গৌতম মণ্ডল
আমরা যদি দশকভিত্তিক বাংলা কবিতা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব প্রত্যেক দশকে এমন কয়েকজন কবি রয়েছেন, যাঁরা গড় কবি নন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের কবিতার ভাষাও গড় কবির ভাষা নয়। একজন মৌলিক কবির কল্পনাপ্রতিভা ও চিন্তা করার ধরন মৌলিক। স্বতন্ত্র। সেইজন্য একটা দশকে খুব কম করেও অন্ততপক্ষে দশজন মৌলিক কবি থাকলে ওই দশকে ন্যূনতম দশ ধরনের কবিতা রচনা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিক কবিদের ভিতরেও একটা সাধারণ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশকের কবিদের কবিতা। জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তীসহ আরও দু-একজন প্রধান কবি— এঁদের প্রত্যেকের কবিতার ডিকশন আলাদা হলেও এঁদের সবার কবিতার মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। এই যোগসূত্রটি হল বৈদগ্ধ্য। এঁদের প্রায় সবার কবিতার মধ্যে কমবেশি রয়েছে এই বৈদগ্ধ্য। পাশ্চাত্যের আধুনিকতাকে নিজের মতো করে আত্মীকরণ।
Advertisement
অপরদিকে খুব বিরাট মাপের প্রতিভার জন্ম না হলেও চল্লিশের কবিদের একটা বড় অংশের কবিতার মধ্যে সমাজসচেতনতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। যাঁদের মধ্যে এই ছাপ আমরা লক্ষ্য করি, তাঁরা হলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু, গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ। কিন্তু অরুণ ভট্টাচার্য চল্লিশের দশকের একজন কবি হয়েও তাঁর কবিতার মধ্যে যেমন সমাজসচেতনতার ছাপ দেখা যায় না, তেমনি তিরিশের কবিদের মতো আধুনিকতা ও বৈদগ্ধ্যের সমারোহ লক্ষ করা যায় না। তাহলে কী দেখা যায় তাঁর কবিতায়? কেনই-বা তাঁকে সমকালীন কবিদের থেকে স্বতন্ত্র বলতে চাইছি? জন্মের শতবর্ষ পার হওয়ার পরও কি তিনি প্রাসঙ্গিক থাকবেন? থাকলে কীভাবে আমরা তাঁকে গ্রহণ করব?
Advertisement
অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতার ভিতর প্রবেশ করব ঠিকই, তবে তার আগে কবিতা নিয়ে তাঁর যে বিপুল কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে ছিল, তার সঙ্গেও কিছুটা পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করব।
‘আরও কবিতা পড়ুন’। এই আওয়াজ তুলে স্বাধীনতার কিছু পরে কবিতাকে আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে যেসব তরুণ মহানগরের রাজপথ একসময় প্রকম্পিত করতেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন অরুণ ভট্টাচার্য। তাঁর এবং অরুণকুমার সরকারের উদ্যোগে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্যসম্মেলনের পক্ষ থেকে ১৯৫২ সালে জীবনানন্দ দাশকে রবীন্দ্র নামাঙ্কিত পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রকাশ্য মঞ্চে কবিদের পক্ষ থেকে জীবনানন্দ দাশকে সম্ভবত সেটাই প্রথম সম্মাননা জ্ঞাপন। ১৯৫৭-১৯৫৯ সময়সীমায় পরপর তিন বছর মুখ্য সংগঠক হিসেবে তাঁর ব্যবস্থাপনায় কলকাতায় কবিতামেলার আয়োজন করা হয়। কী হত ওই মেলায়? কবিতাপাঠ? শুধুমাত্র বাংলা কবিতা নয়, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষাও, এমনকী শোনা যায়, বিদেশি কবিতার মোটামুটি একটা চালচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হত এই কবিতামেলায়।
কৈশোর থেকেই বাংলার লোকশিল্পসহ সমস্ত ধরনের দেশজ ঐতিহ্যের প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। ১৯৫৪ সালে ‘বঙ্গসংস্কৃতিসম্মেলন’ শীর্ষক একটি বিরাট সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে অরুণ ভট্টাচার্যর সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র লোকশিল্প ও শিল্পীরা বৃহত্তর জগতে পরিচিতি পেয়েছিল, তা নয়, গ্রাম ও নগরের ঐতিহ্যের ভেতর তিনি একটা আদানপ্রদানের আবহাওয়া তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে অরুণ ভট্টাচার্যসহ আরও অনেকের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় আত্মপ্রকাশ করে ‘উত্তরসূরি’ পত্রিকা। সাত বছর পর পঞ্চম সংখ্যা থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অরুণ ভট্টাচার্যর একক সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় উত্তরসূরি পত্রিকার মোট ১১৮টি সংখ্যা। পত্রিকাটি কবিতা-সংগীত-শিল্পচর্চা ও সমালোচনার ত্রৈমাসিক মুখপত্র হলেও ক্রমশ এর ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় কবিতা। জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তর মতো খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট কবিদের কবিতার পাশাপাশি এই পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত পঞ্চাশ ষাট সত্তর এবং আশির দশকের কবিদের ‘তরতাজা’ কবিতা।
বাংলা কবিতা যখন নিজস্ব ঐতিহ্যের জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে পাশ্চাত্যপ্রসূত আধুনিকতার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে তখন তিনি তরুণ তরুণতর কবিদের দিকনির্দেশনা করলেন। উত্তরসূরি পত্রিকার ১০৫তম সংখ্যায় তিনি একটি নিবন্ধে লিখলেন : ‘বন্ধুগণ। এবার আপনারা র্যাঁবো বোদল্যের অথবা এলুয়ার মায়াকোভস্কি থেকে ফিরে আসুন মহাজন পদাবলী রামপ্রসাদের কবিতায়, শ্রীধর কথক, নিধুবাবুর গানে। দেশের মাটির গন্ধ ধরে নিন। ধর্মকে আবার স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করুন। ধর্ম মানে কুসংস্কার নয়, ধর্ম মানে চিত্তের সুস্থির প্রতিবিম্ব, চৈতন্যের উন্মোচন । আসুন, একবার মা বলে তরী ভাসাই।’
যতদূর জানি, খুব ছোট একটা অংশের মধ্যে হলেও, অনুজ কবিদের কাউকে কাউকে অরুণ ভট্টাচার্যর এই দিকনির্দেশনা খুবই প্রভাবিত করেছিল।
এইখান পর্যন্ত এসে মনে হতে পারে, অরুণ ভট্টাচার্য, আমার দৃষ্টিতে, মূলত একজন সম্পাদক ও সংগঠক। অরুণ ভট্টাচার্য, কোনো সন্দেহ নেই, একজন বড় সম্পাদক। সংগঠকও। কিন্তু এটা তাঁর একটা পরিচয় ঠিকই কিন্তু প্রধান পরিচয় নয়।
সম্পাদক ও সংগঠকের পাশাপাশি অরুণ ভট্টাচার্য ছিলেন প্রাবন্ধিক, সংগীতজ্ঞ, চিত্রসমালোচক এবং নন্দনতাত্ত্বিক। কিন্তু এগুলোও তাঁর গৌণ পরিচয়। তাঁর আসল পরিচয়, তিনি একজন কবি। বাংলা ভাষার প্রধান কবি।
একথা ঠিকই, সম্পাদনা ও সংগঠনের সঙ্গে কবিতা রচনার একটা সংঘর্ষের জায়গা রয়েছে। কারণ, একটা উৎকৃষ্ট মানের কবিতা রচনার জন্য একটা নির্জনতা প্রয়োজন। ব্যস্ততা সেই নির্জনতাকে তছনছ করে দেয়। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ভিড়ের ভিতরে থেকেও নির্জন। অরুণ ভট্টাচার্যও, অনেক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, আমার ধারণা, তিনি খানিকটা এই ব্যতিক্রমী ধারার কবি।
অরুণ ভট্টাচার্যর এককভাবে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ন’টি। বিশিষ্ট কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যৌথভাবে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দু’টি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর তেত্রিশ বছর পরে প্রকাশিত কবিতাসংগ্রহ-এ রয়েছে সাতটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা। বাকি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো গেল কোথায়? আসলে বাকি কাব্যগ্রন্থগুলো পাওয়াই যায়নি। অরুণ ভট্টাচার্য অন্যদের কবিতা নিয়ে যতটা মাতামাতি করতেন, নিজের কবিতা সংরক্ষণের ব্যাপারে ছিলেন ততটাই উদাসীন।
অরুণ ভট্টাচার্যর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। ‘সায়াহ্ন’। কবিতাগুলির রচনাকাল : ১৯৪৮-১৯৫১। শুধু প্রথম কাব্যগ্রন্থ নয়, অরুণ ভট্টাচার্যর পরবর্তী প্রত্যেকটা কাব্যগ্রন্থের নামকরণ লক্ষ্য করলে একটা জিনিসে মিল পাওয়া যাবে, সেটা হল প্রত্যেকটা কাব্যগ্রন্থের নাম অত্যন্ত সাদামাটা। আটপৌরে। আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, তিরিশের কবিদের কবিতার মতো তাঁর কবিতায় তথাকথিত আধুনিকতা ও বৈদগ্ধ্যের ছাপ দেখা যায় না। দেখা যায় না নাটকীয়তা ও চমক। অবচেতনের ঘূর্ণি। উল্লম্ফন। আসলে এসব তিনি চানওনি। তাহলে কী চেয়েছিলেন তিনি? তিনি চেয়েছিলেন বিদেশের কোনো তাত্ত্বিক প্রস্থান নয়, ঐতিহ্যের অনুবর্তন। নিরাভরণ ভাষায় শাশ্বতকে স্পর্শ করতে। ‘হাওয়ার স্পর্শ’ শীর্ষক কবিতার শেষ স্তবকে তিনি লিখেছেন : ‘আর কোনো কথা নয়, হাওয়া নয়, গান নয়।/ শুধু চুপ। শিরীষের, পৃথিবীর, শান্তির–/ মানুষের মন শুধু প্রার্থনায় অবিচল, আবেগে অস্থির।’
বোঝাই যায়, কবি কোলাহল নয়, চাইছেন স্তব্ধতা। অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতার আরও একটি বৈশিষ্ট্য, প্রশান্তি। ‘সুবর্ণরেখার তীরে’ শীর্ষক কবিতায় রয়েছে সেই প্রশান্তির স্পর্শ। এই প্রশান্তি সাদামাটা নিরাভরণ ভাষায় লেখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখানেও একটা রহস্যময়তা রয়েছে। কবি লিখেছেন : ‘সুবর্ণরেখাতীরে সমস্ত পৃথিবী যেন বালুকণা হয়ে যায়/প্রণাম জানায়।’
প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার এক বছর বাদে অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় অরুণ ভট্টাচার্যর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। ‘ময়ূরাক্ষী’। ‘ময়ূরাক্ষী’ শিরোনামে একটি কবিতাও আছে এই গ্রন্থে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ময়ূরাক্ষী কি নিছকই একটি নদী? ‘ময়ূরাক্ষী’ শীর্ষক কবিতাটির শুরুর দিকে যে আবহ রচিত হয়েছে তাতে ময়ূরাক্ষীকে নদীই মনে হয়। কিন্তু কবিতা যত এগোয় ততই নদী ও নারী একাকার হয়ে যায়। কবি যখন লেখেন : ‘চৈত্রের আড়ালে/ দূরান্তের রাঙা মেঘ মাটিকে প্রণাম করে–। কিংবা দুপুরের উদাস ছায়াতে / মন্থর বসন্তসন্ধ্যা অনর্থক ঘুরে ঘুরে মরে’ অথবা ‘জানি না জীবনে কেন এ তৃষ্ণার ছলছল ঢেউ সারাদিন মনে জাগে’ তখন ময়ূরাক্ষী শুধু নদী থাকে না, একইসঙ্গে হয়ে যায় নারীও। নারী থাকবে আর যৌনতা থাকবে না তা কি হয়? হয় না বলেই কবি লেখেন ‘ফুলের প্রহার’। লেখেন ‘নদীতে চাঁদের ছায়া’। ‘জল দাও, জল দাও।’
‘মিলিত সংসার’। অরুণ ভট্টাচার্যের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে, কবিতামেলায়। অরুণ ভট্টাচার্যর কাব্যগ্রন্থের নাম সাদামাটা, আগেই বলেছি, কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাভাষায় রচিত একটি কাব্যগ্রন্থের নাম এত সাদামাটা আর আছে কিনা আমার জানা নেই। যদিও ‘মিলিত সংসার’ শীর্ষক কবিতাটি থেকে জানা যায় ‘মিলিত সংসার’ মানে নিছক বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তান মিলে যে সংসার, তা নয়। বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত বস্তু, জীব এবং নিসর্গ হল এই সংসারের সদস্য।
ওস্তাদ আত্তা হোসেন খাঁ-র কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত, কালীপদ পাঠকের কাছে প্রাচীন বাংলা টপ্পা গান এবং শৈলজানন্দ মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিলেন প্রায় দু’দশক ধরে। হয়ত এ কারণে তাঁর কবিতায় কখনো কখনো যেমন লিরিক দেখা যায়, তেমনি পাওয়া যায় সংগীতজগতের কিছু শব্দ। যেমন ‘দরবারি আলাপ’। এই নামে এই গ্রন্থে একটি কবিতা রয়েছে। আমরা জানি, কর্ণাটক সংগীতের একটি উচ্চাঙ্গ রাগ হল দরবারি কানাড়া আর এর আলাপকেই বলে দরবারি আলাপ। দরবারি শব্দটি এসেছে ফার্সি শব্দ দরবার থেকে। এর অর্থ সভা। কবিতাটি অরুণ ভট্টাচার্য উৎসর্গ করেছেন কিংবদন্তি উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী ফৈয়াজ খাঁকে (১৮৮০-১৯৫০)। আসলে ফৈয়াজ খাঁর শিষ্য ওস্তাদ আত্তা হোসেন খাঁর কাছে থেকে অরুণ ভট্টাচার্য উচ্চাঙ্গ সংগীতের পাঠ নিয়েছিলেন।
এবার আমরা দেখব, কবিতাটির উপাদানগুলি কীভাবে আলাপ করছে। কবি লিখেছেন: ‘ঘুম আসবে না জেনো; মধুমালতীর বেড়ায় / সারা রাত্রি গিরগিটি ঘুরবে, দেখব/ হলুদ মেঘের প্রতিচ্ছবি /বাগানের জারুল গাছে।/ একটা কি দুটো বাদুড় উড়বে কয়েক হাত উঁচুতে।’
কবিতাটিতে যে দরবার দেখলাম তা কোনো মানবসন্তানদের নয়, মানবেতর প্রাণি ও উদ্ভিদের। এরা সকলে মিলে তৈরি করছে দরবারি কানাড়ার মতো গভীর আবেগজাত মন্দ্র রাগ।
‘সমর্পিত শৈশবে’। অরুণ ভট্টাচার্যর লেখা চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। যে চারটি পর্বে কবিতাগুলো বিভক্ত। সেগুলো হল : প্রেম নৈঃসঙ্গ ছবি, দরজার ওপারে, যৌবনতরঙ্গ এবং আনন্দিত। এখন একটা প্রশ্ন এসেই যায় কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সমর্পিত শৈশবে’ কেন? কবি কি তাহলে বাস্তবের প্রহার থেকে শুশ্রূষা পেতে শৈশবে ফিরে যেতে চাইছেন? কবিতাগুলো পাঠ করলে কিন্তু সেরকম মনে হয় না। একমাত্র ব্যতিক্রম প্রথম কবিতাটি। ‘সমর্পিত শৈশবে’ শীর্ষক কবিতাটিতে রয়েছে শৈশবের জয়গান। সেখানে ফিরে যাওয়ার আকুতি। কিন্তু এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত আর কোনো কবিতায় এহ ব্যাপারটা লক্ষ করা যায় না। তাহলে কী লক্ষ করা যায়?
চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। খুব স্বাভাবিকভাবেই কাব্যগ্রন্থটিকে ঘিরে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়। কিন্তু প্রচুর কবিতা থাকলেও আগের কাব্যগ্রন্থের মতো এটিও প্রত্যাশা পূরণ করতে ততটা সফল হয়েছে, বলে মনে হয় না।
জীবনানন্দ দাশের একটি কাব্যগ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’-এ (প্রকাশসাল : ১৯৪৮) ‘সপ্তক’ শীর্ষক একটি প্রখ্যাত কবিতা রয়েছে। এই কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিটি এইরকম : ‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে– জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।’ এই আশ্চর্য কবিতাটির নায়িকা সরোজিনীকে মনে রেখে অরুণ ভট্টাচার্য একটি কবিতা লিখেছেন। ‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে’। কী আছে কবিতাটিতে? কবি লিখেছেন, ‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে/ অন্তত হাজার দিন। দিনরাত্রি হাওয়ায় / চুপচাপ ঝরেছে আমলকী।/ ওইখানে সরোজিনী শুয়ে শুয়ে সব/ দেখেছে নক্ষত্র আলো আকাশ বাঙ্ময় / সংসারের লোকজন সমস্ত সকাল / একা একা।
জীবনানন্দ দাশের ‘সপ্তক’ কবিতাটির মতো অরুণ ভট্টাচার্যর লেখা এ কবিতাটির কেন্দ্রে একজন নারী থাকলেও এই কবিতা নিছক নর-নারীর প্রেমের কবিতা নয়। এখানে প্রেমের সঙ্গে মিশেছে নিসর্গ। মিশেছে কিছুটা রহস্যময়ময়তাও।
কবিতাদুটি পাশাপাশি রেখে পড়লে, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, জীবনানন্দের সরোজিনীকে যতটা কাছের মনে হয়, অরুণ ভট্টাচার্যর সরোজিনীকে মনে হয় তার চেয়ে আরও কাছের। মনে হয়, সরোজিনী হয়তো পাশের বাড়িতেই থাকে। সেখানেই শুয়ে আছে অন্তত হাজার দিন।
অরুণ ভট্টাচার্যর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। ‘ঈশ্বরপ্রতিমা’। এই গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজ। আলোচনার শুরুতেই আমাদর জেনে নিতে হবে, কবির কাছে ঈশ্বর ঠিক কী? তাঁর অবস্থানই-বা কোথায়? এই কাব্যগ্রন্থে ‘ঈশ্বরপ্রতিমা’ শীর্ষক একটি কবিতা আছে। কবিতাটি পাঠ করলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, কবির কাছে এককথায় ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তা যেমন গোলাপকাঁটাতে আছে তেমনি বর্ষার ডুমুরে আছে। কামরাঙাতে আছে যেমন তেমনি পাশাপাশি তিতিরের বুকেও আছে। অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টির মধ্যেই তিনি ছড়িয়ে আছেন। আর ঈশ্বরপ্রতিমা? কবির উপলব্ধি-অনুসারে ‘এই দুঃখ এই ভাবনা / এই বনরাজিনীলা / সমস্ত তোমার মন্ত্রে ঈশ্বরপ্রতিমা।’
‘ঈশ্বরের কাছাকাছি’ শীর্ষক একটি কবিতায় আমরা দেখব কবির দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবস্থান অবস্থান নারীর কাছাকাছি। পুরো কবিতাটি পাঠ করার পরে মনে হতে পারে, কবি মনে করছেন, ঈশ্বরের কাছাকাছি যাঁর অবস্থান তিনি নারী নন, নারীদেহ। এ কথা হয়তো ঠিক কিন্তু সম্পূর্ণরূপে ঠিক নয়। তার কারণ, নারী এবং নারীদেহ আলাদা আলাদা কোনো সত্তা নয়।
তবে এই কাব্যগ্রন্থে শুধুমাত্র ঈশ্বরের প্রসঙ্গ আছে, তা একেবারেই নয়। আছে অন্ধকার বাড়ি, তুলসী মঞ্চ, মাধবীর ডাল এবং কাঠবিড়ালির স্তব্ধ জগৎ। আছে সার্কাসের ক্লাউন, অশ্বক্ষুরের শব্দ, উড়নচণ্ডী গাছ, লোমশ ইঁদুর, ঝাঁক ঝাঁক বাদুড়ের বাসা, হরিণশিশু এমনকী ক্রিকেটের বল। এই কাব্যগ্রন্থটি সার্বিকভাবে মোটামুটি একটি ভালো কাব্যগ্রন্থ।
‘সময় অসময়ের কবিতা’। অরুণ ভট্টাচার্য প্রণীত এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে নিজেরই প্রকাশনা উত্তরসূরি থেকে। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর আয়তনে তুলনামূলকভাবে, কিছুটা হলেও, ছোট। আগেও তাঁর কবিতায় সচরাচর অতিরিক্ত কিছু থাকত না, কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থে তিনি বাহুল্যকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেছেন। উপলব্ধির বাইরে তিনি একটা শব্দও লেখেননি। এই কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় আবার এসেছে মৃত্যুচেতনা। ‘বাঁশি বাজলে’ শীর্ষক কবিতায়
কবি লিখেছেন: ‘চারিদিকে শূন্যতার মাঝে/ থেকে থেকে ট্রেনের সুতীক্ষ্ণ স্বর কানে বাজে : / বাঁশি বাজালে চলে যেতে হয়।’
কবিতাটি সম্পূর্ণ পাঠ করার পরে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ হল মৃত্যুচেতনার কবিতা। বাঁশি বাজা তারই ইঙ্গিত। তাতে সাড়া দিয়ে একদিন এই মায়াময় সুন্দর জগৎ ছেড়ে সবাইকে যেতে হবেই। এই-ই নিয়তি।
‘চারিদিকে খেলাঘর’। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থটিই অরুণ ভট্টাচার্যর লেখা শেষ কাব্যগ্রন্থ। সংখ্যার নিরিখে এটি নবম ও কবিতাসংগ্রহ-এ অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থের ক্রমানুসারে এটি সপ্তম কাব্যগ্রন্থ। এখানে এমন একটিও কবিতা নেই যেখানে অনুভূতিপ্রদেশের আলো সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতার জোরের জায়গা এটাই অনুভূতিপ্রদেশের আলো। এই আলো ব্যতিরেকে তাঁর কবিতায় আর তেমন বিশেষ কিছু নেই। চমক নেই, নাটকীয়তা নেই। অবচেতনের ঘূর্ণি নেই। নেই দেশ ও বিদেশের মিথের প্রয়োগ। পোস্টমডার্ন উল্লম্ফন। আসলে তিনি চানওনি তা। এমনকী যতদিন এগিয়েছে তাঁর কবিতায় মানুষ তত কমে এসেছে, তার জায়গায় স্থান নিয়েছে প্রকৃতি। একটি কবিতায় কবি লিখেছেন : ‘সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি একটি কামিনী ফুলের।’
এখন সারা জীবন একটিমাত্র কামিনী ফুল তুলতে চাওয়ার মধ্যে কবি সম্ভবত বলতে চাইছেন, কামিনী ফুলের মতো তিনি নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র, সুগন্ধযুক্ত ও রোগ নিরাময়য়ের কারণ হয়ে উঠতে চান। কিন্তু বাস্তবে তা কি হয়েছে? হয়নি। অথবা হলেও তাকে রক্ষা করা যায়নি। কিন্তু কেন? ‘কামিনী ফুল শুধু ঝরে ঝরে যায়’। অপরপক্ষে ‘দেবতা জানেন’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার দেবতাকে বুকের মধ্যে স্থির/ দেখতে পাচ্ছি’।
এখন একটা প্রশ্ন এসেই যায়, এই দেবতা কে? তিনি কি মহাদেব বা এই জাতীয় কোনো পৌরাণিক চরিত্র? ঈশ্বর? ঈশ্বর হতেই পারেন। কবি সম্ভবত সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু এই দেবতাকে ব্যক্তিগতভাবে আমার আলো ভাবতেই বেশি ভালো লাগে। অনুভূতিপ্রদেশের আলো।
শুধু এই কবিতাটি নয়, সমগ্র কাব্যগ্রন্থের সিংহভাগ কবিতার উৎস হল এই আলো। এই আলো আছে তাই বিভূতিভূষণের গল্প পড়লে ‘এইসব ম্রিয়মাণ বেদনা / টানটান হয়ে বুক জুড়ে থাকে।’
অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতায় পাশ্চাত্যের আধুনিকতার স্পর্শ আছে ঠিকই কিন্তু এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, সেই আধুনিকতার দোষে দুষ্ট নয় তাঁর কবিতা। তাহলে কেমন তাঁর কবিতা?
উত্তরসূরি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে দেশের মাটির গন্ধ বুক ভরে নিতে বললেও, আমার ধারণা, অরুণ ভট্টাচার্য নিজেও এই পথে পুরোপুরি হাঁটেননি। তাঁর কবিতায় কিছুটা দেশের মাটির গন্ধ থাকলেও দেশজ মিথের কোনো চিহ্ন সেভাবে পাওয়া যায় না। তাহলে কী পাওয়া যায়?
এককথায় বলতে বললে বলব, অরুণ ভট্টাচার্যর কবিতার সবচাইতে মৌল উপাদান হল অনুভূতিপ্রদেশের আলো। এই আলোর স্পর্শ নেই এরকম একটিও কবিতা সম্ভবত তিনি সারাজীবনে লেখেননি।
এইরকম উচ্চতার একজন কবি, প্রাবন্ধিক, সংগীতবেত্তা, চিত্রকলা-সমালোচক, নন্দনতাত্ত্বিক, সংগঠক এবং উত্তরসূরির মতো প্রকৃত অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ একটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের জন্মশতবর্ষ পারিবারিক কিছু উদ্যোগ ব্যতিরেকে প্রায় নিঃশব্দে পার হয়ে গেল। বাঙালিজাতির এই অপরিসীম বিস্মরণ প্রতিভাকে নতমস্তকে কুর্নিশ জানাই।
Advertisement



