছার বয়ান খোদাই করে রাখতো পোড়ামাটির গায়ে। মিশরে আবিষ্কৃত প্যাপিরাস পাতায় লেখা তখনও শুরু হয়নি। পোড়ামাটির সেইসব সংরক্ষণই গ্রন্থাগার তৈরির গোড়ার কথা।

Advertisement

প্রায় চার হাজার বছর আগে অসিরীয় রাজা আসুরবানিপাল রাজধানী নিনেভে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশাল গ্রন্থাগার। প্রায় তিরিশ হাজার কিউনিফর্ম ফলক সংরক্ষিত ছিল এখানে। সম্রাট আলেকজান্ডারের ছিল গ্রন্থাগার গড়ার স্বপ্ন। ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি স্থাপন করেন আলেকজান্দ্রিয়া শহর। তার ইচ্ছা ছিল সারা বিশ্ব থেকে গ্রন্থ এনে রাখা হেবে এখানে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সেই ইচ্ছাপূরণ করতে উদ্যোগী হন প্রথম টলেমি এবং তাঁর পুত্র দ্বিতীয় টলেমি। সেই সাথে এই গ্রন্থাগার গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন দার্শনিক দিমেত্রিয়াস। সারা বিশ্ব থেকে পুঁথি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে এনে তিল তিল করে গড়ে তোলা হয়েছিল এই গ্রন্থাগার। এখানে সংরক্ষিত ছিল সাহিত্যিক নাট্যকার ঈসকাইলাস, সোফোক্লিস, ইর্জরিপিত্তিসের মতো বিখ্যাত মানুষের গ্রন্থ।

Advertisement

জানা যায়, ৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজারের আক্রমণে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এই ধ্বংসকাণ্ডের পর রোমান সম্রাট ট্রাজান ১১২ খ্রিস্টাব্দে রোমে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল গ্রন্থাগার। চতুর্থ শতকে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে ছিল বিশাল গ্রন্থাগার। লক্ষাধিক গ্রন্থের সংরক্ষণ ছিল এখানে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডের সময় তা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। আমাদের উপমহাদেশে বৌদ্ধ সভ্যতার যুগে মঠ ও বিহারগুলিকে কেন্দ্র করে দর্শন ও ধর্মচর্চা শুরু হয়। নালন্দায় ছিল পুঁথি ও গ্রন্থের বিপুল সংগ্রহ। পুস্তকাগারের নাম ছিল ‘ধর্মগঞ্জক’। তক্ষশিলার বিহারেও ছিল দর্শন চর্চার পাঠাগার। যত সময় এগিয়েছে, প্রাচীন থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগ পর্যায়ে আমরা উপনীত, কিন্তু আমাদের জ্ঞানার্জন সেই গ্রন্থাগারের ওপরই নির্ভরশীল। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন গ্রন্থাগার মানুষের জীবনে শাশ্বত আলোক উৎস। মুসলিম বিশ্বে গ্রন্থাগারের খোঁজ পাওয়া যায় প্রাচীন মরক্কোয়। জানা যায়, ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আল কারাওইন নামে গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন একশ জন সম্ভ্রান্ত নারী। এই সময় মিশর ও তিউনিসিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও শুরু হয়েছিল গ্রন্থ সংরক্ষণের আয়াজন। আমাদের দেশে পুঁথি সংগ্রহের প্রয়াস দেখা গিয়েছিল মধ্যযুগে। অজস্র মূল্যবান পুঁথির সন্ধান মিলেছে এখানে। মুলতান জালালউদ্দিন খিলজী এবং মুঘল যুগে হুমায়ুন বাদশা তাঁর রাজপ্রাসাদে সংরক্ষণ করেছিলেন অজস্র পুঁথি ও গ্রন্থ।

উনিশ শতক ছিল বাংলা নবজাগরণের যুগ। আধুনিক শিক্ষা সংস্কৃতির জাগরণ এনেছিল মানবতাবাদের নতুন চেতনা। কলা, শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প ভাবনার নতুন উন্মেষ ঘটেছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষে দেখা দিল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। ১৭৮৪ সালে স্যার উইলিয়াম জোনস কর্তৃক এশিয়াটিক সোসাইটি এবং তার গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গ্রন্থাগার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে গ্রন্থাগার থাকলেও, পরে গ্রন্থগুলি অন্যান্য সংগ্রহশালায় স্থানান্তরিত করা হয়। ১৮১৯ সালে বাঙালি বিদ্বতজনেরা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘কলিকাতা গ্রন্থাগার সমিতি’ গঠন করেন। এই প্রচেষ্টা ছিল আগামী দিনে আরও গ্রন্থাগার গড়ে তোলার সংকেত। ১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘কলিকাতা বিদ্যালয় পুস্তক সমিতি’ একই উদ্যোগ নিয়েছিল। এই সমিতির সাথে গভীর যোগাযোগ ছিল রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের। ১৯ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে জন্ম হয়েছিল বহু কলেজের।

১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ, ১৮১২ সালে শ্রীরামপুর কলেজ। ১৮২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হল সংস্কৃত কলেজ, ১৮৩৫-এ সেন্ট জেভিয়ার্স এবং ১৮৩৬-এ হুগলি মহসীন কলেজ। সব কলেজেই ছাত্র সহায়তার জন্য ছিল গ্রন্থের সমাহার।

আধুনিক গ্রন্থাগার স্থাপনার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিল ১৮৩৫-এ। চার্লস মেটাকাফ সমকালীন কলকাতার বিদগ্ধ মানুষদের নিয়ে আগামী দিনে বাংলায় জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার জন্য এক বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকে সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধানাথ শিকদার, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহেন্দ্রলাল সরকার, জে সি মার্শমানের মতো মানুষেরা। এই বৈঠকের ফলশ্রুতিতে ১৮৩৬-এর ২১ মার্চ জন্ম নিয়েছিল ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি। সূচনা ঘটল এদেশের প্রথম গণ গ্রন্থাগারের। ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জনের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠল ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই গ্রন্থাগার উঠে এসেছিল এসপ্লানেডের জবাকুসুম হাউসে। সেখান থেকে উঠে আসে স্ট্র্যান্ট রোডের মেটকাফ হলে। ১৯৫৩-র ১ ফেব্রুয়ারি ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি পাকাপাকিভাবে স্থানান্তরিত হয় বেলভেডিয়ার প্রাসাদে। ততদিন এই গ্রন্থাগার পেয়েছে জাতীয় গ্রন্থাগারের মর্যাদা। নাম হল ন্যাশনাল লাইব্রেরি। এই দিনে স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদ সর্বসাধারণের জন্য এই গ্রন্থাগারের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। সারা বিশ্বে এখন অসংখ্য গ্রন্থাগার। এই ডিজিটাল পড়াশোনার যুগেও অসংখ্য পাঠকের ভিড় বিদেশের উন্নত গ্রন্থাগারগুলিতে। রাশিয়ার বেশির ভাগ মেট্রো যাত্রীরা মোবাইল দেখার বদলে লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়তে পড়তে গন্তব্যে পৌঁছান। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি, ব্রুকলিন লাইব্রেরি, লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি, বার্লিন মস্কোর স্টেট লাইব্রেরিগুলি তাদের ঐতিহ্য আজও বজায় রেখে চলেছে। আমাদের গর্ব কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার। অসংখ্য লাইব্রেরি আমাদের রাজ্যে এবং জেলা শহরগুলিতে। এর মধ্যে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারের সংখ্যা ২৪৮০টি। কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যে লক্ষ লক্ষ গ্রন্থ নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও বইয়ের তেমন রক্ষণাবেক্ষণ নেই। কোথাও বই আছে লাইব্রেরিয়ান নেই। আবার লাইব্রেরিয়ান আছে বইয়ের পাঠক পাওয়া যায় না। ধূলায় ধূসর এদেশের গ্রন্থাগারগুলিতে হাজার হাজার দুষ্প্রাপ্য পুস্তক। গ্রন্থগুলিকে ধূলিমুক্ত করে পাঠকের দৃষ্টির আলোয় আনা যাচ্ছে না। গত চার দশক ধরেই গ্রন্থাগারগুলি অবহেলায় মলিন হয়েছে।

১৯২৫ সালের ২০ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ। সেই থেকে ২০ ডিসেম্বর চিহ্নিত হয়ে আছে গ্রন্থাগার দিবস হিসাবে। আজও আমরা পালন করি এই দিনটাকে। কিন্তু আজকের এই মরচে ধরা পরিকাঠামো দেখে মনে হয় ‘গ্রন্থাগার দিবস’ পালন করার সাথে এই দিনটিকে গ্রন্থাগারকে বাঁচানোর দিবস হিসেবেও পালন করা উচিত। গত কয়েক দশক ধরে সাধারণ ও সরকারি গ্রন্থাগারের উন্নতির জন্য নেওয়া সিদ্ধান্তগুলি অসফল রয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালে নতুন করে গ্রন্থাগার আইন তৈরি হওয়ার পর রাজ্যে ১৪৭৯টি সরকার পোষিত গ্রন্থাগার তৈরি হয়েছিল। গত কয়েক দশকে ১২০০টি গ্রন্থাগার পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার মুখে। চার হাজারেরও বেশি পদে কোনও কর্মী নেই। এছাড়া গ্রন্থাগার আধিকারিক এবং পরিষেবা দপ্তরে ব্যাপক পদ শূন্য। যে সব ছাত্রছাত্রী গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতক হচ্ছেন তাঁদেরও ঠিকমতো নিয়োগ হচ্ছে না।

আজকের যুগে বৈদ্যুতিন মাধ্যম, ইন্টারনেট মানুষকে বই পড়া থেকে অনেকটা সরিয়ে দিয়েছে। তাকে লাইব্রেরি বিমুখ করে তুলেছে। তাই সাহিত্য, গল্প, ফিচার, পত্রিকা আর তেমন মানুষের হাতে হাতে ঘোরে না। উন্নত মানের সাময়িকীর সংখ্যাও এখন কমে এসেছে। সবই এখন ল্যাপটপ কিংবা মোবাইলের পর্দায়। তবে এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। ধূলিমলিন গ্রন্থের ওপর থেকে ধূলোর আস্তরণ সরাতে হবে। এই অবস্থা বদলাতে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। পাঠকদের আগ্রহ সৃষ্টি করার দায়িত্ব আমাদের। ইন্টারনেট তো একটা দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্যপ্রদান করে। গ্রন্থ মিলে ধরে একাধিক দৃষ্টিকোণ। যা আমাদের চিন্তাধারার বিস্তার ঘটায়। বই পড়ার অভ্যাস আগামী প্রজন্মের মধ্যে তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ের নীচু ক্লাস থেকেও এই অভ্যাস গড়ে তোলা যায়। এক সময় বিদ্যালয়ে সপ্তাহে একদিন লাইব্রেরি ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট থাকতো। প্রতি সপ্তাহে চলত বই দেওয়া নেওয়া। এখন সে সব দেখা যায় না।

আমরা জানি গ্রন্থাগার মানে হল শিক্ষা ও জ্ঞানের আকাশে ডানা মেলার খোলা দরজা। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে যোহান গুটেনবার্গের ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়েছিল বাইবেল। সেই মুদ্রণই পরবর্তী শতাব্দীর সামনে গ্রন্থের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়। সভ্যতার প্রতিটি যুগে মানুষের উপলব্ধির ধারক হয়ে উঠেছে গ্রন্থ। গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের তাৎপর্য ও তার পরিকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন পৃথিবীর শিক্ষাবিদরা। উনিশ শতকের শেষে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানী মেলিভিল জিউই গাণিতিক নিয়মের প্রয়োগ করে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থাগারকে মানুষের অগ্রগতিতে চিরকালের সাথী বলে উল্লেখ করেছেন। আসুন আমরা সবাই মিলে গ্রন্থাগারকে আমাদের জীবনের অংশ বানাই, ফিরিয়ে আনি গ্রন্থাগারের সেই হারানো দিনগুলিকে।

Advertisement