উত্তরাধিকার
সজল দে
আমার বাবার
একটা আকাশি রঙের জামা ছিল
আকাশ ছিল না
বাল্যের সে-আকাশ ফেলে এসেছিলেন
মেঘনা নদীর চরে
যেখানে জীবন ছিল ভাসন্ত, দোদুল্যমান
Advertisement
বাবার মৃত্যুর পর
এপারের শ্মশানে সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছি
ওই জামা তবু রেখেছিলাম কিছুদিন
পিতার অনুষঙ্গ হিসাবে
তোরঙ্গ থেকে বার করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম
ক্বচিৎ-কদাচিৎ
Advertisement
এখন আমারও
একটা আকাশি রঙের জামা আছে
ঠিক বাবার মতো নয় যদিও
কিন্তু তার পকেটে হাত দিলে
মেঘনা-চরের ঘাসের ঘ্রাণ আসে
নৌকার বৈঠার ছলাৎ শুনতে পাই যেন
আর আঙুলদুটি তুলে দেখি
মেঘনা-আকাশের রঙ লেগে গেছে কীভাবে।
ঘণ্টাধ্বনি
কঙ্কণ নন্দী
দিনের সমস্ত আলো শেষ হয়ে এলে ঘণ্টা বাজে
রাত্রির আঁধার ফুরিয়ে এলে ঘণ্টা বাজে
তখন আলোর রথ দিগন্তসীমায়
সব নদী সমুদ্র স্নান সেরে ঘাটেই দাঁড়ায়
পাখি তার আকাশের পথে ফেলে যায় ঘর
চাদর গুটিয়ে তোলে অসীম প্রান্তর।
ঘণ্টা বাজে, বেজে বেজে শব্দজগৎ জড়ো করে
জন্মের আগেও যেমন মৃত্যুরও পরে
একই শব্দ তার একই তার ধ্বনি
চরাচর গ্রাস করে খোলায় আপনি
সব বন্ধ দ্বার অসীম অপার সুদূরের পানে
যেতে হবে বলে হাত টানে।
যাব কি দুয়ার রুদ্ধ মন খোঁজে নাম
টেবিলে পড়ে থাকে মুখ বন্ধ খাম
ডাক তার পায় না ঠিকানা খুঁজে মরে
মানুষের কাছে যায় এ ঘরে ও ঘরে
তারপর একদিন সব শেষে জানি
মনে হবে অফুরান শুধু ঘণ্টাখানেক।
নীল বালিশ
বিশ্বজিৎ লায়েক
১.
খোলা পিঠ ছুঁয়েছে তার বিবস্ত্র চাঁদ
রাত্রি জানে না কুকুরের ঘ্রাণ নিয়ে কারা
লেখে গান
কারা পোড়ায় জীর্ণ দেহ
অবাধ পরিশ্রম
২.
উঠোনে শুকোচ্ছে ধান
বারান্দায় শুয়ে আছে আত্মকলহের রোদ
ঝুলে আছো, ঝুলেই থাকো যেমন থাকে
বয়ঃসন্ধিকাল
এ সরাইখানায়
প্রাণজি বসাক
অঙ্কের সমষ্টি জুড়ে তৈরি কথায় তোমাকে ডাক পাড়ি
তুমি দুয়ার খুলে কোনদিকে যাও— ওদিকের খবর শুনি
জন্মের অন্ধকার আজকাল দিনের আলোতেও উজ্জ্বল
কোনদিকে যাও— টিশার্ট যুবক জানে না অঙ্কের ভাষা
পৃথিবী ঘুরছে কিনা সূর্যটা অসুস্থ কিনা এসব জানে না
রাধে রাধে কৃষ্ণবাঁশির মিহিন সুর ডিজের বিধ্বংসী শব্দে
মরে গেছে মিডনাইট উল্লাসে উৎসব নামে এক যন্ত্রণায়
কতসব অঙ্কের সমষ্টি নিয়ে এ সংসার পেতেছ নিঃশব্দে
দুয়ারে রোদ পড়ে ছায়া ঘুরে ঘুরে আসে শালিক খুঁটে খায়
পরমান্ন— আর কি দেখা হবে এ গোলার্ধে এ সরাইখানায়
তিনটি কবিতা
শ্রীপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়
মনসামঙ্গল
শুনেছি ভাসান গান।
দেখেছি লখিন্দর ভেসে যায় জলে।
ব্যর্থ বাসরসজ্জা, কুণ্ডলী পাকানো অভিমান
রক্তাভ কলার ভেলা, অন্ধ গাঙুড়,
নদীতে ঠিকরে ওঠা জোৎস্না বহুদূর
বেহুলার পূর্ণচন্দ্র দেহের ভেতর
আঁকাবাঁকা নদীপথ, বাণিজ্যতরী
ইন্দ্রের মদির নয়ন।
ঘুমের ভেতরে আজ মনসার গান
ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, কন্যাসন্তান হয়ে
আমার রক্তবাহী শিরায়, স্নায়ুতে।
মধ্যবর্তী
ভোর হচ্ছে আলো আসছে।
দুটো নীলচে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে
বাগানে। রাস্তার ওপাশে একটা কাক
মরে পড়ে আছে। স্পর্শ না করেও বোঝা যায়
ঠাণ্ডা আর শক্ত তার দেহ।
আমি দাঁড়িয়ে আছি গেটের সামনে।
জীবন আর মৃত্যুর ঠিক মাঝখানে।
জানি না আজ কাকে দরজা খুলে দেব।
বাইফোকাল
স্পষ্ট হচ্ছে না হাতে ধরে থাকা কাগজের
অতি পরিচিত অক্ষর। অল্প অল্প করে
ঝাপসা হচ্ছে চেনা জগৎটা।
কাচের মত স্বচ্ছ ছিল যেসব স্বপ্নগুলো
তাদের সবার গায়ে জড়ানো শীতের চাদর।
অস্বচ্ছ, জড়োসড়ো।
প্রতিবিম্বে ঝাপসা শরীর।
ডাক্তার, লেন্স, নতুন চশমা
পুরোনো শরীর ঘিরে
যত আয়োজন
একে একে ব্যর্থ হয়।
সময় পৌঁছে যায় নিজস্ব গন্তব্যে,
স্মৃতিচিহ্ন পড়ে থাকে
সীতার ছড়িয়ে যাওয়া
গহনা যেমন।
ধূসর গোলাপ
ঐশী চক্রবর্তী
১
অপূর্ব শব্দরহস্য, একবার ছিঁড়ে ফেলে সামনে এসো
অনাস্বাদিত আঁধার তোমার!
প্রিয় নিশীথ রঙ্গনে, জানো তো, কারা ধরে কায়া?
লুকোচুরি খেলতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম—
কারুকার্যময় চেয়ার পাতা, স্তব্ধ লন্ঠন জ্বলছিল শুধু
কয়েকটি ধূসর গোলাপ ফুটেছিল রাস্তার ধারে
তরঙ্গহীন ইটের বাড়ি, প্রাণের ধ্বনিটুকু নেই যেন
আর বাড়ির ধার ঘেঁষে সারি সারি বইয়ের দোকান
অগোছালো বই সব, অনেকটা অস্পষ্ট কাচের মতো…
২
কাচের মতো হলেই তো শিরীষ-ভাষ্য, উত্তাল মৃগনাভি
আসলে রক্তশূন্য শ্বেতা, মানুষ দেখিনি বহুকাল হল
প্রবল বর্ষণে লুটিয়ে পড়েছে জন্মাবধি অধর-পিয়াসী
দোতলার বারান্দা থেকে ছায়া ছায়া অবয়ব দেখি
নিরুক্ত সুর, মনে হয় হারিয়ে গিয়েছিলাম কোথাও
অন্য আকাশ কুয়াশায়— ধূসর গোলাপের দেশে,
অলৌকিক সারি সারি বইয়ের দোকানে অনন্তকাল
কাটিয়েছি বইগুলো পড়ে, জাদুবিদ্যা লেখা ছিল,
লেখা ছিল জলই বরফ আর বরফ তো জল…
৩
চলে আসার আগে হাতে নিয়ে এসেছি বিষণ্ণ মৃণাল,
বারান্দা থেকে ঝুঁকে দেখি সরোবরে ছায়ামাখা অবয়ব কার!
Advertisement



