প্রবীর মজুমদার
সম্প্রতি ভারতের প্রধান বিচারপতি বি. আর. গাবাই সংরক্ষণের সুবিধা বিতরণের পদ্ধতি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একজন আই এ এস অফিসারের সন্তানকে কোনোভাবেই একজন দরিদ্র কৃষিশ্রমিকের সন্তানের সমতুল্য গণ্য করা যায় না। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, সংরক্ষণের মূল লক্ষ্য হল যাঁরা এখনও সামাজিকভাবে ও শিক্ষাগত দিক থেকে বঞ্চিত, তাদের উন্নয়ন নিশ্চিত করা। যে সকল পরিবার ইতিমধ্যেই যথেষ্ট আর্থিক বা প্রশাসনিক সুবিধা লাভ করেছে, তাঁদের জন্য এই সুবিধা প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়। প্রধান বিচারপতি এখানে ‘ক্রিমি লেয়ার’ নীতির প্রসঙ্গ টেনেছেন। বর্তমানে এই নীতিটি কেবল অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তিনি যুক্তি দেন, তফসিলি জাতি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের যাচাই প্রয়োজন, যাতে সুবিধাগুলি সমাজের চরমতম পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলির কাছে পৌঁছায়।
Advertisement
এই নীতিটি সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯২ সালের ঐতিহাসিক ইন্দিরা সাহনি (মন্ডল) মামলার রায় থেকে উদ্ভূত। সেই রায়ে বলা হয়েছিল যে, অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে অপেক্ষাকৃত উন্নতদের সংরক্ষণ থেকে বাদ দিতে হবে, যাতে কোটা ব্যবস্থা সেইসব মানুষদের সেবায় আসে যাদের আসলেই খুব দরকার।গাভাইয়ের এই মন্তব্য আইন ও নীতি নির্ধারণের মহলে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। যদি এই ‘ক্রিমি লেয়ার’-এর ধারণাটি কখনও তফসিলি জাতিদের ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়, তবে এটি একটি সাংবিধানিক প্রশ্ন উত্থাপনকারী ও সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হবে। এককথায়, প্রধান বিচারপতি জোর দিয়ে বলেন, যে সংরক্ষণের সুবিধা শুধুমাত্র প্রকৃত প্রান্তিক গোষ্ঠী, যেমন কৃষি-শ্রমিকদের সন্তানদের পাওয়া উচিত, উচ্চ-আয় বা উচ্চ-মর্যাদার পরিবারদের নয়।
Advertisement
ভারতের সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার, ১৪৬ কোটির দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং চাকরিতে কত শতাংশ কোটা আছে। ভারতীয় সংবিধান পিছিয়ে পড়া শিডিউলড কাস্ট, অর্থাৎ তফশিলি জাতির জন্য ১৫ শতাংশ, শিডিউলড ট্রাইব, অর্থাৎ তফশিলি উপজাতির জন্য সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ, আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস (ওবিসি) অর্থাৎ, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য ২৭ শতাংশ এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। সব মিলিয়ে মোট আসনের ৫৯.৫ শতাংশ সংরক্ষণের আওতাভুক্ত।
সংরক্ষণের এই পদ্ধতি নিয়ে ভারতে বিতর্ক নতুন নয়। উল্লেখ্য, সংবিধানের প্রণেতা ভীমরাও আম্বেডকরের যুক্তি ছিল, সামাজিক বিভেদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভারতে যে জনগোষ্ঠীগুলি পিছিয়ে পড়েছে, তাদের উত্তরণের জন্যই সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজন এবং সে কারণেই সংবিধানে সংরক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, একটি নির্দিষ্ট সময় পর যখন পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলি শিক্ষা এবং অর্থনৈতিকভাবে মূলস্রোতের অংশ হয়ে উঠবে, তখন ধীরে ধীরে এই সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে। ভারতীয় সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে প্রথমে আইনসভার আসন সংরক্ষণের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারিত ছিল, যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বৃদ্ধি করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সংরক্ষণ উঠে তো যায়ইনি, বরং আরও বেড়েছে। ২৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ পরবর্তীকালের ঘটনা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিশনকে নিযুক্ত করা হয়েছে ভারতের সামাজিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য। এর মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যেমন আছেন, তেমনই পিছিয়ে পড়া জাতি, উপজাতিরাও আছেন। মন্ডল কমিশন, সাচার কমিশন, রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের মধ্যে অন্যতম। বস্তুত, রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, ভাষাগতভাবে সামাজিক বিন্যাস নিয়েও কাজ করেছিল।
স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরে অধিকাংশ কমিশনের রিপোর্টে দেখা গেছে, পিছিয়ে পড়া শ্রেণির উন্নয়ন যতটা হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই সংরক্ষণের জন্যই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির একটি অংশ মূলস্রোতে মিশে যেতে পেরেছে। অর্থাৎ, সংরক্ষণ ব্যবস্থার সুফল মিলেছে।
এর মধ্যে বিভিন্ন স্তর আছে। ফলে এক কথায় সংরক্ষণ উঠে যাওয়া উচিত অথবা সংরক্ষণ থাকা দরকার- এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন। ভারতের মতো বৈচিত্রের দেশে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার দিকে যেমন অসংখ্য যুক্তি আছে, সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার যুক্তিও তেমন কম নয়। তেমনই কিছু প্রচলিত যুক্তি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
সার্বিকভাবে যদি ভারতীয় রাজনীতির দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে, এত বছর ধরে রাজনীতির একটি বড় ধারা জাত-পাত, ধর্মকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে। বিশেষ করে উত্তর ভারত এবং দক্ষিণের একটি বড় অংশে রাজনীতি পরিচালিত হয় এই অঙ্কগুলি মাথায় রেখে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা সেখানে সামাজিক কল্যাণ নয়, রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে দিনের পর দিন। হয়েছে বলেই, তথাকথিত পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলিকে মূলস্রোতের অংশ হতে দেওয়া হয়নি। বরং জাতিগত, ধর্মীয় বিভেদ টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আজও উত্তর ভারতের নির্বাচনে জাতের ভিত্তিতে ভোট বিভাজন হয়। রাজনৈতিক সভায় সরাসরি জাত, ধর্ম নিয়ে প্রচার করা হয়। ফলে এই অঞ্চলে তফশিলি সংরক্ষণ একটি রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে। কোন জাত কোথায় কত শতাংশ সংরক্ষণ পাবে, তা নিয়ে এখনও এই অঞ্চলে আন্দোলন হয়, রাজনৈতিক দর কষাকষি হয়। যাঁরা এই আন্দোলনে অংশ নেন, তাঁদের সিংহভাগই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সংরক্ষণ তাঁদের রাজনৈতিক হাতিয়ার মাত্র। সংরক্ষণ যখন রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন তার সামাজিক প্রশ্নগুলি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। বলতে দ্বিধা নেই, ভারতে সে ঘটনা ঘটেছে।
গোটা জনজাতি অধ্যুষিত বেল্টে সংরক্ষণ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। সংরক্ষণ হয়েছিল বলেই আজ পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বা গোষ্ঠীর বহু মানুষ মূলস্রোতের অংশ হতে পেরেছেন। জনজাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে আলাদা রাজ্য তৈরি হয়েছে। বহু সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে পুরোপুরি মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য আরও বেশ কিছুদিন সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু থাকা দরকার। তাদের যুক্তি, স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পর সাকুল্যে দু’টি প্রজন্ম সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছে। আরও কয়েকটি প্রজন্ম এই সুযোগ পেলে সার্বিকভাবে একটি শ্রেণির উন্নতি হবে। আটাত্তর বছর সামাজিক উন্নতির নিরিখে খুব বেশি সময় নয়। সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করেন, গত কয়েক দশকে সামাজিক বিন্যাসের বেশ কিছু সমীকরণ বদলেছে। ফলে সংরক্ষণের পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। জাতি উপজাতি, ধর্মীয় শ্রেণির পাশাপাশি ভাষাগতভাবে পিছিয়ে থাকা অংশ, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সে কাজ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। হয়েছে বলেই ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় তফশিলভুক্ত নয়, এমন অনেক গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যে কারণে, সব মিলিয়ে ওবিসি সংরক্ষণের পরিমাণ ভারতে সবচেয়ে বেশি, ২৭ শতাংশ। আবার অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকেও চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। তাদের জন্য আলাদা সংরক্ষণ শুরু হয়েছে।
বৈষম্য এখনও আছে। আর তা আছে বলেই সংরক্ষণের প্রয়োজন ফুরোয়নি। যতদিন সংরক্ষণ রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে থাকবে, ততদিন এই বৈষম্য মিটবে না। কারণ, ভারতীয় রাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভেদ। রাজনীতি নয়, সংরক্ষণ নিয়ে এখনও পর্যন্ত যতগুলি সংস্কারমূলক কাজ হয়েছে, তা হয় করেছে আদালত, নইলে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন। আর সেই একেকটি আন্দোলন একেকটি কমিশন গঠন করতে বাধ্য করিয়েছে সরকারকে। যেখান থেকে সামাজিক পরিস্থিতির ছবিটি স্পষ্ট হয়েছে। আরও অনেক এমন কমিশনের প্রয়োজন আছে। এমন আরও অনেক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। সংরক্ষণকে রাজনীতির হাত থেকে যতটা সম্ভব সরিয়ে নেওয়া এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংরক্ষণ ব্যবস্থা যখন চালু করা হয়েছিল তখন তার উদ্দেশ্য ছিল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সংরক্ষণের আওতায় রেখে উপরে তুলে এনে মোটামুটি সমতা বিধানের চেষ্টা করা। কিন্তু বর্তমানের সংরক্ষণ ভোটের জন্য একটা জমজমাট ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কেউ সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দিতে যাবে সেই বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা হারাবে, ভোটে হেরে যাবে। কে চায় সেই ভোগান্তি!
তবে যে ভাবে সবকিছুর বেসরকারিকরণ হচ্ছে, তাতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা এমনিই কিছুটা গুরুত্বহীন হয়ে যেতে পারে। বেশিরভাগ কোম্পানি প্রমোশন এবং বেতন কাঠামো ঠিক করে যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা অনুযায়ী। তবে সরকারি ভাবে ঘোষনা হবে— ওমুক তারিখ থেকে আর সংরক্ষণ চালু থাকছে না, সে রকম পরিস্থিতি হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আসবে না।
Advertisement



