• facebook
  • twitter
Monday, 15 December, 2025

ভবঘুরে দুই লাফারু মাকড়সা

আমাদের সারা ভারতে প্রায় ১৫০০ রকম প্রজাতির মাকড়সা পাওয়া যায়। তবে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২৫০ রকম প্রজাতির মাকড়সার দেখা পাওয়া গিয়েছে।

ফাইল চিত্র

তাপস কুমার দত্ত

পোকামাকড় কথাটির মধ্যে দুই রকমের অর্থ লুকিয়ে আছে। পোকা বলতে আমরা সবাই বিভিন্ন ধরনের কীট–পতঙ্গকেই বুঝে থাকি এবং মাকড় বলতে আমরা বিভিন্ন ধরনের মাকড়সাকেই বুঝে থাকি। বিভিন্ন কীট–পতঙ্গের সঙ্গে মাকড়সার অনেক কিছুতেই ফারাক আছে। এই মাকড় কথাটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার মর্কট শব্দ থেকে। আমরা আমাদের পরিবেশে যে সমস্ত কীট–পতঙ্গ দেখি তাদের তিন জোড়া পা, শুঁড়, দুই জোড়া পাখনা ও পুঞ্জাক্ষী থাকে। বিভিন্ন কীট–পতঙ্গের ক্ষেত্রে এগুলি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আবার আমরা যখন মাকড়সাকে দেখি তখন দেখতে পাই চারজোড়া পা, চারজোড়া সরলাক্ষি এবং এদের কোনো শুঁড় থাকে না। মাকড়সার মাথা ও বুক মিলে হয় শিরোবক্ষ এবং এদের বাকি অংশটি হলো পেট।

Advertisement

আমাদের সারা ভারতে প্রায় ১৫০০ রকম প্রজাতির মাকড়সা পাওয়া যায়। তবে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২৫০ রকম প্রজাতির মাকড়সার দেখা পাওয়া গিয়েছে। কিছু মাকড়সা আছে জাল বুনে তাতে তাদের শিকারকে ধরে সেটা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। আবার কিছু মাকড়সা আছে যারা ঘুরে বেড়িয়ে শিকার করে থাকে। এইরকম মাকড়সাকে আমরা ভবঘুরে মাকড়সা বা এক জায়গা থেকে আর জায়গাতে লাফিয়ে চলে বলে এদেরকে অনেকে আবার লাফারু মাকড়সা বলে।

Advertisement

আমার দেখা এই রকমই দুই ভবঘুরে মাকড়সার কথা না বলে থাকতে পারছি না। প্রথম মাকড়সার নাম হলো ভবঘুরে লাল পেঁড়ে লাফাড়ু মাকড়সা এবং দ্বিতীয়টি হলো বাঘা লাফাড়ু মাকড়সা। এই দুই মাকড়সা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে বলে অনেকে এদের আবার জাম্পিং স্পাইডার বা বাংলা ভাষাতে লাফারু মাকড়সা বলে থাকেন। আমার দেখা দুই ধরনের ভবঘুরে বা লাফাড়ু মাকড়সার সম্বন্ধে কিছু বলার চেষ্টা করলাম।

লাল পেঁড়ে লাফারু মাকড়সার ইংরাজি নাম হলো Two Striped Telamonia এবং বৈজ্ঞানিক নাম হলো Telamonia dimidiate. এরা এক ধরনের যে ভবঘুরে মাকড়সা সেটা আগেই বলেছি এবং শিকার ধরার জন্য এরা কোনোরকম জাল বোনে না। জঙ্গলে, বাগানে গাছের পাতার উপর এদের ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। লাফাড়ু কথা থেকেই বোঝা যায় যে এরা লাফিয়ে চলতে পারে এবং লাফ দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। এরা খুব দ্রুত চলাফেরা করতে পারে এবং স্বভাবে যথেষ্ট চালাক হয়ে থাকে। এদের স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। স্ত্রী মাকড়সাটি হালকা সাদা রঙের ও মাথাটি চৌকো আকারের উঁচু হালকা হলুদ রঙের হয়ে থাকে। মাথার উপরের সামনের অংশের চৌকো জায়গাতে লাল রঙের ছোপ থাকে। এদের পেট লম্বা মাকুর মতো হয় এবং পেটের সাদা অংশটিতে এক জোড়া লাল রঙের লম্বা দাগ থাকে। পায়ের রঙও স্বচ্ছ হয়, মনে হয় যেন রসে ভরা আছে। শরীরের বিভিন্ন অংশে লোম থাকে। পুরুষ মাকড়সা সম্পূর্ণ অন্যরকমের হয়ে থাকে। এদের দেখে মনে হবে যেন অন্য প্রজাতির কোনো মাকড়সা। মাথা ও পেট একই রকমের হলেও পুরুষের রঙ গাঢ় খয়েরি রঙের হয়। মাথার উপর সামনের অংশে একটা গোল চিহ্ন থাকে। পুরুষ মাকড়সার পাগুলো সব কালো রঙের হয়। মাথার পিছনের দিকে দুই পাশে সাদা রঙের এক জোড়া দাগ থাকে। এদের পেটের মাঝখান দিয়ে একটা লম্বা সাদা দাগ উপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। স্ত্রী মাকড়সার দৈর্ঘ্য, পা সহ ১৫-১৮ মিমি এবং পুরুষ মাকড়সার পা সহ ১৪–১৭ মিমি হয়ে থাকে। এরা বনে-জঙ্গলে ঘুরে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, এমনকি অন্য মাকড়সাকেও খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে।

বাঘা লাফাড়ু মাকড়সার ইংরাজি নাম হলো Heavy Bodied jumper ও বৈজ্ঞানিক নাম হলো Hyllus bengalensis আবার এই প্রজাতি Phidippus bengalensis নামেও পরিচিত। বাঘ যেমন ধীর স্থিরভাবে চলাফেরা করে, ঠিক সেইরকমভাবেই এরা চলাফেরা করে অর্থাৎ বাঘের আচার আচরণের সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে বলে এদের এরকম নামে ডাকা হয়ে থাকে। এদের দেহের আকারের তুলনায় বড় বড় শিকার ধরতে এরা খুবই পটু হয়। মাকড়সাটি খানিকটা হলুদ রঙের এবং আকারে বেশ মোটাসোটা হয়। এদের পা ছোটোখাটো হলেও বেশ মোটা হয়ে থাকে। এদের মাথা, পেট ও পায়ের অংশে অজস্র লোম ও কাঁটায় ভরা থাকে। পিঠের মাঝামাঝি জায়গায় এক জোড়া ছোটো ত্রিভুজাকৃতি কালো দাগ থাকে। এদের মাথা পেটের তুলনায় অনেকটাই ছোটো আকারের হয়। পেটটি পিছনের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে গিয়েছে। এরাও কোনো জাল বুনে শিকার ধরে না। বাগানের ঝোপেঝাড়ে, লতানো গাছের পাতার মধ্যে থেকে এরা দিনের বেলায় শিকার ধরে। শিকার ধরাতে এই মাকড়সা দারুণ পটু হয়ে থাকে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো স্ত্রী মাকড়সা পুরুষ মাকড়সার তুলনায় অনেকটাই বড় হয়। স্ত্রী মাকড়সা পা সহ ১৫–১৬ মিমি এবং পুরুষ মাকড়সা ১৪–১৫ মিমি হয়ে থাকে।

তবে যেভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে হয়তো আগামী দিনে অনেক ধরনের প্রজাতিকে আমাদের চোখের সামনে বিলুপ্ত হতে দেখা যাবে। পরিবেশ আরো সুন্দর হোক এবং তার সঙ্গে এদের সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরো বেড়ে চলুক। জানার কোনো শেষ নেই, তাই অনুসন্ধান চালিয়ে যেতেই হবে।

Advertisement