• facebook
  • twitter
Sunday, 7 December, 2025

বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের ঢেউ এসে লাগছে কলকাতা বইমেলায়

১৯৯৬ সাল থেকেই কলকাতা বইমেলার অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। মাঝখানে এতগুলি বছরে বইমেলা জায়গা পাল্টেছে, স্টল বেড়েছে অনেক, প্রযুক্তিগত ও অন্যান্য আধুনিক প্রকরণ আত্মস্থ করে সে চরিত্রে হয়ে উঠেছে আরও আন্তর্জাতিক। এই আন্তর্জাতিকতার মধ্যে একটা চিরচেনা আন্তরিকতার স্পর্শ বয়ে আনত বাংলাদেশের বই, কলকাতা বলেই আরও— একই মাতৃভাষায় কথা বলা অথচ রাজনীতির ফেরে আলাদা ভূখণ্ডের বাঙালি যে আজও কেমন উদ্বেল পড়শি দেশের সাহিত্য, মননচর্চা ও এই সবেরই ধারক-বাহক বই নিয়ে, বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে প্রতি বছর পাঠকের ঢল ছিল তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।

ফাইল চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

ভারতের পক্ষে বাস্তবিক এ এক ভয়াবহ উদ্বেগের সময়। সেই জুলাই মাস থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন ও শেখ হাসিনা-বিরোধী অভ্যুত্থান ভারতবিরোধিতার চড়া সুরে বাঁধা। পালাবদলের অব্যবহিত পর সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন প্রবল আকার ধারণ করল সে দেশে, মফস্সল শহরে গ্রামে, এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও। ন্যক্কারজনক রবীন্দ্রবিরোধিতার মোড়কে হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার চলেছে, নানা স্থানে হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙা হয়েছে। চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের উপর নেমে এসেছে অমানুষিক অত্যাচার। আওয়ামী লীগের সমর্থক কিংবা ভারতের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী, এই সব কারণ দেখিয়ে যৎপরোনাস্তি নাকাল করা হচ্ছে সাধারণ সংখ্যালঘুকে। তবে সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে স্তম্ভিত করে নতুন অন্তর্বর্তী-কালীন সরকারের মনোভাব। আদৌ যে তাঁরা এই বিদ্বেষের প্রচ্ছন্ন সমর্থক নন, তাঁদের আচরণ সেটুকুও প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। বাস্তবিক, আন্দোলন চলাকালীনই বিরোধী নেতৃত্বের সংখ্যালঘু বিদ্বেষ নানা ভাবে সামনে চলে এসেছিল। কিন্তু তখন অনেকেই তা স্বীকার করতে চাননি, কিংবা আন্দোলনের অতিরেক হিসাবে তাকে উপেক্ষা করেছিলেন।

Advertisement

আরও একটি বিপদের কথা। এই উপমহাদেশের কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীকে বিশেষ ভাবে বিপন্ন করে, যার হেতুটি নিহিত ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের আশ্চর্য ইতিহাসের মধ্যে। এবং তৎপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মধ্যে। সহজ হিসাবেই, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন যেমন ভারতকে তীব্র সঙ্কটে ফেলছে, তেমনই পাকিস্তানকে বিশেষ উজ্জীবিত করছে। যেহেতু বিজেপি শাসনাধীন ভারতে মুসলমান-বিদ্বেষ এই মুহূর্তে যথেষ্ট প্রকট, এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে যাতে নতুন করে কোনও সঙ্কট তৈরি না হয়, অনিয়ন্ত্রিত গুজব রটনা কিংবা বিদ্বেষে ইন্ধন জোগানো না হয়, এ সব নিশ্চিত করার ভার রইল যুগপৎ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উপর।বা‌ংলাদেশে সাধু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস প্রভুকে নিয়ে যে কাণ্ড চলছে, তার ফলে একটি ভয়ানক বাস্তব রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার উপরিতলে উঠে এল, এমনকি কূটনীতির মঞ্চে তরঙ্গ তোলার স্তরে পৌঁছল। ইসকন-কে ‘মৌলবাদী সংগঠন’ হিসাবে চিহ্নিত করে সেখানকার সরকারি অ্যাটর্নি জেনারেল-এর মন্তব্য পৃথিবীর সামনে স্পষ্ট করে দিল বর্তমান বাংলাদেশ সরকারে যাঁরা উপবিষ্ট, তাঁদের গভীর সংখ্যালঘু-বিদ্বেষের বাস্তবটিকে।

Advertisement

ভারত সরকার স্বভাবতই অতি বিচলিত। দ্ব্যর্থহীন দৃঢ় বার্তা দিয়েছে দিল্লি, যে কোনও ভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করুক বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। দেশের সংখ্যালঘুকে নিরাপত্তা দিতে দেশের শীর্ষনেতা মুহাম্মদ ইউনূস প্রবল ভাবে ব্যর্থ— এই বার্তা দিয়ে ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম-এর প্রধান জনি মুর আন্তর্জাতিক উদ্বেগকেও সামনে এনে একটি জরুরি ভূমিকা পালন করলেন। এত দিন যা চলছিল আড়াল আবডাল দিয়ে, এ বার তা খোলা আলোয় বেরিয়ে এল— বহু দুঃসংবাদের মধ্যেও এটুকু এক শুভ ইঙ্গিত। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকে বাংলাদেশে যে সংখ্যালঘু পীড়ন, নির্যাতন হয়ে চলেছে, কোথাও তার প্রতিকারের জন্য রব ওঠা দরকার। আশা করা যায়, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হবে, ঢাকার রাজনীতি-চালকরা নড়েচড়ে বসবেন, মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সরকারের পিছনে যে রাজনৈতিক মদতদাতা গোষ্ঠী, তাঁদের সতর্ক করা যাবে। যে ভাবেই হোক, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, বিশেষত বাংলাদেশি হিন্দু ও বৌদ্ধ নাগরিকদের উপর এই বিপুল নির্যাতন এখনই কড়া হাতে বন্ধ করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। মুহাম্মদ ইউনূস শান্তির প্রচারক হিসাবে বিশ্বস্বীকৃতি-প্রাপ্ত, নোবেল শান্তি পুরস্কার-ভূষিত, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই ইতিহাস রচিত হচ্ছে— এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে। বাংলাদেশের সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের পরেও সে দেশের একাধিক প্রান্তে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ উঠে এসেছে।

বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ অনুসারে, দু’দিন আগেই চট্টগ্রামে একটি মন্দিরে হামলা এবং ভাঙচুর হয়েছে। আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ি ও দোকানেও ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ‘ডিডি নিউজ়’-এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের শিবচরে ইসকনের একটি কেন্দ্র জোর করে বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইসকনের কলকাতার মুখপাত্র রাধারমণও সমাজমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। পাশাপাশি, চিন্ময়কৃষ্ণের গ্রেফতারির পরে আরও দুই সন্ন্যাসীকে চট্টগ্রাম পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ‘ইন্ডিয়া টুডে’। গত ৫ অগস্ট বাংলাদেশ শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। তার পর থেকে সে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর একের পর এক হামলা চলেছে বলে অভিযোগ। পিটিআইয়ের এক প্রতিবেদন অনুসারে, হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের ৫০টি জেলায় সংখ্যালঘুদের উপর ২০০টিরও বেশি হামলার অভিযোগ উঠে এসেছে।

দিল্লি থেকে ইতিমধ্যে একাধিক বার ঢাকাকে অনুরোধ করা হয়েছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। বিদেশ মন্ত্রক থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে দিল্লি উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু-সহ প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সে দেশের সরকারের, তা-ও জানিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পুলিশের হাতে সন্ন্যাসীর গ্রেফতারি প্রসঙ্গে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘‘আশা করব চিন্ময়কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচার হবে। তাঁর আইনি অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে।’’ ও পার বাংলায় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নের মুখে পড়ছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও বাংলাদেশের তদারকি সরকারের বক্তব্য, সে দেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদই রয়েছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের ‘হস্তক্ষেপ’ পছন্দ করছে না মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তদারকি সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম।

রাষ্ট্রপুঞ্জেও বাংলাদেশের তরফে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীন ভাবে ধর্মচর্চার অধিকার রয়েছে। সংখ্যালঘু-সহ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য।একদিকে যখন বাংলাদেশে চলছে সংখ্যালঘু নিপীড়ন তখন তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ল কলকাতা বইমেলা।এত দিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, এ বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলায় থাকছে না বাংলাদেশ,কারণটি রাজনৈতিক।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের জেরে উদ্ভূত পরিস্থিতিই এর কারণ, তার ছায়া পড়েছে ভারত-বাংলাদেশ কূটনীতিতে। কূটনীতি সর্বদাই কঠোর রীতিনীতি ও আদবকায়দায় মোড়া এক গম্ভীর বিষয়, জনাবেগের ধার ধারে না। এই আবহে চলছে নানা কথার চালাচালি: বইমেলার আয়োজক পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড বলছে মেলায় বাংলাদেশের উপস্থিতি নিশ্চিত করায় তাদের হাত নেই, পুরোটাই নির্ভর করছে উপরমহল অর্থাৎ এ দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের উপর। আবার প্রতি বছর মেলায় অংশগ্রহণ বিষয়ে গিল্ডকে জানানো হয় কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনের তরফে, এ বছর তা হয়নি। অন্য দিকে, বাংলাদেশে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক জানিয়েছেন বাংলাদেশি প্রকাশকদের মেলায় আসার আগ্রহ ষোলো আনা, কিন্তু সাড়া মেলেনি ভারত থেকেই। এই বিভ্রান্তিতে হাওয়া দিচ্ছে সমাজমাধ্যমে দুই দেশের বাঙালির বাগ্‌যুদ্ধ, মেলায় বাংলাদেশের অনুপস্থিতি ঘিরে ডেকেছে বিদ্রুপ ও বিদ্বেষের বান।

কূটনৈতিক নীরবতা ও সমাজমাধ্যমের চিৎকৃত বচসা, এই দুইয়ের মাঝে ক্ষতিটি হল কার? সাদা চোখে দেখলে বাংলাদেশের প্রকাশনা ও বই-বণিকদের, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বিপুল বিক্রয়ের সুযোগটি রুদ্ধ হল। কিন্তু আর্থিক ক্ষতির ও-পারেও বাকি থাকে কিছু, তা একেবারে গোড়ার ক্ষতি। বইমেলা মানেই বিপুল বিচিত্র বইয়ের সম্ভার, এই মুহূর্তে একটি দেশের সাহিত্য, সমাজ, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান তথা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ে লেখক-চিন্তকরা যা ভাবছেন, তার ঘনীভূত গ্রন্থরূপ। এই সময়ে পদ্মাপারে বাংলা ও বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে কোন গবেষণা হচ্ছে, কেমন চলছে অনুবাদকাজ, বিশ্ব ও বাংলার ইতিহাস সমাজতত্ত্ব অর্থনীতি নিয়েই বা কী ভাবছেন লেখকেরা, পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতির কোন দিগন্ত খুলে গেল, বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে এক ছাদের তলায় সেই খোঁজ পেতেন এ-পারের আগ্রহী পাঠক।

সমাজমাধ্যমে খড়্গহস্তরা আর যা-ই হোন প্রকৃত পাঠক নন, নইলে বই ও বইমেলাকে ক্ষুদ্র রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার উদারতাটুকু তাঁরা দেখাতেন। অস্থির সময়ে উস্কানিও প্রবল হয়, প্রয়োজন ছিল বই ও মননের চর্চা দিয়েই তাকে প্রশমিত করা, বাঙালির এত দিনের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সেতুটি পোক্ত করা। বইমেলায় বাংলাদেশের অনুপস্থিতি বুঝিয়ে দেবে, সেই সুযোগটি হেলায় হারাল। ১৯৯৬ সাল থেকেই কলকাতা বইমেলার অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। মাঝখানে এতগুলি বছরে বইমেলা জায়গা পাল্টেছে, স্টল বেড়েছে অনেক, প্রযুক্তিগত ও অন্যান্য আধুনিক প্রকরণ আত্মস্থ করে সে চরিত্রে হয়ে উঠেছে আরও আন্তর্জাতিক। এই আন্তর্জাতিকতার মধ্যে একটা চিরচেনা আন্তরিকতার স্পর্শ বয়ে আনত বাংলাদেশের বই, কলকাতা বলেই আরও— একই মাতৃভাষায় কথা বলা অথচ রাজনীতির ফেরে আলাদা ভূখণ্ডের বাঙালি যে আজও কেমন উদ্বেল পড়শি দেশের সাহিত্য, মননচর্চা ও এই সবেরই ধারক-বাহক বই নিয়ে, বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে প্রতি বছর পাঠকের ঢল ছিল তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।

Advertisement