• facebook
  • twitter
Friday, 19 December, 2025

কলকাতা-হাওড়া যমজ শহরের তলার মাটির হাল আশঙ্কাজনক

ধাপাতেও বর্জ্যের পাহাড় জমছে। সেখান থেকে কার্বন মনোক্সাইড ও মিথেনের মতো বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হওয়ার মাত্রাও উদ্বেগজনক।

ফাইল চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে হেলে পড়া বহুতল। হাওড়ার বেলগাছিয়ায় ভাগাড়ের চাপে মাটি ধসে বিপর্যয়। গঙ্গার দুই তীরে দুই যমজ শহরের তলার মাটির হাল নিয়ে চিন্তা বাড়ছে। চিন্তিত ভূবিজ্ঞানীরাও। হাওড়া কাণ্ডের পর কলকাতা পুরসভাও তাদের ভাগাড়-এলাকা নিয়ে বৈঠক করেছে। এখানেও যাতে বেলগাছিয়ার পরিস্থিতি না-হয়, তার জন্য পরিকল্পনা শুরু করেছে। বেলগাছিয়া ভাগাড়ে জঞ্জালের স্তূপ বহু বছর ধরে বাড়তে বাড়তে ভূস্তরে চাপ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, বড় এলাকা জুড়ে ধস নেমেছে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। স্থানীয়দের অনেককে অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে সরানো হয়েছে। ধসের জেরে জলের পাইপও নষ্ট হয়েছে। ফলে জলের সঙ্কট তৈরি হয়েছে হাওড়া শহরের একাংশে। সুতরাং জনবহুল শহরে ধস নামলে কতটা বড় বিপর্যয়ের চেহারা নিতে পারে, তা বেলগাছিয়ার ঘটনায় আরও একবার স্পষ্ট। কিন্তু এই পরিস্থিতি কলকাতার গঙ্গা লাগোয়া এলাকাতেও যে কোনও দিন তৈরি হতে পারে বলে ভূবিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। গঙ্গার

Advertisement

দু’ধারে এখন কোন কোন এলাকা সবচেয়ে বেশি বিপদে, সে কথাও তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন।হাওড়ার বেলগাছিয়া ভাগাড় সংলগ্ন এলাকায় কয়েক দিন আগে যে ধস নেমেছে, তাতে মিথেন গ্যাস বা তার বিস্ফোরণের কোনও ভূমিকার কথা প্রশাসনের তরফে বলা হয়নি। কিন্তু আবর্জনার স্তূপ বা ভাগাড় যেখানেই থাকে, সেখানেই যে মিথেনের স্তর তৈরি হয়, সে বিষয়ে ভূবিজ্ঞানীরা সহমত। বিজ্ঞানীদের মতে, কলকাতার ধাপা সংলগ্ন এলাকাতেও মিথেনের বিরাট ভান্ডার ছিল। যাঁরা ইএম বাইপাস তৈরি হতে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, সে সময়ে পার্ক সার্কাস কানেক্টর ধরে যেতে হলে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে যেতে হত। না হলে মিথেনের চড়া গন্ধ নাকে এসে লাগত। এখনও সায়েন্স সিটির কাছে মিথেনের স্তর রয়েছে। তবে ধাপার ভাগাড় যে হেতু জনবহুল এলাকা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই বিপদ কমে গিয়েছে। ওই ভাগাড় এখন ক্রমশ বিদ্যাধরী এবং বাগজোলা খালের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলেও মাটির নীচে মিথেনের বিস্ফোরক স্তর তৈরি হওয়া সম্ভব। কিন্তু ওই সব এলাকা যে হেতু জনবিরল, তাই বড়সড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা নেই। তবে আতঙ্ক আছে কলকাতার ধাপা নিয়েও। এই অঞ্চলও বহু দিন পূর্বেই তার ধারণক্ষমতা অতিক্রম করে গিয়েছে। অবিলম্বে ময়লা ফেলার বিকল্প জায়গা স্থির না করলে বেলগাছিয়ার বিপর্যয় অনতিবিলম্বে নেমে আসতে পারে। কারণ, উৎস থেকে বর্জ্য পৃথকীকরণ এবং প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতিটি কলকাতায় এখনও পূর্ণমাত্রায় চালু হয়নি।

Advertisement

সুতরাং, ধাপাতেও বর্জ্যের পাহাড় জমছে। সেখান থেকে কার্বন মনোক্সাইড ও মিথেনের মতো বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হওয়ার মাত্রাও উদ্বেগজনক। একাধিক বার এখানে আগুন লাগার খবরও মিলেছিল। উঠেছিল ‘দূষণ বোমা’র প্রসঙ্গও। সতর্কবার্তা উপেক্ষা করার পরিণতি দেখিয়ে দিয়েছে হাওড়া। কলকাতা পুরসভা প্রস্তুত তো? তবে ভূবিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হল কলকাতা এবং হাওড়ার গঙ্গাতীর থেকে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা।

বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্রে কয়েক বছর আগে এই উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছিলেন ভূবিজ্ঞানীরা। দুই শহরেই মাটির তলায় বেশ কিছু ‘প্রাকৃতিক রন্ধ্র’ তৈরি হয়েছে বলে গবেষণাপত্রে তাঁদের দাবি। তাঁদের মতে, বৃষ্টির জল মাটির নীচে নামার সময় উল্লম্ব ভাবে নামে। তাতে ভূস্তরের বিন্যাসের কোনও ক্ষতি হয় না। কিন্তু কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তরে সেই ‘ডায়রেক্ট রিচার্জ’ কম হয়। ফলে কলকাতার মাটির তলার জলস্তর নেমে গিয়ে ভূগর্ভ ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। তার ফলে,আশপাশের অপেক্ষাকৃত আর্দ্র এলাকা থেকে ভূগর্ভস্থ জল কলকাতার ভূগর্ভ নিজের দিকে টানার চেষ্টা করে। সেই জল মাটির তলা দিয়ে কোনাকুনি ভাবে যাতায়াত করে বেশ কিছু ভূগর্ভস্থ চ্যানেল তৈরি করে ফেলেছে। ওই চ্যানেলগুলো এক দিকে বাগজোলা খাল, অন্য দিকে গঙ্গা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। চ্যানেলগুলি দিয়ে পলি বেরিয়ে গিয়ে গঙ্গায় পড়ছে। এই ঘটনা দীর্ঘ দিন ধরে ঘটছে। জোয়ারের সময়ে ওই চ্যানেলগুলি দিয়েই আবার গঙ্গার জল ভিতরে ঢুকছে। রন্ধ্রগুলিকে আরও প্রশস্ত করে মাটিকে ক্রমশ আরও ফাঁপা করে তুলছে। ফলে গঙ্গার পশ্চিমে বালি-উত্তরপাড়া এলাকা এবং পূর্বে দক্ষিণেশ্বর থেকে বরাহনগর, কাশীপুর, শোভাবাজার হয়ে নিমতলা ঘাট পর্যন্ত এলাকা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপন্ন বলে ভূবিজ্ঞানীদের দাবি। নদী তীরবর্তী এলাকায় মাটির নীচে প্রাকৃতিক রন্ধ্র তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু সেই ফোঁপরা মাটিতে বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলেছে নিয়ম ভাঙা নগরায়ন। বিজ্ঞানীদের মতে,কলকাতা-হাওড়ার মাঝখান দিয়ে গঙ্গা সোজাসুজি বয়ে যায়নি। বাঁক বা বাঁকের প্রবণতা দৃশ্যতই রয়েছে। সেই সব বাঁককে ভেঙে দিয়ে অপেক্ষাকৃত সোজা রাস্তা খুঁজে নেওয়া যে কোনও নদীর প্রবণতা। ফলে জোয়ারের সময়ে জলস্তর বাড়লেই বাঁকপ্রবণ এলাকার পারগুলিতে জল একনাগাড়ে ধাক্কা মারতে থাকে। সেই ধাক্কায় পারের মাটির তলায় অনেক দূর পর্যন্ত জল ঢোকে এবং ক্ষয় হয়। তাই নদীর পারে কোনও বড় নির্মাণ থাকা উচিত নয়। কিন্তু বালি-উত্তরপাড়া এলাকায় গঙ্গাপারের গায়েই বড় বড় বহুতল আবাসন উঠেছে। সে সব আবাসন অচিরেই বিপন্ন হতে চলেছে বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। উত্তর কলকাতাতেও গঙ্গাতীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় এই বিপদ ঘনিয়ে উঠেছে। নদী সংলগ্ন অনেক পুরনো নির্মাণ বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে।এই পরিস্থিতির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে কী ভাবে?

ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, জোয়ারের সময়ে গঙ্গার জল মাটির ভিতরে ঢোকা আটকাতে হবে। তার জন্য গার্ডওয়াল তৈরি করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই, হল্যান্ডের কাছে সেই উন্নত প্রযুক্তি আছে। কিন্তু উদ্যোগ কে নেবে? গঙ্গার পার বরাবর মাটির নীচে ২০-২২ মিটার গভীর পর্যন্ত প্রাচীর বা গার্ডওয়াল তৈরি করে জল ঢোকা আটকানো দরকার। কলকাতা এবং হাওড়ার মতো পুরনো শহরে গঙ্গাতীরবর্তী এলাকা অত্যন্ত জনবহুল। এই সব এলাকায় মাটির উপরে যে চাপ তৈরি হয়েছে, ভূগর্ভ ক্রমশ ফোঁপরা হতে থাকলে, সেই চাপ ধরে রাখা সম্ভব নয়।একবিংশ শতকের আধুনিক একটি শহরে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা কেমন হতেই পারে না, অতি সম্প্রতি হাওড়া সেটাই দেখিয়ে দিল। বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, তার কোনও আপৎকালীন সুরাহা সম্ভব নয়। হাওড়া পরিস্থিতিই তার প্রমাণ।

বেলগাছিয়া ভাগাড়ে আবর্জনা ফেলা বন্ধ। বিকল্প ভাগাড়ের বন্দোবস্ত এখনও সম্ভব হয়নি। সুতরাং, শহরে জমে থাকা ১২০০ টনেরও বেশি আবর্জনা পুর প্রশাসনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমনই যে, হাওড়ার আবর্জনা ফেলতে ব্যবহার করা হচ্ছে কলকাতা পুরসভার ধাপাকে। এবং সমস্যা দেখা দিয়েছে আবর্জনা বহনকারী গাড়িগুলি নিয়েও। এত দিন হাওড়ার আবর্জনা ফেলার কাজ করত যে লরি ও ডাম্পারগুলি, তাদের নাকি অর্ধেকের ভগ্নদশা, কাগজপত্রও ঠিক নেই। অগত্যা ডাম্পার, জেসিবি ভাড়া নিয়ে শহরকে আবর্জনামুক্ত করা চলছে। এই জরাজীর্ণ পরিকাঠামো নিয়ে এত বছর ধরে এই বিরাট শহরে বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের কাজটি চলেছে, ভেবে আতঙ্ক জাগে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে— কথাটি বহু ব্যবহারে জীর্ণ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দুই প্রধান শহর কলকাতা এবং হাওড়া প্রশাসনের পরিবেশ ও নাগরিক সুরক্ষা বিষয়ে প্রাথমিক ভাবনাচিন্তার বহর এবং বিপদ-অন্তে হঠাৎ তৎপরতা বৃদ্ধি দেখে অন্য কিছু ভাবা কঠিন। ‌

হাওড়ার বেলগাছিয়া ভাগাড়ে ধস নেমে সম্প্রতি যে বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন হল সমগ্র এলাকা, জলের পাইপলাইন ফেটে তীব্র জলকষ্টের সম্মুখীন হতে হল বাসিন্দাদের— এই সমগ্র পরিস্থিতি সহজে এড়ানো যেত নগর-প্রশাসন যথাসময়ে ব্যবস্থা করলে। অথচ, একাধিক সতর্কবার্তার পরেও নির্বিকার থেকেছে প্রশাসন। বিপর্যয়ের পর সেখানে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আবর্জনার পাহাড় কাটতে বায়োমাইনিং পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্যোগ করা হচ্ছে, বাসিন্দাদের অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে, ভাগাড় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। অথচ, ২০০৩ সালেই কলকাতা হাই কোর্ট এই ভাগাড়কে অন্যত্র সরানোর নির্দেশ দিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ২০০৮ সালে কলকাতা হাই কোর্ট হাওড়া পুরসভাকে নির্দেশ দেয় ভাগাড়ের জমি থেকে যাবতীয় জবরদখল উচ্ছেদ করে এলাকা দূষণমুক্ত করা এবং স্থানীয়দের সুরক্ষা বিধান করার। নির্দেশ ছিল ভাগাড়ের জন্য বিকল্প জমির সন্ধান করারও। অতঃপর রাজ্যে পালাবদল ঘটেছে। সেই সরকারও তিনটি পর্ব অতিক্রম করার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বেলগাছিয়ার সেই ভাগাড় থেকে গিয়েছে তার স্ব-চরিত্রেই। ফলে যে বিপর্যয় সময়ের অপেক্ষা ছিল, সেটিই ঘটেছে।

Advertisement