শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
Advertisement
তুলনা করুন, ‘টালত-মোর ঘর নাহি পড়বেশী’ (চর্যাগান)। এখন শব্দটি পাওয়া ‘টাল-মাটাল’ (বসতি ও মাঠ) শব্দে।
পুরুষ পরম্পরাগত বাসভূমিকে বলে ‘ভিটা’ (ভিটে। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত * ‘অধি+স্থা’ থেকে।
এখন রান্না খাবারের কথা।
Advertisement
রান্না করা (এবং গরম করা) অর্থে সংস্কৃতে ছিল ‘পচ্’ ধাতু। এ ধাতু মধ্যভারতীয় ভাষাতে লুপ্ত হয়ে এসেছিল। এই ধাতু থেকে উৎপন্ন একটি মাত্র তদ্ভব শব্দ বাংলায় প্রচলিত আছে। সে হল ‘পোয়ান’ (মানে শরীর তাতানো, যেমন রোদ পোয়ানো, আগুন পোয়ানো) মধ্য বাংলা ‘পনী’ও (মানে কুম্ভকারের অগ্নিকুন্ড) সংস্কৃত ‘পচন’! (* পচনিকা) থেকে এসেছে। আরও একটি শব্দ প্রচলিত আছে সাধু ভাষায়— ‘পাক’ মানে রান্না)। সংস্কৃতে একটি ধাতু ছিল রন্ধ (যেমন রন্ধয়তি)। এর আসল মানে ছিল পীড়ন করা, দমন করা, কষ্ট দেওয়া। মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষায় এই ধাতুটি পুরোনো ‘পচ্’ ধাতু অর্থে, অর্থাৎ রান্না করা বোঝাতে, ব্যবহৃত হতে থাকে। সেই সূত্রে আমরা সংস্কৃত ‘রন্ধন’ থেকে পেয়েছি রান্না শব্দ (সংস্কৃত * রন্ধনক থেকে) ও রাঁধ্ ধাতু। যে ভালো রান্না করে সে ‘রাঁধুনি’।
রাজা রাজড়ায় রান্নাঘর বোঝাতে সংস্কৃতে একদা চলিত হয়েছিল ‘রসবতীশালা’ শব্দ। মানে ছিল রসাল খাদ্যের প্রস্তুতির কক্ষ। কথাটি বাংলায় চলে এসেছে ‘রসুইশাল’ ‘রসুইঘর, হয়ে, আর ‘রসবতী’ শব্দটি স্বতন্ত্র হয়ে মানে হয়েছে ‘ফলাও রান্না কাজ’। যেমন ‘রসুই সেষ হতে দেরি কত?’ এখন বাংলা ভাষায় পেশাদার দক্ষ রাঁধুনিকে বলে ‘রসুইকর’। এর সমার্থক শব্দ ‘হালুইকর’ (আসল মানে, মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী) এসেছে হিন্দী থেকে।
সেকালে সংসারের ব্যবহার্য বস্তু সাধারণত থাকত মাটির ছোট বড়ো ভাঁড়ে। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ভান্ড’ থেকে। ভাঁড়ে মুখ থাকে। মুখ না থাকলে বলত ‘কুন্ড’ বা ‘কুন্ডিকা’ (যার থেকে বাংলায় হাঁড়িকুঁড়িতে ‘কুড়ি’ এসেছে) কুঁড়ি হল মালসার প্রতিশব্দ। ‘মালসা’ এসেছে সম্ভবত হিন্দী থেকে। প্রাকৃত ‘মল্ল’ বংলা ‘মালা’ (মানে নারকেলের খোল-পাত্র) শব্দের সঙ্গে সংযোগ আছে। ‘ভান্ড’ শব্দটি সংস্কৃতে সংসারের সঞ্চিত দ্রব্য এবং ধনী ব্যক্তির অস্থাবর সম্পত্তি বোঝাত। রাজার ধনাগার, গৃহস্থের রসদের ঘর বোঝাত ‘ভান্ডাগার’ শব্দ। এর থেকে এসেছে ‘ভাঁড়ার’, ‘ভাঁড়ার ঘর’। এ ঘরের যে তদবির করে সে ভাঁড়ারি (সংস্কৃত ভান্ডাগারিক)। এখন ভাঁড়ার শব্দ প্রায়ই বোঝায় সংসারের প্রয়োজনীয় দ্রব্য।
অক্ষুণ্ণ যোগসূত্র পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় যে বাংলা ‘হাঁড়ি’ এসেছে সংস্কৃত ‘ভান্ড’ + ইক/ইকা থেকে। হাঁড়ি আর ভাঁড়ের মধ্যে একটা বিশেষ পার্থক্য আছে। হাঁড়ি সাধারণত রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয় আর ভাঁড় গৃহস্থের কাজে কখনোই রান্নার কাজে চলে না। হাঁড়ি বড়ো ভাঁড় ছোটো। হাঁড়িতে শুদ্ধ সিদ্ধ করার কাজই চলে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এরকম হাঁড়িকে ব্যবহৃত হতে দেখেছি যাতে ডাল ঝোল প্রভৃতি তৈলপক্ব রান্না হত। মধ্য বাংলায় এমন হাঁড়ির নাম পেয়েছি ‘তেলানি’। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘*তৈলপাচনিক’ (অর্থাৎ তেল-রান্না) থেকে। পশ্চিমবঙ্গে এখন বলে ‘তোলা (তেলো থেকে) হাঁড়ি’।
(ক্রমশ)
Advertisement



