• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বোডাস পরম্পরা নিয়ে প্রদর্শনী ও সংগীতানুষ্ঠান

প্রদর্শনীর সাজসজ্জা ও ভিস্যুয়াল নির্মাণের বাস্তব রূপদান করেন ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট ও কলাভবনের শিক্ষক সঞ্চয়ন ঘোষ। এই প্রদর্শনীর আয়োজনে যৌথভাবে সহযোগিতা করেছিল বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনের হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত বিভাগ, সঙ্গীত ভবন।

গোয়ালিয়র-জয়পুর গায়ন শৈলীর বিশিষ্ট কন্ঠসঙ্গীত শিল্পী বিদুষী বীণা সহস্রবুদ্ধেের পঁচাত্তরতম জন্মদিন ছিল সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ। আর এই উদযাপন উপলক্ষে তাঁর শিষ্য এবং কন্ঠসঙ্গীত শিল্পী ডঃ রঞ্জনী রামচন্দ্রন আয়োজন করেছিলেন এই ঘরানার উপর (পাঁচদিন ব্যাপী) একটি প্রদর্শনী ও সঙ্গীত সন্ধ্যার। কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক সংলগ্ন যদুনাথ ভবন মিউজিয়াম ও রিসোর্স সেন্টারে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই প্রদর্শনীতে কেবল তিনিই নন, তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পণ্ডিত কাশীনাথ বোডাস ও পিতা পণ্ডিত শংকর শ্রীপাদ বোডাসের অবদানের বিষয়েও উল্লেখযোগ্যভাবে আলোকপাত করা হয়। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন স্কলার ও বিশিষ্ট আর্ট সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সরোদশিল্পী পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় । অনিন্দ্য তাঁর বক্তব্যে গোয়ালিয়র ঘরাণা এবং বাংলায় এঁর উত্তরসূরী গাইয়েদের নিয়ে আলোকপাত করলেন। আর শমীক শ্রোতা হিসেবে নিজের অবস্থান এবং স্বাধীনতার পর ভারতে সঙ্গীতের পরিস্থিতি বিষয়ে ধারণা দিলেন।

ড: বীণা সহস্রবুদ্ধে (১৯৪৮-২০১৬) ছিলেন গোয়ালিয়র গায়নশৈলির একজন অগ্রগণ্য খেয়াল শিল্পী এবং হিন্দুস্তানি গানে দিকপাল কন্ঠের অধিকারিণী। তিনি নিজ পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছাড়াও পন্ডিত বলবন্থরাই ভট্ট, পন্ডিত বসন্ত ঠাকর এবং গজানন বুয়া যোশীর কাছে সঙ্গীতের শিক্ষা নেন। তারাণা, সগুণ ও নির্গুণ গানের জন্যে অর্জন করেছিলেন বিশেষ সুনাম। তিনি বিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তাঁর পরিবারের গানের সংকলনকলনগুলি একত্রিত করে ‘নাদ-নিনাদ’ এবং ‘উত্তরাধিকার ‘ শীর্ষক বইয়ের রচনা করেন, যেখানে বীণা তাই, তাঁর পিতা ও ভ্রাতার কথা মেলে।

Advertisement

পণ্ডিত শংকর শংকর শ্রীপাদ বোডাস (১৯০০-১৯৮৬) ছিলেন বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্করের একজন শিষ্য। ইনি সাংলি (মহারাষ্ট্র) নামক স্হানে জন্মগ্রহণ করলেও এই সঙ্গীতের প্রচার ও জনপ্রিয় করতে করার জন্য নিজেকে অনেকদূর বিস্তৃত করেন। যার ফলস্বরূপ এসে পৌঁছোন উত্তর প্রদেশের কানপুর শহরে। তিনি সব বয়সের মানুষদের সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছিলেন। নতুন উদ্ভাবনী পদ্ধতির ব্যবহার করেছিলেন; বিশেষ করে শিশুদের শেখানোর ক্ষেত্রে। কানপুরের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সঙ্গীতকে বিষয় হিসেবে রাখার জন্য তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সঙ্গীত সমাজ (১৯২৭) ও গান্ধী সঙ্গীত বিদ্যালয় (১৯৪৭)। অনেক রথী-মহারথীদের আমন্ত্রণ জানান সেখানে গান করার জন্য। এইভাবে কানপুর একসময় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে, যা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এছাড়াও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ইংরেজি, হিন্দি ও মরাঠি ভাষায় তাঁর লেখা বেরোত নিয়মিত।

Advertisement

বীণাজির বড় ভাই পন্ডিত কাশীনাথ বোডাস (১৯৩৫-১৯৯৫) ছিলেন গোয়ালিয়র শৈলীর একজন অগ্রগণ্য প্রতিনিধি। তিনি সুররচনাতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। তালিম পেয়েছিলেন পিতার কাছ থেকেই। তবে গানে পন্ডিত কুমার গন্ধর্বের ভোকালাইজেশন এবং পন্ডিত ডি. ভি পালুসকরের ভাবপ্রতিষ্ঠার অংশও পেয়েছিলেন। ব্যতিক্রমী কন্ঠের অধিকারী তাঁর গান পরিবেশনে তাঁর তালিমের যথাযথ সাক্ষ্য বহন করে। সঙ্গীতের রচনাকার হিসেবে তাঁর অবদান ছিল সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। যার মধ্যে খেয়াল, তারানা, গীত, ভজন ছিল বিশেষ সুনাম অর্জন করে। বহু হিন্দি গানের কথাতেও সুরারোপ করেছিলেন।

এই প্রদর্শনীতে দুর্মূল্য সব জিনিসের প্রদর্শন, যথা– পারিবারিক ছবি, পুরাতন স্বরলিপি খসড়া বইয়ের ছবি, গানের রেকর্ডিং ইত্যাদির সমাহার দেখা গেল। সাধারণ মানুষ ছাড়াও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত গণ্যমান্য বেশ কিছু দর্শক এই কদিনে উপস্থিত হয়েছিলেন।

এই প্রদর্শনীর অন্তিম দিনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন আয়োজক ডঃ রঞ্জনী রামচন্দ্রন। ইনি বর্তমানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহায়ক অধ্যক্ষ হিসেবে যুক্ত। আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির একজন স্কলার যিনি প্রারম্ভিক পর্যায়ে বীণা তাই ও বোডাসদের কাছে তালিম লাভ করেন। পরবর্তীতে তালিম গ্রহণ করেন আরেক বিশিষ্ট গুরু পন্ডিত উলহাস কোশলকারের কাছে যা এখনও বর্তমান। এই সন্ধ্যায় তিনি পরিবেশন করেন রাগ ধানি (বিলম্বিত রূপক ও দ্রুত ত্রিতাল বন্দিশ), রাগ মারবা (মধ্যলয় ত্রিতাল তারাণা ও আড়া চৌতাল দ্রুত বন্দিশ), মিঁয়া মল্লারে দ্রুত একতাল তারাণা, এবং পরিশেষে দুটি নির্গুণ ভজন। তাঁকে সহযোগিতা করেন- অশোক মুখার্জি (তবলা) ও গৌরব চ্যাটার্জি (হারমোনিয়াম)।

প্রদর্শনীর গবেষণা ও সম্পূর্ণ রূপদান করেন রঞ্জনী নিজেই। প্রদর্শনীর সাজসজ্জা ও ভিস্যুয়াল নির্মাণের বাস্তব রূপদান করেন ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট ও কলাভবনের শিক্ষক সঞ্চয়ন ঘোষ। এই প্রদর্শনীর আয়োজনে যৌথভাবে সহযোগিতা করেছিল বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনের হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত বিভাগ, সঙ্গীত ভবন।

Advertisement