• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

সন্ত্রাসীদের ধর্ম নেই

পহেলগাম থেকে বেঁচে ফিরেছেন ছত্তিশগড়ের বিজেপি কর্মী অরবিন্দ আগরওয়াল। অরবিন্দ ও তাঁর স্ত্রী পূজা তাঁদের কন্যা সন্তানকে নিয়ে ২১ এপ্রিল ছিলেন বৈসরণে।

ফাইল চিত্র

পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলা আসলে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও হিংসাকে আরও বাড়িয়ে তোলার চক্রান্ত। নাগপুরের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও আইটি সেল ময়দানে নেমে পড়েছে। সন্ত্রাসবাদীরা নয়, তাদের লক্ষ্য এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। তাদের নিশানায় দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী, প্রগতিশীল মানুষ এবং অবশ্যই বামপন্থীরা।

পহেলগাম থেকে বেঁচে ফিরেছেন ছত্তিশগড়ের বিজেপি কর্মী অরবিন্দ আগরওয়াল। অরবিন্দ ও তাঁর স্ত্রী পূজা তাঁদের কন্যা সন্তানকে নিয়ে ২১ এপ্রিল ছিলেন বৈসরণে। গুলির শব্দ শুরু হতেই তাঁদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বলেন তাঁদের গাইড নাজাকত শাহ। অরবিন্দর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন নাজাকত। তারপর ভাঙা ফেন্সিং দিয়ে তাঁদের বাইরে বের করে এনেছেন এই কাশ্মীরি গাইড। পৌঁছে দিয়েছেন শ্রীনগর অবধি। নাজাকতকে জড়িয়ে ধরে ইনস্টাগ্রামে ছবি দিয়েছেন অরবিন্দ, ছবির নিচে লেখ্যা ‘নাজাকত ভাই, তুমি শুধু আমার জীবন বাঁচাওনি, তুমি মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখলে। এ জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।’ আরএসএস-এর শতবর্ষে আমার দেশ, আমাদের দেশ এক বিজেপি কর্মীর এই দু’টি লাইন উপহার হিসেবে পাঠানো যেতে পারে মোহন ভাগবতকে।

Advertisement

অরবিন্দর সঙ্গে ছিলেন তাঁদের বন্ধু কুলদীপ স্থাপক ও তাঁর পরিবার। তাঁদেরও নিরাপদে শ্রীনগরে পৌঁছে দিয়েছিলেন নাজাকত শাহ। শ্রীনগরে পৌঁছে নাজাকত খবর পান তাঁর ভাই আদিল সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে মারা গিয়েছেন। কুলদীপের স্ত্রী ছত্তিশগড়ের চিরমিরের বিজেপি নেত্রী। কুলদীপ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এরপর ধর্ম ও জাতপাত নিয়ে অনেক বিতর্ক হবে। কিন্তু ধর্মের অনেক ওপরে মানবতার স্থান। ধর্মনিরপেক্ষতা বেঁচে আছে বলে দেশ এখনও বেঁচে আছে।

Advertisement

ধর্ম দেখে বেছে বেছে জঙ্গিরা যখন নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে, তখন একই কায়দায় জঙ্গিদের সুরে সুর মিলিয়ে বলছেন, যারা সন্ত্রাসবাদীদের এই দেশের ভেতর মদত দিচ্ছেন তাদের গুলি করে মারা হোক। কেউ বা বলছে, ‘সেকুলাররা’ কোথায়? গোটা দেশজুড়ে এইসব ছড়িয়ে দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে বলা হচ্ছে, ‘এবার ধর্ম দেখেই প্রতিশোধ নেওয়া হবে।’ দেশের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাতিলের জন্য জোর প্রয়াস চলছে।

প্রসঙ্গত কয়েকটি তথ্য উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে। সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল নামে এক ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে মোট সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে ১৭ হাজারের বেশি। মারা গিয়েছেন ৩৬ হাজারের বেশি পাকিস্তানি নাগরিক। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি সরকারি ও সামরিক কর্মী। গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সের ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, সন্ত্রাসবাদী হামলায় আক্রান্ত প্রথম তিনটি দেশ হলো বুর্কিনা ফাসো, পাকিস্তান ও সিরিয়া। নয় নম্বরে আফগানিস্তান। চৌদ্দ নম্বরে রয়েছে ভারত। ফাউন্ডেশন পোর ইনোভেশান পলিটিকুই-এর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী হামলায় ১৯৭৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের ৮৫.৭ শতংশ মাত্র ১৩টি মুসলিম আধিক্য দেশের মানুষ। যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। ভারত নেই। আসলে সন্ত্রাসবাদীদের গুলির নিশানা ধর্ম দিয়ে ঠিক হয় না, রাজনীতি দিয়ে ঠিক হয়।

আরএসএস-বিজেপি তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের স্বার্থে হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদকে অস্বীকার করলেও এদেশের হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ভয়ঙ্কর আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিল। এদের সক্রিয়তা এবং আধিপত্য অত্যাধিক বেড়ে গিয়েছিল ২০১৬ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে। গুজরাতের গোধরায় যেমন অযোধ্যা ফেরত করসেবকদের ট্রেনের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, তেমনই প্রধানত মুসলিম যাত্রী বোঝাই সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যাত্রীদের হত্যা করা হয়েছিল। মালেগাঁওতে যেমন মসজিদে ভিড়ের মধ্যে মোটরসাইকেলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৬ জন মুসলিমকে হত্যা করা হয় এবং জখম হয় শতাধিক। এই সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রধান অভিযুক্ত প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর ছিলেন ‘অভিনব ভারত’ নামে এক কট্টর ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বিস্ফোরণে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি প্রজ্ঞার নামেই নথিভুক্ত ছিল। এমন একটি সন্ত্রাসবাদী হামলা সফল করার পুরস্কার হিসেবে পুলওয়ামা-পরবর্তী ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রজ্ঞাকে প্রার্থী করে দলীয় সাংসদ বানায়। মোদী-শাহরা লোক চিনতে ভুল করেননি। কারণ এই প্রজ্ঞাই নাথুরাম গডসের গুণমুগ্ধ এবং গান্ধি হত্যা তাঁর বিবেচনায় গৌরবের কাজ ছিল। সংঘ পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় অভিনব ভারতের মতো সংগঠনগুলির পরিকল্পনায় দেশজুড়ে তৈরি হয়েছিলর হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদের এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। বিভাজনের জন্য এটা ছিল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র। তদন্তের মাধ্যমে ধরা পড়ে বহু লোক।

আশ্চর্যজনকভাবে মোদী ক্ষমতায় আসার পরে এনআইএ’র তদন্তের চরিত্র বদলে যায় দ্রুত। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লঘু হতে হতে বেশির ভাগ ছাড়া পেয়ে যায়। আরএসএস-বিজেপি চায়নি অভিযুক্তদের সাজা হোক। সাজা হলে প্রমাণ হয়ে যাবে মুসলিম সন্ত্রাসবাদের সমান্তরালে এদেশে হিন্দু সন্ত্রাসবাদও সক্রিয়। সন্ত্রাসবাদ মানবতার চরম শত্রু। সন্ত্রাসবাদের কোনও জাত বা ধর্ম হয় না।

Advertisement