প্রকৃতিবিমুখ আধুনিক সভ্যতায় প্রকৃতির প্রতিশোধ অনিবার্য, গ্রীষ্মের রুদ্রমূর্তিও স্বাভাবিক!

Written by SNS May 7, 2024 1:26 pm

স্বপনকুমার মণ্ডল: চারিদিকে গরমে লোকে হাঁসফাঁস করছে, ঘরে থেকেও অসহ্য গরমে তার নাভিশ্বাস উঠছে৷ বিশেষ করে কলকাতা মহানগরে রাজস্থানের তাপমাত্রাকে হারিয়ে দেওয়ার খবরও সংবাদপত্রে জায়গা করে নিচ্ছে৷ ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টির মতো তাপমাত্রা মিলিয়ে দেখার অস্থিরতা চেপে বসেছে লোকের মনে৷ এজন্য তার নেপথ্যে নির্বিচারে গাছ কাটার দায় চাপিয়ে সমাজমাধ্যমে তা নিয়ে চর্চাও শুরু হয়ে গেছে৷ অবশ্য প্রতিবারই গ্রীষ্মের দাবদাহে আমাদের নির্বিচারে গাছ কাটার কথা মনে পড়ে, গাছ লাগানোর জরুরি বার্তা ফিরে ফিরে আসে৷ যেন গাছের অভাবেই শুধু গ্রীষ্মের রুদ্রমুর্তি জেগে ওঠে৷ তা তো নয়, তার মূলে থাকে মানুষের সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা আর অপরিসীম লোভ৷ মানুষের সেই সর্বগ্রাসী বিকৃত ক্ষুধাতেই গ্রীষ্মের সংহারমূর্তি জেগে ওঠে৷ প্রকৃতিকে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে৷ সেখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অভাবেই প্রকৃতির প্রতিশোধ অনস্বীকার্য৷ গরমে অতিষ্ঠ মানুষের মনে গাছের অভাব যেমন জায়গা করে নেয়, খাল বিল নদীনালা, জলাশয় প্রভৃতির সংকট তেমন ভাবিয়ে তোলে না৷ শুধু তাই নয়, সভ্যতাগর্বী মানুষের আধুনিকতাবোধে প্রকৃতিবিরুদ্ধ উন্নয়নও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কারণ, তাও থেকে যায় অন্তরালে৷ সেখানে প্রকৃতিকে নির্বিচারে অস্বীকার করে মানুষের স্বরচিত সভ্যতা যত এগিয়ে যায়, ততই প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনিবার্য হয়ে ওঠে৷ সেখানে ‘গাছ লাগাও, প্রাণ বাঁচাও’ থেকে ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’ আমরা মেনে নিলেও মনে নিতে পারিনি৷ এজন্য এখনও আমাদের উন্নয়নে বন কেটে বসতি গড়ে তোলার ধারায় গাছ কেটে, জলাশয় বুজিয়ে শহর থেকে নগরায়নের দৌরাত্ম্য অব্যাহত৷ যন্ত্র সভ্যতার অভিঘাতে প্রাকৃতিক চাহিদা স্বাভাবিক ভাবেই প্রান্তিক হয়ে পড়ে৷ গরম লাগলে কেউ আর গাছের ছায়া খোঁজে না, হাতপাখাও ধরে না, সোজা ফ্যান বা এসি চালিয়ে বসে৷ মনের ঘরে যেখানে গাছগাছালির মধ্যে জঞ্জাল দেখার বাতিক, সেখানে ইট-কাঠ ও পাথরের জঙ্গলে বাস করে ধোপদুরস্ত পরিপাটি জীবনে গরমের সময়েই গাছের অভাব মনে পড়ে৷ অথচ তাতেও হুঁশ ফেরে না৷ গাছ লাগানোর কথা বলে ফ্যান থেকে এসির দিকে দৃষ্টি সম্প্রসারিত হয়, গলা ভেজানোর জন্য ফ্লিজ থেকে আইসক্রিমের কথা মনে পড়ে৷ সেক্ষেত্রে সবুজায়নের কথা বললেও প্রকৃতির অভাব মেটানোর চেয়ে তা কাটিয়ে ওঠার বিলাসিতায় সুখ খুঁজে নেওয়ার আয়োজন আরও নিবিড় হয়ে ওঠে৷ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণেই মানুষের সভ্যতার বুনিয়াদি চেতনার বিস্তারের করুণ পরিণতিতে দূষণপীড়িত পৃথিবীর তীব্র আর্তি তার তীব্র যন্ত্রণাতেই তা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে৷ তীব্র জলকষ্ট থেকে অসহনীয় গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন আজ প্রকৃতির শিকারে পরিণত হয়েছে৷

আসলে এই সভ্যতার ধারক-বাহক থেকে চালক সবেতেই মানুষের একাধিপত্য৷ সেখানে মানবসভ্যতা যেমন মানুষের সৃষ্টি প্রতিভার প্রতাপে প্রকৃতিতে পরাজিত করার দুর্বার বাসনা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে, তেমনই তার ধ্বংসলীলাও বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে৷ পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় আনতে গিয়ে তার আগ্রাসী স্বেচ্ছাচারিতা ভয়ঙ্কর লাভ করেছে৷ সেখানে আধিপত্যকামী শক্তিতে কোনোকিছুকে তোয়াক্কা না করার প্রবণতায় মানুষের অপরাজেয় প্রকৃতিই তার প্রকৃতিকে অস্বীকার করে তার জয়যাত্রাকে অব্যাহত রাখতে চেয়েছে৷ মানুষের অনন্ত চাহিদার শিকার আজ সবুজ প্রকৃতি, সুজলা ও সজীব পরিবেশ৷ গুহাবাসী মানুষের বন কেটে বসতির মাধ্যমে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল৷ সেই বাসভূমি বন কেটে কৃষিক্ষেত্রে আরও বিস্তার লাভ করে৷ আধুনিক সভ্যতার বিকাশে সেই বিস্তৃতি বাস থেকে আবাসেই শুধু শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেনি, সবুজ প্রকৃতিকে ধ্বংস করেই তার শহরায়ণ থেকে নগরায়ণের আভিজাত্য বিস্তার ঘটে৷ সেখানে কৃষিক্ষেত্রেও শিল্পায়নের আধিপত্যে তার আকাশ বাতাস থেকে জলস্থল সর্বত্র দূষণের শিকার৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে মানুষের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির প্রাচুর্যে খেয়াল না করা দৈত্যের দৃষ্টিতে শুধু সবকিছুকে করায়ত্ত করতে গিয়ে যন্ত্র সভ্যতার প্রতাপ যত বেড়েছে, ততই তার অস্তিত্ব সংকট নিবিড় হয়ে উঠেছে৷ সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’- এর সূচনা পত্রে ইউরোপের বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় তারা দেবতার শক্তি পেলেও দেবত্ব না পাওয়ার কথা বলেছেন৷ আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভোগী মানসিকতায় প্রতিযোগিতা যত বেড়েছে, সহযোগিতা অস্বীকৃত হয়েছে৷ কে কত বেশি ভোগ করতে পারে, তার অস্থির প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই তার সহযোগিতার মানসিকতা পিছিয়ে পড়ে৷ এই স্বার্থপরতাও প্রকৃতির সংহারমূর্তিকে সক্রিয় করে তুলেছে৷ সেক্ষেত্রে প্রকৃতিনির্ভরতা কাটিয়ে ওঠাই নয়, তাকে অস্বীকার করার প্রবণতাই সেখানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে৷ যেনতেন ভাবে আধুনিক সভ্যতায় বিস্তারে প্রতিযোগিতায় আড়ম্বরে মানুষের দৈত্য সত্তার দ্বিচারিতা স্বাভাবিকতা লাভ করে৷ একদিকে তার প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত, অন্যদিকে বন্য প্রকৃতিকে সংরক্ষণের প্রয়াস জারি৷ তা দেখে মনে হবে গাছ কাটার পাশাপাশি গাছ লাগানোয় ভারসাম্য রক্ষা করার সচেতন প্রয়াস সেখানে সক্রিয়৷ অথচ তাতে বিস্তর ফাঁক ও ফাঁকি রয়েছে৷ নিজের প্রয়োজনেই তার আয়োজন, প্রকৃতি উপভোগ করার তার দিকেই আন্তরিকতা নিঃস্ব হয়ে পড়ে৷ সেদিক থেকে প্রকৃতির সবুজ সজীবতার চেয়ে তার বিকল্পের স্থায়িত্বের প্রতিই আধুনিক মনস্কতা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ প্লাস্টিকের ফুলকে দীর্ঘস্থায়ী রূপে আরও বেশি বর্ণরঙিন ও মনোহর করে তোলার দৃষ্টি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে৷ সেখানে শহরের কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টিতেও তার আয়োজন লক্ষণীয়৷ আবার পার্ক বা টু্যরিস্ট স্পট গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও সেই কৃত্রিম পরিবেশের নেপথ্যেও মানুষের প্রকৃতিকে যাচ্ছেতাই ভাবে ব্যবহার করার মধ্যেই তার বিকল্প আয়োজন চোখে পড়ে৷

আসলে প্রকৃতিবিমুখ মানবসভ্যতায় প্রাকৃতিক সংকটের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা থেকে উত্তরণের প্রতি উদাসীনতাই শুধু নয়, তার উন্নততর বিকল্পের প্রতি মানুষের সচেতনতা অনেক বেশি সক্রিয়তা লাভ করে৷ সেখানে প্রকৃতির প্রতিকূলতাই ভোগী মানুষের মনে আনুকূল্য লাভ করে৷ গাছের অভাবে অসহনীয় গরম পড়লে গাছ লাগানোর কথা বললেও মনে তার ফ্যান থেকে এয়াকুলার বা এসি থেকে ফ্রিজে ঠান্ডা জল, আইসক্রিমের কথা জেগে ওঠে৷ স্বাভাবিক ভাবেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় না, উল্টে তার বিকল্পকে আরও বেশি উপাদেয় করে উপভোগ করার আয়োজন চলে৷ ধনের দারিদ্রের চেয়ে মনের দারিদ্র আরও বেশি অসহনীয়৷ একই গরম ধনীদরিদ্রভেদে ভিন্ন প্রকৃতির৷ একে মানিয়ে নেয়, অন্যে মানিয়ে নিতে পারে না, মনে তো দূরস্থান৷ আরামপ্রবণ ভোগীর মনে গরমের ছটফটানি স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হয়৷ আবার তার সুরাহাতে যে এসি চলে তার দূষণও সবচেয়ে বেশি৷ সেদিক থেকে আধুনিক ভোগবিলাসে প্রকৃতির অস্তিত্ব শুধু বিপন্ন হয়নি, দূষণের মাত্রাও বাড়িয়ে চলে৷ সেখানে মানুষের সীমাহীন লোভে প্রকৃতিকে শিকার করতে গিয়ে মানুষ নিজেই আজ তার শিকার, ভাবা যায়! ইট-কাঠ-পাথরে বাস করতে গিয়ে প্রকৃতিকেই উদ্বাস্তু করেছিল মানুষ৷ সেই উদ্বাস্তুদেরও ভিখিরি বানিয়ে অবজ্ঞা আর উপেক্ষা করেছে অবিরত৷ ছাতার মতো ঝড়বৃষ্টি ও রোদ থেকে যা অকৃপণভাবে মানুষকে রক্ষা করছিল, সেই ছাতাটিই আজ হাতছাড়া হয়েছে৷ প্রকৃতির সেই অনুকূল পরিবেশের অভাবেই তার ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতা নেমে এসেছে৷

কলকাতার ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে সেই দৈত্যের প্রতাপ যে বেশি হবেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ মানুষ ও প্রকৃতির অচ্ছেদ্য বন্ধনকে নগরবাসীই যে প্রতিনিয়ত অস্বীকার করে চলেছে৷ সেখানে ইকোসিস্টেমই ইকোনমিতে রূপান্তর ঘটে৷ প্রকৃতির প্রতিকূলতাও আধুনিক বিশ্বে আনুকূল্য বয়ে আনে৷ গরমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেয়ে গরমকে আরও উপভোগ্য করে তোলার আয়োজনেই আধুনিক ভোগী মানুষের সতৃষ্ণ দৃষ্টি বনেদি আভিজাত্য লাভ করে৷ মায়ের ঠান্ডা লাগার কথা শুনে ছেলের সোয়েটার পড়ে আইসক্রিম খাওয়ার কথা গল্প নয়, ঘটনা৷ গরমেই যে গরমকে উপভোগের এলাহি আয়োজন৷ সেখানে প্রকৃতির প্রতিকূলতাই মানুষের আনুকূল্য লাভ করে চলেছে অবিরত, অবিরাম! তাপমাত্রার উর্ধ্বগতিতেও যে ভোগী বাঙালির দুঃখবিলাস জেগে ওঠে, অচিরেই তা তার আদিখ্যেতাতেই বেরিয়ে পড়ে৷ সেখানে গাছের অভাব আগাছার মতো উপেক্ষিত হয়ে ওঠে৷ প্রকৃতির প্রতিশোধের শিকার হয়েও তা নিয়ে সোচ্চার হওয়ার অবকাশ মেলে না, ভাবা যায়!