• facebook
  • twitter
Saturday, 20 December, 2025

কাপুরুষতার লক্ষণ

চাপের মুখে অভিনেতা মোহনলাল এখন বলছেন, ‘তিনি চান তাঁর অভিনীত কোনও ছবি যাতে মানুষের ভাবাবেগকে আঘাত না করে। ছবিটিতে কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য রয়েছে।

প্রতীকী চিত্র

মালয়ালাম চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা মোহনলাল অভিনীত ‘এল ২ এমপুরান’ ছবিটি মুক্তি পেতেই হিন্দুত্ববাদীদের রোষের কবলে পড়েছে। কেননা, বহু প্রতীক্ষিত ওই ছবিটি গুজরাত গণহত্যার প্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছিল। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চাপে ওই ছবিটির ১৭টি দৃশ্য বাদ দেওয়া হচ্ছে। প্রযোজক গোকুলাম গোপালন সরাসরি স্বীকার না করলেও চাপে পড়েই যে দৃশ্য ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা তাঁর ভাষাতেই স্পষ্ট। তাঁর কথায়, ‘একাংশের মানুষের ভাবাবেগে যাতে আঘাত না লাগে সেজন্যই কাটছাঁট করা হয়েছে বেশ কয়েকটি দৃশ্য। এমনকি বাবা বজরঙ্গির চরিত্রের নামও বদলে দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। কিছু কিছু সংলাপের সময় বন্ধ রাখা হচ্ছে শব্দক্ষেপণ। অথচ সিনেমাটি অনুমোদন দিয়েছিল সেন্সর বোর্ড। ছবিটি মুক্তচিন্তার চলচ্চিত্রপ্রেমীদেরও মন জয় করে নিয়েছিল। এখন ছবিটির নতুন সংস্করণ মুক্তির কাজকর্ম চলছে।

চাপের মুখে অভিনেতা মোহনলাল এখন বলছেন, ‘তিনি চান তাঁর অভিনীত কোনও ছবি যাতে মানুষের ভাবাবেগকে আঘাত না করে। ছবিটিতে কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য রয়েছে। একজন শিল্পী হিসাবে কোনও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, মতাদর্শের উপর আঘাত কিংবা বিদ্বেষ ছড়াক এমন কোনও ছবিতে তিনি অভিনয় করতে চান না। এ কারণেই ব্যক্তি হিসাবে তিনি এবং এমপুরাণের গোটা ইউনিট বিতর্ক এড়াতে সচেষ্ট হয়েছে।’

Advertisement

গুজরাতের গণহত্যার প্রসঙ্গ থাকায় ইহচই করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি-সঙ্ঘ মদতপুষ্ট সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন বাহিনী। নানা নামে সমাজমাধ্যমে ধারাবাহিক প্ররোচনামূলক পোস্ট এবং হুমকি চলতেই থাকে। দাবি করা হয়,‘‘মোহনলাল অভিনীত সর্বশেষ ‘এল ২ এমপুরান’ ছবিটিতে প্রকাশ্যে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নিন্দামূলক প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। ছবিটিতে হিন্দুদের খলনায়ক হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে।’ হিন্দু সেবা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা তথা সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব প্রতীশ বিশ্বনাথ প্রকাশ্যে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিরুদ্ধে গোপন উদ্দেশ্য থাকার অভিযোগও এনেছে। ভারতীয় জনতা যুব মের্চার কেরল রাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক কে গণেশ জানিয়েছেন, পরিচালক, অভিনেতা-চিত্রনির্মাতা পৃথ্বীরাজ সুকুমারনের বিদেশি যোগটা খতিয়ে দেখা দরকার। এই সিনেমাটিতে দেশবিরোধী কিছু রয়েছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর এই ছবিটি সম্পর্কে প্রথমে আগ্রহ দেখালেও এখন দলের চাপে উলটো সুর গাইতে শুরু করেছেন। এখন বলছেন, ‘কিন্তু এখন দেখছি যে, এই ছবির নির্মাতারা ১৭টি দৃশ্য ছেঁটে ফেলেছেন। আবার ছবিটি সেন্সরশিপে যাবে। বুঝতে পেরেছি যে, ছবিতে এমন বিষয় ছিল যা মোহনলালের অনুগামী ও অন্যান্যদের কিছুটা অশান্তিতে ফেলে দেবে। যে সিনেমা সত্যকে বিকৃত করে সেটা ব্যর্থ হয়। আমি একেবারে হতাশ এই ধরনের সিনেমা তৈরি নিয়ে।’

Advertisement

এসবের মধ্যেও ‘এল ২ এমপুরান’-কে ঘিরে উৎসাহ ক্রমশ বাড়ছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই সাধারণ মানুষ ছবিটি দেখছিলেন। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ছবিটি দেখেছিলেন। তিনি এবং কেরল বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ভি ডি সতীশন দৃঢ়ভাবে ছবিটির নির্মাতাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিজয়নের প্রতিক্রিয়া হল, ‘এই ছবিটিতে দেশের সবচেয়ে নৃশংসতম গণহত্যার উল্লেখ থাকায় সঙ্ঘ পরিবার এবং এর পরিকল্পনাকারীদের ক্ষুব্ধ করেছে। কেবল গেরুয়া বাহিনীর অন্য সংগঠনই নয়, এমনকি বিজেপি এবং আরএসএস নেতারাও জনসমক্ষে হুমকি দিচ্ছেন। চাপ দিয়ে প্রযোজকদের ছবিটি পুনরায় সেন্সর এবং সম্পাদনা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সঙ্ঘ পরিবার তৈরি করা এই ভয়ের পরিবেশ নিন্দনীয়। সাম্প্রদায়িক উপাদানের মাধ্যমে শিল্পকর্ম ধ্বংস করা এবং শিল্পীদের উপর নিষ্ঠুর হামলা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভলক্ষণ নয়। ছবিটি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং এর ভয়াবহতা তুলে ধরেছে বলেই ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে।’

গণতান্ত্রিক সমাজে নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে। শিল্পকর্ম এবং শিল্পীদের ধ্বংস এবং নিষিদ্ধ করার সহিংস আহ্বান ফ্যাসিবাদী মনোভাবের সর্বশেষ প্রকাশ। এগুলি গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ। সঙ্ঘ পরিবারের কাপুরুষতার লক্ষণ এখানে স্পষ্ট। সিনেমা হল একদল শিল্পীর প্রচেষ্টার ফল। স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে হুমকি এবং অপমান করে কোনও শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করা কোনও অর্জন নয়। এটি কাপুরুষতার লক্ষণ। এইসব ঘটনা যতই ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, ঐতিহাসিক সত্য কখনও মুছে ফেলা যায় না।

Advertisement