• facebook
  • twitter
Friday, 19 December, 2025

সোনিয়া-রাহুলকে নিয়ে হঠাৎ মোদী সরকারের এত মাথাব্যথা কেন?

ট্রাম্পের সঙ্গে আপসরফার অর্থ হল, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা। কিন্তু কৌশলগতভাবে তার বিরোধিতা করার পথ নেই।

ফাইল চিত্র

পুলক মিত্র

ন্যাশনাল হেরাল্ড আর্থিক তছরুপ মামলায় সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে চার্জশিট পেশ করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। এই প্রথম কোনও মামলায় দু’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা পড়ল। দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতে জমা দেওয়া ওই চার্জশিটে নাম রয়েছে কংগ্রেস নেতা স্যাম পিত্রোদারও। অন্যদিকে, হরিয়ানায় জমি কেলেঙ্কারি মামলায় সোনিয়ার জামাই রবার্ট ভডরাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট।

Advertisement

ন্যাশনাল হেরাল্ড বৃত্তান্ত
১৯৩৮-এর ৯ সেপ্টেম্বর লক্ষ্ণৌতে জহরলাল নেহেরুর বিশেষ উদ্যোগে “ন্যাশনাল হেরাল্ড” সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, কংগ্রেসের বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তবে নেহেরু নিজে কখনও পত্রিকাটির মালিক ছিলেন না। কংগ্রেস সদস্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের টাকায় কাগজটি চালু করা হয়েছিল। পত্রিকাটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিল অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেড (এজেএল) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা।

Advertisement

১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত ন্যাশনাল হেরাল্ড তীব্র ব্রিটিশ বিরোধিতার পথ বেছে নেয়, যার জেরে সংবাদপত্রটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ইংরেজি “ন্যাশনাল হেরাল্ড”-এর হিন্দি সংস্করণ ছিল, “নবজীবন” এবং ঊর্দু সংস্করণের নাম ছিল “কওমি আওয়াজ”। রাজরোষে তিন বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৪৫ থেকে পত্রিকাটি আবার বেরোতে শুরু করে। ১৯৪৬-৫০ পর্যন্ত এই পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন ফিরোজ গান্ধী এবং ১৯৪৬-৭৮ এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মানিকুন্ডা চালাপতি রাজু। স্বাধীন ভারতে ন্যাশনাল হেরাল্ড বিভিন্ন সরকারি আনুকূল্য পেলেও, এর কোনও আধুনিকীকরণ হয়নি। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয় পত্রিকাটি। অবশেষে ২০০৮ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

কীভাবে জড়ালেন সোনিয়া-রাহুল?
২০১০ সালে কর্পোরেট মিডিয়া একের পর এক কংগ্রেস-বিরোধী খবর করতে থাকে। তখন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেদের মুখপত্র প্রকাশের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। ৯০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে “ন্যাশনাল হেরাল্ড”কে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় এর মালিকানা নিয়ে। যেহেতু এজেএল-এর শেয়ার হোল্ডাররা সবাই মৃত এবং তাঁদের বেশিরভাগই কংগ্রেস পরিবারের সদস্য, তাই অধিকাংশ শেয়ার বিনামূল্যে কংগ্রেসকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি সংস্থা এজেএল কিনে নেয়, যার ৭৬ শতাংশের মালিক হলেন সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধী। বাকি ২৪ শতাংশের মালিক হলেন মতিলাল ভোরা এবং অস্কার ফার্নান্ডেজ। মতিলাল ভোরা ২০০২ সাল থেকেই ন্যাশনাল হেরাল্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। ২০১১ সালে ইয়ং ইন্ডিয়ার কাছে বিক্রির সময় এজেএল-এর শেয়ারহোল্ডার ছিলেন ১০৫১ জন। এঁরা প্রত্যেকেই কংগ্রেসের লোক।

বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগকে ঘিরে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার যখন বেকায়দায়, তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেন সুব্রহ্মমণিয়াম স্বামী।

তাঁর অভিযোগ ছিল,
(১) রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস হয়ে কোনও সংস্থাকে ৯০ কোটি টাকা ধার দিতে পারে না
(২) এজেএল-এর মোট ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। ইয়ং ইন্ডিয়া ওই সংস্থাটি কেনার ফলে তারাই মালিক হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ এখানে অর্থ নয়ছয় হয়েছে এবং তার সঙ্গে সোনিয়া ও রাহুল জড়িত।

কী বলছেন রাহুল – সোনিয়া
(১) “ন্যাশনাল হেরাল্ড “-এর কোনও সম্পত্তিই বিক্রি করা হচ্ছে না। যদি বিক্রি করা হত, তাহলে “লাভ”-এর প্রশ্ন আসত। “ন্যাশনাল হেরাল্ড”-এর সম্পত্তি ন্যাশনাল হেরাল্ডরই থাকছে। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করা হচ্ছে না।
(২) এজেএল যদি তার সব শেয়ার ইয়ং ইন্ডিয়াকে বেচতে আগ্রহী হয় এবং বোর্ড অফ ডিরেক্টরস যদি সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ে অন্যদের কী বলার থাকতে পারে ?
(৩) রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস নিজেদের মুখপত্র চালাতে বিনিয়োগ করতেই পারে। এটি স্বল্পকালীন ঋণ এবং অবিলম্বে তা মিটিয়ে দেওয়া হবে।

এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-কে সামনে রেখে গান্ধী পরিবারের ওপর এখন আবার দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। অর্থ তছরুপের তদন্ত করতে ২০১৪ সালের অগাস্ট মাসে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে নিযুক্ত করা হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির মধ্যে “অপরাধমূলক উদ্দেশ্য” খুঁজে পায় দিল্লি আদালত। সোনিয়া -রাহুলকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট দুজনকেই হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়।

প্রশ্ন হল, ২০০৮ সালের একটি পুরনো মামলা নিয়ে হঠাৎ এখন কেন ইডি-র এই তৎপরতা? আমরা আবার শুনতে পাচ্ছি, বহু ব্যবহারে জীর্ণ সেই কথাগুলি – আইন তার নিজের পথেই চলবে।

তথাপি সেই প্রশ্নটি বারবার ঘুরেফিরে আসছে, আবার এখন কেন? এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে,সরকার-বিরোধী যে কোনও কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে রাখার জন্য বিগত ১০ বছর ধরে ইডি-কে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে মোদী সরকার। গত লোকসভা নির্বাচনে বড়সড় ধাক্কা খাওয়ার পর আবার স্ব-মহিমায় দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। এই অস্থির বিশ্বে তিনি নিজেকে সবচেয়ে সম্ভ্রম সৃষ্টিকারী, সম্মানিত নেতা হিসেবে তুলে ধরতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি নাগপুরে আরএসএসের সদর কার্যালয় ঘুরে এসেছেন। আরএসএসে একাংশ, যাঁরা মোদির সমালোচক হিসেবে পরিচিত, তাঁরাও আপাতত নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। এই মুহূর্তে আঞ্চলিক বা জাতীয় স্তরে অ-বিজেপি দলগুলির মধ্যে এমন কোনও নেতা নেই, যিনি মোদির জনপ্রিয়তার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন।

আর গান্ধী পরিবার? শারীরিক অসুস্থতার কারণে সোনিয়া গান্ধী এখন রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় নন। অ-বিজেপি দলগুলি সোনিয়ার নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও, তাঁর তেমন জনভিত্তি নেই, আগেও ছিল না। মোদির ঘনিষ্ঠ বৃত্তের নেতারা রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেন না।

দশ বছর আগে মোদী যতটা অপ্রতিরোধ্য ছিলেন ছিলেন, তখন তাঁর পক্ষে যে কোনও মূল্যে গান্ধীদের গারদে ঢোকানো অসম্ভব ছিল না। সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। যে ‘নৈতিকতা’র স্লোগান তুলে মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন, এখন তাতে কলঙ্কের দাগ লেগেছে। এই মোদির আমলেই এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ফুলেফেঁপে উঠেছেন। সুশাসন বা পরিচ্ছন্ন রাজনীতির নিদর্শন তুলে ধরতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। জনজীবনে বেড়েছে অনৈতিকতা।

রাজনীতির চতুর কারবারী হিসেবে মোদির অনুগতরা এমন ‘শত্রু’কে চান, যাঁদের অতীতকে তুলে ধরে নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচার করা যায়। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার ১০ বছর পর আবার গান্ধীদের দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মোদী।

মনে পড়ে, গালওয়ানে ভারত সীমান্তে চিনা সৈন্যদের ঢুকে পড়ার কথা? এখন আমরা সেই চিন সম্পর্কে অত্যন্ত যত্নশীল। চিন আঘাত পেতে পারে, এমন কোনও কাজ করতে চায় না মোদী সরকার। ওয়াকফ বিল পাশ হয়ে গিয়েছে।

কোনওরকম প্ররোচনা বা উস্কানিতে পা দেয়নি মুসলিম সমাজ। দেশের আর্থিক অবস্থাও তেমন সুবিধাজনক নয়। সবচেয়ে বড় পরিহাস হল, দেশের মধ্যে শত্রু কে, তা সহজে খুঁজে বার করতে পারলেও, সবচেয়ে বড় শত্রু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম প্রকাশ্যে বলার মতো সাহস ৫৬ ইঞ্চির ছাতির নেই।

এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর অনুগত ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসমর্পণের পটভূমি তৈরি করা হচ্ছে। ট্রাম্প যে পথে হাঁটছেন, তা আমাদের দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিতে পারে। আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে রফা করতে মোদী সরকারের মন্ত্রীরা ঘন ঘন আমেরিকা ছুটে যাচ্ছেন। সস্ত্রীক ভারত সফর করে গিয়েছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও।

ট্রাম্পের সঙ্গে আপসরফার অর্থ হল, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা। কিন্তু কৌশলগতভাবে তার বিরোধিতা করার পথ নেই। ট্রাম্প জমানায় আগামী দিনগুলিও ভারতের পক্ষে খুব একটা স্বস্তিদায়ক হবে না, যা আঁচ করতে পারছে কেন্দ্রের শাসকদল। তাই নজর ঘোরাতে গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে ইডি-র এই তৎপরতা।

Advertisement