স্পেস

Written by SNS March 17, 2024 5:00 pm

নির্মলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

নকশাকাটা কাঁসার বগিথালা৷ এবাড়িতে ফি বছরে একদিনই বেরোয় সে থালা৷ নিপুণ হাতে কঠিন ধাতু কুঁদে সারা গায়ে আলপনা আঁকা৷ দু’দিকে দুটো ময়ূর৷ খাঁটি খাগড়াই কাঁসার থালার ওপরে নকশা এঁকেছিল তখনকার বিখ্যাত কারিগর ঝাওন মিস্ত্রি৷ কাশিমবাজারের রাজবংশের কোন উত্তরসূরির ফরমায়েশে৷ সে আজ প্রায় বছর চল্লিশ আগের কথা৷ আসলে মাধবীলতার বিয়েতে রাজবাড়ির সম্পর্কিত কারও নেমতন্ন হয়েছিল কোনও সূত্রে৷ তাঁদের তরফেই উপহার এসেছিল বাটি গেলাস সমেত ওই থালা৷ বিয়েতে নেমতন্নের যে কার্ড ছাপানো হয়েছিল, থালার ওপরে হুবহু সেই একই নকশার প্রতিলিপি৷ এমনকি আদিত্য-মাধবীলতার নাম আর বিয়ের তারিখও খোদাই করা৷ বেশ ক’বছর ধরে মাধবীলতার জন্মদিনে এই থালাতেই ভাত সাজিয়ে দেয় বৌমা শিউলি৷

ডাইনিং টেবিলের ওপরে ফুলছাপা প্লাস্টিকের কভার৷ তার ওপরে থালায় যত্নে সাজানো ভাত, লালশাক, কুমড়ো ফুলের বড়া, বেগুনভাজা৷ বাটিতে মুগডাল, ছানার ডালনা, চাটনি আর পায়েস৷ মাধবীলতা নিরামিষ খান৷ অন্যদিন ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দু’প্রস্থ রান্না করতে হয় শিউলিকে৷ এদিন অবশ্য সবটাই নিরামিষ৷ মুখোমুখি চেয়ারে ছেলে জয়৷ বাঁপাশে বৌমা শিউলি৷ দু’বছর পেরনো নাতি বুল্টির খাওয়া শেষ৷ সে এখন চাকা লাগানো মস্ত কাঠের ঘোড়াটাকে টেনে টেনে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে৷

থালাটা ছুঁলেই বর্ষার ভারী মেঘের মত রাশিরাশি দলাপাকানো কথা ভেসে এসে ভিড় করে মাধবীলতার মনে৷ পাউন্ড রোডের শেষে একচিলতে উঠোনঘেরা ছোট্ট রং-চটা একতলা বাড়ি৷ আদিত্য যখন বিয়ে করে তাঁকে এবাড়িতে তোলেন, তখন আর লোক বলতে শ্বশুর-শাশুড়ি৷ এবাড়িতে তাঁর জীবনের প্রথম দিন থেকেই শ্বশুরকে অসুস্থ দেখেছেন মাধবীলতা৷ আদিত্য ছিলেন হাই স্কুলের টিচার৷ পরে অবশ্য হেডমাস্টার হয়েছিলেন৷ মাধবীলতা শুনেছেন আদিত্য ছাত্রজীবনে ছিলেন খুবই মেধাবী৷ সেকালে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েও পড়তে যেতে পারেননি বাবা-মাকে ফেলে৷ মাধবীলতা বিয়ের পর প্রায় বছর পনেরো কোনও চাকরির কথা ভাবেননি৷ অসুস্থ শ্বশুর আর বৃদ্ধা শাশুড়ির দেখভাল করতেই দিনের বেশিটা কেটে যেত তাঁর৷ তারপর হঠাৎই সুযোগটা আসে৷ ততদিনে শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেই মারা গেছেন৷ ছেলে জয় তখন ক্লাস টু৷ মেয়ে ঝুমা ক্লাস সেভেন৷ তাদের সবসময় দেখার জন্য বাড়ির পুরনো কাজের লোক কল্পনা এককথায় রাজি হয়ে যায়৷ আদিত্যর ইচ্ছেয় মাধবীলতা যোগ দেন ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে৷ সেখান থেকেই বই পড়ার ইচ্ছেটা জাঁকিয়ে বসে তাঁর মাথায়৷

এরপর সংসার এগিয়েছে সময়ের নিয়মে৷ মেয়ের বিয়ে হয়েছে কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার আগেই৷ আদিত্য যথাসময়ে রিটায়ার করেন৷ কলেজ পাশ করে জয় কিছুদিন স্কুল মাস্টারি করে৷ একসময় ব্যাঙ্কে সুযোগ পেয়ে সেখানেই যোগ দেয়৷ কলকাতায়৷ এরপরই মাধবীলতার সংসারের তাল কাটে৷ আচমকাই একদিন আদিত্য চলে যান৷ মাধবীলতা একা হয়ে পড়েন৷ পরের তিনটে বছরও পাউন্ড রোডের বাড়িতে একলা কাটে তাঁর৷ তারপর মা-ছেলে যুক্তি করে বহরমপুরের বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাট কেনা হয় কলকাতায়৷ নিরুপায় মেয়েও সায় দেয় তাতে৷ পয়সাকড়ির ঘাটতি মেটাতে নিজের ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিতে হয় জয়কে৷ মাধবীলতা ছেলের কাছে কলকাতা আসেন৷

এবার মাধবীলতার নতুন কাজ হয় ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজা৷ এরই মাঝে খবর আসে জয়ের প্রমোশন হয়েছে৷ সরকারি নিয়মে রুরাল পোস্টিং৷ যেতে হবে উড়িষ্যার গ্রামে৷ জয় প্রমোশন নিতে চায় না৷ মাকে কোথায় রাখবে সে৷ মাধবীলতা ব্যাপারটা বোঝেন সবটাই৷ উপায় বের করতে পারেন না৷ মুখে শুধু বলেন— পাউন্ড রোডের বাড়িটা থাকলেও চলে যেতে পারতাম৷ ছেলে মাকে ভরসা দেয়— চিন্তা কোরো না, মা৷ প্রমোশন আবার আসবে৷

এরও পরে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন মাধবীলতা৷ নাতি এসেছে৷ ফুড কর্পোরেশনের টাইপিস্টের চাকরি ছেড়ে বৌমা সংসারেই থিতু হয়েছে৷ ছেলে বৌমার কাছে মাধবীলতা সুখেই আছেন৷ দু’কামরার ফ্ল্যাটের একটা ঘর তাঁর জন্য বরাদ্দ৷ বৌমা শিউলিকে দিনের অনেকটা সময়ই খরচ করতে হয় তাঁর জন্য৷ এক কথায় ছেলে বৌমা নাতিকে নিয়ে মাধবীলতার এখন সুখের সময়৷

এরই মধ্যে অবশ্য আবার খবর আসে৷ একই সঙ্গে প্রোমোশন আর বদলির অর্ডার এসেছে জয়ের৷ এবার নাকি যেতেই হবে৷ নতুন পোস্টিং দিল্লি৷ বেশ কিছুদিন ধরে এটাই এবাড়ির একমাত্র আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে৷ ব্যাঙ্ক কোয়ার্টার দেবে৷ কিন্ত্ত মাধবীলতা দিল্লি যেতে চান না এই বয়সে৷ এখানে একা থাকাও সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে৷ এদিকে বুল্টিকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে৷ ঠিক হয়েছে শিউলি ছেলে আর শাশুড়িকে নিয়ে কলকাতায় থেকে যাবে৷ জয় একাই যাবে দিল্লি৷ এছাড়া আর কোনও উপায় খুঁজে পায়না কেউ৷ আরও ঠিক হয় শিউলির সুবিধার জন্য বুল্টিকে ভর্তি করা হবে বাড়ির কাছাকাছি কোনও স্কুলে৷

মনের মধ্যে পুরনো কথার ঢেউ ওঠে৷ বাইরে কিছুই প্রকাশ করেন না মাধবীলতা৷ ছেলে বৌমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে বলতে খেয়ে চলেন৷ কখনও স্নেহভরে দুটো বড়া তুলে দেন ছেলের পাতে, কখনও বৌমাকে আর একটু ডাল নিয়ে ভাতটা মাখিয়ে নেবার পরামর্শ দেন৷ তারপর ভাত খাওয়া শেষ করে একসময় পায়েসের বাটি হাতে তুলে নেয় সবাই৷ বুল্টি খেলতে খেলতে ছুটে এসে হাঁ করে পায়েস খাবার আব্দার করে ঠাম্মার কাছে৷ মাধবীলতা চামচে করে পায়েস নিয়ে তাকে খাওয়ান৷ পায়েস চিবোতে চিবোতে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয় সে৷

ছুটির দিনে খাওয়ার শেষে এঁটো হাতে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করা এ বাড়ির নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাতে আবার আজ এক বিশেষ দিন৷ ছেলে বৌমার দিকে চোখ রেখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাধবীলতাই শুরু করেন আজ— আমি আশ্রমে যেতে চাই৷
ছেলে বৌমা পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে খানিক৷ মাধবীলতা প্রতি শনিবার আশ্রমে যান৷ সেখানে সন্ধ্যাবেলায় পুজো আরতি দেখেন৷ ধর্মকথা শোনেন৷ তাঁর যাতে কষ্ট না হয়, শনিবারগুলোর জন্য একটা অটো বলে রেখেছে জয়৷ কিন্ত্ত আজ কেন?

আজ তো শনিবার নয় মা৷ কোনও বিশেষ অনুষ্ঠান আছে নাকি? —শিউলি মাধবীলতার দিকে চায়৷
বৌমা, আমি পাকাপাকিভাবেই আশ্রমবাসী হতে চাই৷ এটাই আমার শেষ ইচ্ছে৷

নিজেদের কানগুলোকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় জয় আর শিউলির৷ কী বলছেন, মা! মাধবীলতা শান্তভাবে বুঝিয়ে বলেন৷ —দ্যাখ্ জয়৷ আমি তো বহুদিন থাকলাম তোদের সঙ্গে৷ এবার একটু একলা থাকতে চাই৷ তোরা হয়তো জানিস না, সারদা আশ্রমে বয়স্কা মহিলাদের থাকার ব্যবস্থা আছে৷ যাকে তোরা বলিস বৃদ্ধাশ্রম৷ অবশ্য ওখানে জায়গা পাওয়া খুবই কঠিন৷ আমি বছর দুই আগেই অভি মহারাজকে বলে রেখেছিলাম৷ পরে দরখাস্তও জমা দিয়েছি নিয়ম মেনে৷ ঠাকুর এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন৷ আমার এবার ডাক এসেছে৷

কিন্ত্ত কেন মা? তোমার কি কোনও অসুবিধা হচ্ছে এখানে? আমাকে খুলে বল৷ —জয়ের গলায় অসহায় ভাব ফুটে ওঠে৷
আপনি কি রাগ করেছেন, মা, আমার ওপরে? কখন হয়তো খারাপভালো কিছু বলে ফেলেছি৷ আমি ক্ষমা চাইছি, মা৷ এমনটা ভাববেন না একদম৷ শিউলির দু’চোখ ছলছল করে ওঠে৷ নিমেষে বাড়ির পরিবেশটা কেমন ভারী হয়ে যায়৷
মাধবীলতা পরমস্নেহে এঁটো হাতটাই মাথায় রাখেন শিউলির৷ —ছিঃ মা৷ আমি কি তা বলেছি? আসলে আমার এবার ছুটি চায় বৌমা৷ তাছাড়া এই তো কাছেই থাকবো৷

শাশুড়ি বৌয়ে ছোটোখাটো খিটিমিটি হয়েছে অনেকবার৷ জয়ও কখনও এপক্ষ, কখনও-বা ওপক্ষ নিয়ে কথা বলেছে৷ কিন্ত্ত আজকের মত পরিস্থিতি এ বাড়িতে তৈরি হয়নি কখনও৷ ব্যাপারটা বুঝে উঠতে সময় লাগে জয় আর শিউলির৷ হতভম্ব হয়ে তারা পরস্পরের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ কেউ কি কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে মাধবীলতাকে? হঠাৎ কেনই-বা এমন কথা৷ অথচ শুনেই বোঝা যায় এর পিছনে আছে তাঁর অনেকদিনের চিন্তাভাবনা৷

মাধবীলতা নিজেই কথা বলে ওঠেন৷
—অনেকদিন ধরেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম৷ তারপর একদিন নিজে নিজেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে বসলাম৷ ভেবে দেখলাম, যথেষ্ট দেরি করেছি আমি৷ দরখাস্ত জমা দেবার পর থেকেই অপেক্ষা করে আছি৷ তোদের বলিনি তোরা কষ্ট পাবি তাই৷ আমি সবদিক চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ তোরা ভালো মনে মেনে নে৷
কিন্ত্ত আমাদের ছেড়ে ওখানে থাকতে কষ্ট হবে না আপনার? —শিউলি শুধোয়৷

নিশ্চয় হবে৷ দাদুভাইকে তো দারুণ মিস করবো৷ তবু শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে দিনের পর দিন ওর ভাগের আলো-বাতাসটুকু শুষে নেবার অধিকার আমার আছে কি? প্রত্যেকেরই বেঁচে থাকার জন্য একটা নিজস্ব পরিসর দরকার হয়৷ যাকে তোমরা আজকাল স্পেস বলো৷ মা হয়েছি বলেই সেখানে দখলদারি করতে আর মন চাইছে না বৌমা৷ তোমাদের জীবন থেকে চুরি যাওয়া সেই পরিসরটুকুই আজ ফেরাতে চাই আমি৷

মায়ের কথা কেমন যেন দুর্বোধ্য ঠেকে ছেলের কানে৷ —তুমি ঠিক কি চাইছো বলো তো? ছেলে ভারী চোখে মায়ের দিকে তাকায়৷
খুব সোজা৷ আমি চাইছি তুই বৌমা দাদুভাইকে নিয়ে দিল্লি যাবি৷ অফিস জয়েন করবি৷ ওখানেই সংসার পাতবি৷ এবার থেকে নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভাববি৷ দাদুভাইকে কোনও ভালো স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করবি৷ ওখানে কত নামীদামী স্কুল৷ এটাই ঠিক সময়৷ এরপর দেরি হয়ে যাবে৷ আমি এখানে আশ্রমেই ভাল থাকব৷ মাঝেমধ্যে খবরাখবর নিবি৷ —মাধবীলতা শান্তভাবে উত্তর দেন৷
—থাকার জায়গাটা তুমি কি নিজে দেখেছো মা? থাকতে পারবে ওখানে?

—দেখেছি বইকি৷ আপাতত বত্রিশজন আমার মত মানুষ থাকেন সেখানে৷ তুই চিনবি না, কণাদি মানে কণা বিশ্বাসও ওখানে থাকেন৷ আমরা যখন বেশ ছোট, কণাদি রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন৷ আমার যেটুকু শেখা সে তো তাঁরই কাছে৷ জানিস জয়, কণাদির এখন বিরানব্বই৷ দেখা করেছি৷ কথাও হয়েছে৷ হুইলচেয়ারে বসেও কী তরতাজা মন এখনও৷ কী বললেন জানিস৷ বললেন, ‘চলে আয়৷ দুজনে মিলে আবার মহড়া শুরু করি৷ একেবারে প্রথম থেকে৷ মনে আছে, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে৷’
ছেলে বৌমা এতক্ষণে সবটুকু বুঝতে পারে৷ স্থির প্রতিজ্ঞায় মাধবীলতার মুখখানা থেকে যেন আলো চলকাচ্ছে৷ দুজনে একসুরে শুধোয়— কবে যেতে হবে মা? মাধবীলতা কিছুক্ষণ চুপ থাকেন৷ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখদুটো মোছেন৷ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাটির দিকে চেয়ে নরম গলায় উত্তর দেন— আজই৷ বিকেল পাঁচটায় মহারাজ নিজেই আসবেন আমাকে নিতে৷ এটাই আশ্রমের রেওয়াজ৷
চমকে ওঠে দু’জনে৷ —সে কী, আজই! গুছিয়ে নেবে না তুমি? যদি যেতেই হয়, এত তাড়াতাড়ি কেন মা? তাছাড়া আমাদের একটু ভাবতে দেবে তো৷ আমার নতুন অফিসে জয়েনিংয়ের জন্যও তো ওরা কিছুদিন সময় দেবে৷

গুছিয়ে নেবার কী-ই বা আছে আমার৷ তোরা বরং একটা ব্যাগে আমার দুচারটে জামাকাপড় দিয়ে দিস৷ ওখানে সব ব্যবস্থাই আছে৷ এমনকি টুকিটাকি দরকারে ডাক্তারেরও৷ আর আছে আশ্রমের নিজস্ব ছোটোখাটো একটা লাইব্রেরি৷ আমার কোনও অসুবিধাই হবে না৷ আর হঁ্যা, তোর বাবার লাঠিটা আর দাদুভাইয়ের একটা ফটো আমাকে দিয়ে দিবি৷ আমাকে আটকাস নে৷ সবাই তো বলে শুভস্য শীঘ্রম৷ তাছাড়া আমি তো এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছি৷ তিনজোড়া চোখের জলে ভিজে এ বাড়ির কথারা শব্দ হারায়৷ সেই চুপকথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বুল্টি দৌড়ে গিয়ে ঠাম্মির কোলে মুখ লুকায়৷

মহারাজ আসেন ঠিক পাঁচটায়৷ সঙ্গে আটপৌরে চেহারার মাঝবয়সী এক মহিলা৷ পরনে ডোরাকাটা শাড়ি৷ শাড়ির খুঁটটা গলায় জড়ানো৷ খালি পা৷ জয় এবং শিউলি দুজনেই মহারাজকে চেনে৷ মাধবীলতাকে নিয়ে তারাও অনেক সন্ধ্যায় আশ্রমে গেছে৷ মহারাজের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে তাদের৷ এখন দু’জনে গড় হয়ে প্রণাম করে মহারাজকে৷ জয় ভাঙা গলায় তাঁকেই শুধিয়ে বসে— মহারাজ, আপনি কি কিছু জানেন, কেন মা হঠাৎ আমাদের ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন? মহারাজ মৃদু হাসেন৷ —তোমরা চোখের জল মোছো আগে৷ তোমাদের গর্ব হওয়া উচিত এমন বুদ্ধিমতী মা পেয়েছো তোমরা৷ আমাকে উনি সব কথাই বলেছেন৷ কোনও অভিযোগ নেই ওঁর৷ অভিমানও নয়৷ শুধু তোমাদের জীবনের প্রতিপদে অন্তরায় হয়ে থাকাটা আর চাইছেন না উনি৷ তোমরা সহজে মেনে নেবে না বলেই আগে থেকে তোমাদের জানাননি কিছু৷ ভেবে দ্যাখো, সেই প্রাচীন যুগেও তো ভারতবর্ষে নিজের ইচ্ছেয় বাণপ্রস্থে যাবার রীতি ছিল৷
নিঃশব্দে মাধবীলতার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে দু’জনে৷ দু’জনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করেন মাধবীলতা৷ তারপরই ছোট্ট বুল্টিকে কোলে তুলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন৷
আশ্রমের গাড়িতে সামনে ড্রাইভারের পাশে মহারাজ৷ পিছনে মাধবীলতার পাশে ডুরে শাড়ির মহিলা৷ মহারাজই আলাপ করিয়ে দেন৷

—আশ্রমের সবাই ওকে শিবুর মা বলে ডাকে৷ নিশ্চয় দেখে থাকবেন আগে৷ মন্দির পরিষ্কার ছাড়াও সারদা ভবনের বাসিন্দাদের দেখাশোনা করে থাকে৷ আসলে আর সবার মত ওর নিজেরও একটা গল্প আছে৷ আমার ইচ্ছে আপনি আশ্রমে পাকাপাকিভাবে পা রাখার আগেই ওর গল্পটা জেনে যান৷
এতক্ষণে মহিলা কথা বলে ওঠে৷ —দিদি, আমাকে শিবুর মা বলেই ডাকবেন৷ আগে থাকতাম যাদবপুর রেললাইনের গায়ে বস্তিতে৷ কাছাকাছি দুটো বাড়িতে বাসন মাজার কাজ৷ পরে আশ্রমের মন্দিরে ধোয়ামোছার কাজটা জুটে যায়৷ শিবুর বাবা মুটে মজুরের কাজ করত৷ একদিন মদ খেয়ে রেলেই কাটা পড়ে লোকটা৷ তারপর থেকে ছ’ফুটের ঝুপড়িতে আমরা মা-ব্যাটা৷ এমনিভাবেই দিন কাটছিল৷ একদিন সন্ধ্যেবেলা শিবু ঘরে ফেরে একটা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে৷ —‘মা তোমার বৌমাকে নিয়ে এলাম’৷ আনন্দে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন৷ তারপর সাততাড়াতাড়ি ভাত বসিয়ে দিই৷ ব্যাটা, ব্যাটার বউ আর আমি একসাথে বসে ডিমসেদ্দ ভাত খেলাম সে-রাতে৷ তারপর ‘তোর সন্ধ্যা মাসির ঘরে শুতে যাচ্ছি’ বলে বেরিয়ে আসি৷ রাতভর যাদবপুর ষ্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে৷ ভোরভোর উঠেই সোজা মহারাজের কাছে এসে কেঁদে পড়লাম৷ মহারাজই সব শুনে ব্যবস্থা করে দেন৷ সেই থেকে সারদা ভবনের মানুষদের সেবাযত্ন করাই আমার কাজ৷ ওই বাড়িতেই চিলেকোঠার ঘরে আমার থাকা৷ সেও মহারাজের দয়ায়৷ আমি ভালোই আছি দিদি৷ ওদিকে শিবুও বউকে নিয়ে বেশ আছে৷ মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখা করে আসি৷ একবার ওদের সঙ্গে করে এনে মায়ের মন্দিরে পেন্নামও করিয়ে দিয়েছি৷ সবই মায়ের কিপা দিদি৷— শিবুর মা কপালে হাত ঠেকায়৷ মাধবীলতা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন পাশে বসা শিবুর মা-র মুখের দিকে৷ পাথরের মত শক্ত সে মুখ নির্মল আনন্দে ভরপুর৷ তারই মাঝে টাটকা বেলফুলের মত নিষ্পাপ দুটো জলজ্যান্ত চোখে একযোগে খেলা করছে মায়া আর প্রজ্ঞা৷
নিজের অজান্তেই মাথাটা ঝুঁকে আসে মাধবীলতার৷ ওদিকে তাঁদের নিয়ে গাড়িটা সারদা আশ্রমের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢোকে৷