• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

কবিতা গুচ্ছ

থাক পড়ে, থাক। পূবগাঁয়ে পীরের কবর আর পশ্চিমে পাথর ভগবান। কার কব্জিতে জোরালো মোক্ষ? এসব কচালি থেকে বহুদূরে সে মেলেছে চরৈবেতি।

বাবুই
ঋত্বিক ঠাকুর

উড়ছে। উড়ে যাচ্ছে। দু’ডানায় বাঁধা জল। জলের সম্বল
শুধু ভুবনের খিদে। আর‌ও আর‌ও বিশ্ব ও বিস্ময়
চোখে এ উড়াল নিরুদ্দেশ ধেয়ে যাচ্ছে। কার কাছে, কেন, জানে না তা পথ ও পথিক।
দেখছেই না নীচে। বারোয়ারি জ্বরে কে তুলল পতাকা। কারা বলছে, কাঁটাতারে এখন‌ও মুমূর্ষু ঘুড়ি বিঁধে। থাক পড়ে, থাক। পূবগাঁয়ে পীরের কবর আর পশ্চিমে পাথর ভগবান। কার কব্জিতে জোরালো মোক্ষ? এসব কচালি থেকে বহুদূরে সে মেলেছে চরৈবেতি।

Advertisement

মনে পড়ছে, একবার ভাগ্যবন্তপুরে কাঁদরের ঘাটে ডুবতে দেখেছিলাম পাখিকে। গলায় মেঘের দীর্ঘ আলিঙ্গন। মেঘ নাকি পাখি, পাখি নাকি মেঘ, আলাদা আলাদা কোন‌ও পরিচয়ে বাঁচে মরে, বারে বারে খোঁজে জন্মঘোর। ভেবেছি বিস্তর। শেষে মা এসে দিয়েছে টান ভরা উজানের দিকে। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কুমোরপাড়ার মাটিব‌উ। আকাশে অবাক ভাসছে নীলকণ্ঠ চুমু। কাশফুলে সাজানো পরানডাঙা। গান গাইছে তাধিন সকাল।
অমীমাংসায় ধাঁধায় বুড়ো হচ্ছে কুটুম নিয়তি। উত্তরের অপেক্ষা না করে উড়ে যাচ্ছে, উড়েই চলেছে ওই আনন্দ বাবুই। দেখছি, স্পষ্ট দেখছি।

Advertisement

 

প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা
অরূপ আস

সিঁড়ির নিচে ফিকে অন্ধকারে
বাবার জুতোজোড়া
কত মাস কত কত দিন

কপট সমবেদনা ঠোঁটে নিয়ে
পরিজন আসে
আকাশমণির পাপড়িতে
দু-একফোঁটা অশ্রুবারি
মায়ের সিঁথির লাল
ঠাঁইনাড়া হয়ে আজ
ভোরের আকাশ
ললিতের সরগম শেষে
মাছওলার ডাক—
ফিরে যায়
ফিরে যায় ব্যর্থ অন্বেষায়

সিঁড়ির নিচে ফিকে অন্ধকারে
বাবার জুতোজোড়া
কতমাস কত কত দিন…

 

কথন
নাসির ওয়াদেন

এভাবে নিজেকে বেঁধে রাখে আত্মবোধ
তন্ময় পাহাড়ের ঢালে কিছু মর্যাদার মেষ চরছে
হয়ত ওদের খুরের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে
স্বপ্নে-আঁকা ভবিষ্যতের উপাদান।

নিজেকে খনন করতে করতে খুঁজে নিচ্ছিলাম
পোড়া জীবনের খণ্ড খণ্ড সত্তাগুলোকে।


প্রেমের কবিতা লিখতে গেলেই রাজনীতির কথা আসে
আজকাল রাজনীতির সংজ্ঞায় প্রতারণা,
সময়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দাঁড়িপাল্লায়
ওজন করলে চির-সময় উঠে আসে
যা লিখি তা জীবনের জন্য, যা লিখতে পারিনি
তাও জীবনের জন্য

জীবনের ক্ষরিত স্বপ্নগুলো মায়ার জলে ভেজানো
জল ঝরে গেলেও শুকিয়ে যায় না
কিন্তু, সেই জলদাগ মুছতে পারিনি এখনও।

 

সীমানা
সিদ্ধার্থ মজুমদার

সীমানার গায়ে নিষেধই পড়েছ শুধু
আশঙ্কা আর সংশয় অনিশ্চিত…

একবার ছুঁয়েছে যে সীমানার রেখা
শুধু সেই জানে, ওইখানে পিয়ানোয়
গানে-গানে ঢেউ নদী,আহ্বান-ইঙ্গিত!

 

আমার মুক্তি
দেবজাত

হাওয়া,
সঙ্গীত হয়ে ওঠে।

জল,
জলতরঙ্গ।

পাখির নরম পালকের মতো—
ডানা ঝাপটিয়ে ওঠে মৈথিলী-ভোর।

এসো,
এই তো সময়…

আমরা,
সুরেলা হাওয়ায় ভাসি, ভালোবাসি,
আমরা প্রদক্ষিণ করি
পরস্পর, পরস্পরকে।

প্রদক্ষিণ করতে করতে পৌঁছে
যাই তিন ভুবনের পারে…
যেখানে চারিদিকে
শুধু আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ।

এরপর—
উড়তে, উড়তে, উড়তে এক
আকাশছোঁয়া আমি।

পাখির চোখে চেয়ে দেখি:
নীচের বিন্দু বিন্দু আমিগুলিকে।

আর তুমি?
ভাসতে, ভাসতে ভাসতে—
জল, জল, শুধু দানিয়ুব-জল…
জলায়, ছায়ায়।

 

অনঘসংহিতা
শীর্ষা

আমার কোল বেয়ে অনঘ ঝরে পড়ে,
আমার বুক বেয়ে অনঘ ঝরে পড়ে,
আমার প্রাণ বেয়েও অনঘ ঝরে পড়ে!
আকাশের পেটে হাঁস ভেসে যায়,
জলের পিঠে মেঘ ভেসে যায়,
গাছের ত্বকে কুসুম ভেসে যায়!
সেই আকাশ থেকে
জল থেকে
কুসুম থেকে
অমৃতসমান দুধ ঝরে পড়ে—
দুধের সাদায় অনঘকে স্নান করাই।
জরায়ু থেকে জন্ম নেওয়া স্নেহের তুলোয়
অনঘকে মুড়ে রাখি।
গাল বেয়ে বইতে থাকা সুখনদীর ঢেউয়ে
অনঘমাঝির নৌকো ভাসাই।
এভাবেই আমার চুলের ভ্রমরে
আমার বুকের পিঞ্জরে
আমার মন্দ্রগম্ভীরে
শুধু অনঘ খেলা করে—
আমি মা হয়ে উঠি,
আমি পৃথিবী হয়ে উঠি।
আমি স্বয়ং অনঘ হয়ে উঠি!

 

মাছেদের কথা, জলপরির কথকতা 
বিজয় ঘোষ
মাছেদের ভালোবাসা শুধু জলই জানে
যে জলপরি সাঁতার কাটে জলে;
বস্তুত দাপাদাপি করে তার স্বেদ এবং
মূত্র মিশে যায় জলে
জলপরি মাছেদের ভালোবাসে না
জলও কী ভালোবাসে তাকে?
মাছেদের নীলগল্প মিশে থাকে জলে
কিছু কিছু জল বাষ্প হয়ে ওড়ে যায় আকাশে
আকাশে বাসর রচনা হয় না; রঙিন কোনও মাছের
জলপরি ভেসে ভেসে বেড়ায় অলীক ঝরনায়
জল কেবলই মাছেদের কথা মনে রাখে।

ফসিল
সুজাতা ঘোষ

আজ তোমার বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি।

বাড়িটা আমার কাছে এখন মমি প্রেমের স্তূপ।

শ্যাওলা পিছল ইঁটের ফাঁকে সন্দেহের শিকড়
বাকড়ের ঝুরি।

পা পাতলে চুরচুর হচ্ছে ফাটা মেঝেতে
ছড়িয়ে থাকা ঝরে যাওয়া মৃত বিশ্বাস।

খসে পড়া চুম্বন আটকে শিকভাঙা জানলায়।
যে কপাটগুলো আমাদের উদ্দামতার সাক্ষী তারা
এখন সারা গায়ে বলিরেখা মেখে রৌদ্রস্নানরত।

উঠোনের ফাটল চুঁয়ে ভালবাসার সমাধি সপ্তপাতালে।

চার চোখের শুভদৃষ্টি অঙ্গে জড়িয়েছে ধুলোর রজাই।
লোহার শিকলবন্দী দমবন্ধ অঙ্গীকার

দমকা হাওয়ার প্রতীক্ষায় মৃতপ্রায়।

ভবিষ্যতের রোদের জন্য আমি দূরে যেতে চাই,
অনেক দূরে, এই প্রাগৈতিহাসিক ফসিল ছেড়ে।

তুমি দরজার কপাট উদার করে দাও।

 

বর্ষামঙ্গল
আশীষ নিয়োগী

গোপন দুঃখের মতো বৃষ্টি পড়ছে!
হয়তোবা খুশির উচ্ছ্বাসের মতো অথবা নিরালা দুপুরে
কোন গোপন কান্নার মতো।
এই বাদলার দিনে সে যেন বিস্মৃত বন্ধুর মতোই,
অনুমতি ছাড়া হঠাৎ এসেছে
আমার জলে ছপছপ বারান্দায়।
গোপন আফশোসের বৃষ্টি জলে ভিজে,
চল বন্ধু—
একান্তে আমরা কাগজের নৌকা ভাসাই…

Advertisement