• facebook
  • twitter
Sunday, 14 December, 2025

রাঢ় বাংলার নবান্ন উৎসব ও অন্নপূর্ণা পূজা

কবির কবিতার লাইনের মতোই নবান্নে নতুন করে সেজে ওঠে চিরায়ত বাংলার রূপ। আত্মীয়-স্বজনের আগমনে গ্রাম বাংলার প্রতিটি গৃহের আঙিনা হয়ে উঠে মধুময়।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

মৃণালকান্তি ভট্টাচার্য্য

‘জননী, তোমার শুভ আহ্বান
গিয়েছে নিখিল ভুবনে—
নূতন ধান্যে হবে নবান্ন
তোমার ভবনে ভবনে।’

Advertisement

নবান্নের বর্ণনা দিতে গিয়ে এমনই পঙ্‌ক্তিমালা সাজিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে গ্রাম-বাংলার ঘরে-ঘরে নতুন ধানে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। এটি একটি প্রাচীন উৎসব। শুধু বাংলা নয়, বাংলার বাইরেও অনেক জায়গায় বাঙালি-অবাঙালিরা মেতে ওঠেন নবান্ন উৎসবে। নবান্ন শস্যভিত্তিক একটি লোকউৎসব। নতুন আমন ধান ঘরে তোলার পর রাঢ় বাংলার কৃষিজীবী মানুষ ঘটা করে পালন করেন নবান্ন উৎসব। হেমন্তের শিশিরস্নাত হিমেল বাতাস যখন হিল্লোল তোলে সোনালী ধানক্ষেতে, চাষীরা তখন সেই মিঠে কড়া রোদ গায়ে মেখে সোনার ফসল কেটে গোলা ভর্তি করেন। নিকানো উঠানে ঝকঝকে আলপনার শুভ্রতা আর নতুন চালের গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা।

Advertisement

এখানে জেনে রাখা ভালো, ধান থেকে দুটি ভিন্ন পদ্ধতিতে চাল তৈরি করা হয়। একটি হল, নতুন ধান সরাসরি রোদে শুকিয়ে চালকলে ভাঙ্গানো হয়। এই চালকে বলা হয় আতপ চাল। অপরটি হল, নতুন ধান প্রথমে জলে ভিজিয়ে রেখে তারপর হাঁড়িতে বা কড়াইতে একবার ভাপানো হয়। এই এক ভাপা ধান রোদে শুকিয়ে তারপর চালকলে ভাঙিয়ে চাল তৈরি করা হয়। এই চালকে বলা হয় উষ্ণ চাল। আতপ চাল গোটা বা গুঁড়ো করে নানাবিধ ফল এবং মিষ্টান্ন দ্রব্যাদি মিশিয়ে নবান্ন হিসেবে খাওয়া হয়। আর উষ্ণ চাল রান্না করে ভাত হিসেবে খাওয়া হয়। ধান থেকে এই চাল তৈরির প্রতিটি পর্যায় প্রতি গৃহস্থালীতেই খুবই নিষ্ঠা সহকারে এবং আচার মেনে করা হয়।
স্থানভেদে নবান্নের আয়োজনে কিছু তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন বর্ধমান ও কালনা সন্নিহিত অঞ্চলে নবান্নে গোটা আতপ চাল খাওয়া হলেও, সমগ্র কাটোয়া মহকুমা ও বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আতপ চাল গুঁড়ো করে খাওয়া হয়। গুঁড়ো আতপ চাল দুধ, ক্ষীর, চাঁচি ও কুচো ফল দিয়ে ভালো করে মাখানো হয়। মাখানো চালের সাথে আলাদা করে নানাবিধ উপকরণ সাজানো হয়। বিশেষ করে আখ, নারকেল, শাঁক আলু (শরবতী আলু), লাল আলু, মুলো ও আদা কুচি নবান্নের মিশ্রণের প্রধান উপাদান। সঙ্গে নানান মিষ্টান্ন দ্রব্যও থাকে। এ যেন এক অপূর্ব স্বাদ! সমগ্র মিশ্রণটি কলাপাতায় খাওয়া হয়।

প্রথমে কুলদেবতা, গৃহলক্ষ্মী ও গ্রাম্য দেবদেবীর উদ্দেশ্যে নবান্ন নিবেদন করা হয়। তারপর বাস্তুদেবতা, মৃত পূর্বপুরুষ, পশুপক্ষীর উদ্দেশ্যে বাড়ির উঠানে ও সদর দরজার বাইরে কলাপাতায় নৈবেদ্য দেওয়া হয়। সবশেষে গৃহকর্তা পরিবারের সকলের সাথে সানন্দে কলাপাতায় নবান্ন গ্রহণ করে থাকেন। দুপুরে উষ্ণ চালের ভাত, শাক, নয় রকম ভাজাভুজি, তরিতরকারি, মাছের বিভিন্ন পদ, পায়েস, চাটনি, মিষ্টান্নসহ মধ্যাহ্নভোজনের এলাহী আয়োজন হয়ে থাকে।

অঘ্রাণ মাসে রাঢ় বাংলায় নবান্ন উৎসব উপলক্ষে অন্নপূর্ণা পূজাও হয়ে থাকে। বর্ধমান-কালনা-কাটোয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই সময় ধুমধাম করে অন্নপূর্ণা পূজা হয়। এই পূজা কোথাও একদিনের আবার কোথাও চার-পাঁচ দিনব্যাপী হয়ে থাকে। এইসব এলাকায় নবান্ন আর অন্নপূর্ণা পূজা যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে ওঠে। এইরকমই একটি ঐতিহ্যবাহী পুজোর কথা তুলে ধরছি এখানে। কাটোয়া মহকুমার কেতুগ্রাম-১ ব্লকের বেড়ুগ্রামে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে চারদিনের অন্নপূর্ণা পূজার প্রচলন আছে। এটি বর্ধমান জেলার নবান্ন সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রাচীন রীতি। বাংলা ১৩২৭ সন থেকে এই ব্যতিক্রমী অন্নপূর্ণা পূজা মহাসমারোহের সহিত পালিত হয়ে আসছে। বেড়ুগ্রাম অন্নপূর্ণা বান্ধব সমিতির পরিচালনায় এই পূজাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।

পুরনো মন্দির ভেঙে দাক্ষিণাত্য শৈলীর ধাঁচে নতুন মন্দির নির্মিত হয়েছে। দেবী মূর্তির আদলে বৈচিত্র্যের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। এক চালার কাঠামোয় দেবী অন্নপূর্ণা মাঝখানে বিরাজমান। দেবীর ডান হাতে চামচ ও বাম হাতে অন্নপাত্র। ডান পাশে দণ্ডায়মান অন্নগ্রহণকারী ক্ষুধার্থ মহাদেব। বাম পাশে পদতলে বিরাজমান ধনপতি কুবের। তার ঠিক পাশেই দণ্ডায়মান নারদ ঋষি। সুদৃশ্য চালির দুই প্রান্তে কিছুটা উপরের দিকে উড়ন্ত ভঙ্গিমায় দেবী অন্নপূর্ণার দুই সহচরী পরী বা অপ্সরা।

উৎসবের দিনগুলিতে প্রভাতফেরী, বাউল গান, কবি গান, কীর্তন গান, যাত্রাপালা, নাচ-গানের আসর, আতস বাজি পোড়ানোর মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপশি সম্প্রীতির ফুটবল ম্যাচ, রক্তদান, বৃক্ষরোপণ, বস্ত্র বিতরণ, কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা সহ নানান সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শেষ দিন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহকারে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে দেবীর বিসর্জন হয়। পুজোকে কেন্দ্র করে সাতদিনব্যাপী বিরাট মেলাও বসে।

ঐতিহ্যবাহী চিরাচরিত এই গ্রামীণ উৎসবে মাটির সাথে কৃষকের আত্মিক মেলবন্ধনের এক অনন্য রূপ প্রকট হয়ে ফুটে উঠে। তাই তো কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বলেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ মানুষ নয়— হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’

কবির কবিতার লাইনের মতোই নবান্নে নতুন করে সেজে ওঠে চিরায়ত বাংলার রূপ। আত্মীয়-স্বজনের আগমনে গ্রাম বাংলার প্রতিটি গৃহের আঙিনা হয়ে উঠে মধুময়। সর্বত্র গুঁড়ি কোটার শব্দ, শঙ্খ ধ্বনি, উলু ধ্বনি, ইত্যাদিতে গ্রামাঞ্চল হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। এখন প্রশ্ন হল, নবান্ন উৎসবে দেবী অন্নপূর্ণার পূজা কেন করা হয়? নবান্নের সহিত দেবী অন্নপূর্ণার মিল কোথায়? পৌরাণিক মতে, অন্নপূর্ণা হলেন শস্যের দেবী। অন্নদান করে ক্ষুধা নিবৃত্তি করেন যে দেবী, তিনিই অন্নপূর্ণা। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও বন্যার ফলে ফসল নষ্ট হলে আর্থসামাজিক জীবনে নেমে আসে চরম দারিদ্র্যতা। কথিত আছে, এই মড়ক বা দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রেহাই পেতেই অন্নপূর্ণা পূজার প্রচলন হয়েছিল। তাই আজও লক্ষ্য করা যায় দেবীর হাতে নতুন ধানের সোনালী শীষের গুচ্ছ। আর এখানেই কাশীর অন্নপূর্ণা এবং বাংলায় পূজিত অন্নপূর্ণার মধ্যে আমরা সুন্দর সাযুজ্য খুঁজে পাই।

আগমবাগীশের ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থ থেকে অন্নপূর্ণা পূজার মাহাত্ম্য আমরা খুব ভালো করে জানতে পারি। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্যেও অন্নপূর্ণার স্তুতি করা হয়েছে এই ভাবে—
‘অন্নপূর্ণা ভগবতী মূরতি ধরিয়া।
স্বপনে কহিল মাতা শিয়রে বসিয়া।।
শুন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র না করিয় ভয়।
এই মূর্তি পূজা কর দুঃখ হবে ক্ষয়।।’
অন্নপূর্ণা দেবী আমাদের সকল দুঃখ হরণ করে প্রতিটি গৃহ অন্ন দিয়ে ভরিয়ে তুলবেন। তাই নবান্ন হল আনন্দের উৎসব। দারিদ্র উপশমের উৎসব। ক্ষুধার জ্বালা নিরসনের উৎসব।

Advertisement