• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

সনাতনী জুতো

হিন্দুত্ববাদীদের কাশী-মধুরার মতো অ্যাজেন্ডা, আর বিজেপি সরকারের বুলডোজার নীতি, সবই সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়েছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

আদালতের এজলাসের মধ্যেই প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাইকে লক্ষ্য করে জুতো ছোঁড়ার চেষ্টা করেন এক আইনজীবী। জুতো প্রধান বিচারপতির আসন পর্যন্ত না পৌঁছলেও এই ঘটনায় আদালতের উপস্থিত সকলেই হতচকিত হয়ে যান। তারই মধ্যে নিরাপত্তারক্ষীরা রাকেশ কিশোর নামের ওই আইনজীবীকে ধরে আদালত কক্ষের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই আইনজীবী চিৎকার করে স্লোগান দেন, ‘সনাতন কা অপমান নেহি সহেগা হিন্দুস্তান।’ সেই সময়ে প্রধান বিচারপতি গাভাই একটি মামলার শুনানি করছিলেন। তাঁর সঙ্গে বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি কে বিনোদ চন্দ্রন। এই ঘটনায় সাময়িকভাবে আদালতে শুূনানির কাজ থমকে যায়। সেই সময় প্রধান বিচারপতি সওয়ালকারী আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এইসব ঘটনায় বিভ্রান্ত হবেন না। আমরা বিভ্রান্ত নই। এসব ঘটনা আমার উপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না।’ তিনি আইনজীবীদের সওয়াল চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। প্রধান বিচারপতির উদারতার কারণেই সম্ভবত সুপ্রিম কোর্ট হামলাকারী আইনজীবীর বিরুদ্ধে কোনও মামলা করেনি। পুলিশও ওই আইনজীবীকে ছেড়ে দেয়।

এই ঘটনা দেখায় হিন্দুত্ববাদী শক্তির ছড়িয়ে দেওয়া জাতিবিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিষ সমাজের কত গভীরে প্রবেশ করেছে। আরএসএস-বিজেপি যেভাবে জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াচ্ছে, এই ঘটনা তারই পরিণতিতে হয়েছে। যদি প্রধানমন্ত্রী মোদী এক্সে পোস্ট করে এই ঘটনাকে ‘অত্যন্ত নিন্দনীয়’ বলেছেন। সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন এবং বিশিষ্ট আইনজীবীরাও এই ঘটনার কড়া নিন্দা করেছেন। বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলেছেন, ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার এক আইনজীবী কাপুরুষোচিত হামলা করে প্রধান বিচারপতিকে ভয় দেখাতে চেয়েছেন। এটা আদালতের ফৌজদারি অবমাননার সামিল। বরিষ্ঠ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং বলেছেন, এটা শুধুমাত্র প্রধান বিচারপতির ওপর আক্রমণ নয়, সমগ্র বিচার ব্যবস্থার উপরেই হামলা। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে জাতপাতমূলক মন্তব্য করা হয়েছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ আদালতের মধ্যে। আদর্শগত অবস্থান থেকেই এই হামলা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই ধরনের ঘটনায় কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও এই ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, ‘বিচারপতির উপর হামলার চেষ্টা প্রমাণ করে হিন্দু মৌলবাদীরা ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করার জন্য বদ্ধপরিকর।’

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন এই ঘটনার নিন্দা করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনা খাজুরাহোর বিষ্ণু প্রতিমা পুনর্নির্মাণ মামলায় প্রধান বিচারপতির ন্যায়সঙ্গত মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যার পরিণামে হয়েছে। যা কোনওভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। এই হামলার ঘটনা শুধুমাত্র বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার উপরেই আক্রমণ নয়, সংবিধানে নিহিত মর্যাদা এবং অনুশাসনের বিপরীত। পাশাপাশি বিচার ব্যবস্থার উপরে মানুষের বিশ্বাসকেও ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা। হামলাকারী আইনজীবী বার অ্যাসোসিয়েশনের অস্থায়ী সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে এফআইআর করা হয়েছে।

Advertisement

এই প্রসঙ্গে গোদি মিডিয়ারও কড়া সমালোচনা করেছে সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কিছু সংবাদমাধ্যম সংবেদনহীন ও চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশন করার জন্য খাজুরাহো নিয়ে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের বিকৃতি ঘটিয়ে ধর্মীয় আবেগে আঘাতকারী বলে পেশ করে, যা মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি করে। মিডিয়ার এই বিকৃত সংবাদ পরিবেশন এবং সোস্যাল মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত বিভ্রান্তিমূলক ভাষ্য আদালতের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে দুর্বল করেছে। অভিব্যক্তির অধিকারের নামে এইরকম সাংবাদিকতাকে ন্যায়সঙ্গত আখ্যা দেওয়া যায় না। এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতা, যা নৈতিক সংযমের পরিপন্থী, তা ন্যায়ের শাসনকে বিপদে ফেলে এবং আদালতের ভূমিকাকে তামাশায় পরিণত করে।

হিন্দুত্ববাদীদের কাশী-মধুরার মতো অ্যাজেন্ডা, আর বিজেপি সরকারের বুলডোজার নীতি, সবই সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়েছে। এটাই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণ। সেই জন্য পরিকল্পিতভাবে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিস্থিতি এমনভাবে বিষিয়ে দেওয়া হয়েছে যে একজন ৭১ বছরের আইনজীবী সনাতনের নামে এজলাসের মধ্যেই প্রধান বিচারপতির উপর হামলা করার সাহস পান। এটা সঙ্ঘ পরিবারের অসহিষ্ণু মানসিকতারও প্রকাশ, যারা নিজেদের মতাদর্শের বাইরে কোনও মত সহ্য করতে পারে না।

Advertisement